আমরা পরকালের আলোচনা যখন শুনি তখন তাৎক্ষণিক কিছুটা আবেগাপ্লুত হই। মনটা কিছুটা কোমল হয়ে আসে। বাস্তবে পরকাল সম্পর্কে আমরা তেমন চিন্তা করি না এবং পরকালের জন্য প্রস্তুতিও নিই না। আমরা যারা নিজেদের বিশ্বাসী হিসেবে দাবি করি অর্থাৎ যারা জাতি হিসেবে মুসলিম পরিচয়ে পরিচিত তারাও পরকাল নিয়ে যেভাবে প্রস্তুতি নেয়ার কথা সেভাবে নিই না।
আমি মাঝে মধ্যে কবরের কাছে যাই। বিশেষ করে আমার মায়ের কবরের কাছে। তখন সামান্য সময়ের জন্য মনটা কোমল হয়! মহান আল্লাহর দেয়া আসমানি কিতাব পবিত্র কুরআন মনোযোগ দিয়ে বুঝে না পড়ার কারণে এ রোগের জন্ম হয়েছে বলে মনে করি।
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩; এক বন্ধু বললেন, চলেন আজকে বনানী কবরস্থানে যাই। শহীদদের কবর জিয়ারত করি। আমি বললাম, ওখানে কেন যেতে হবে দোয়া তো আমরা যেকোনো জায়গা থেকে করতে পারি। তিনি বললেন, চলেন সরাসরি যাই সেখানে গিয়ে দোয়া করি। তৎক্ষণাৎ আমি রাজি হলাম। মনে করলাম কবরের কাছে গেলে মনটা কোমলও হবে এবং সেখানে কিবলামুখী হয়ে আমাদের সবার জন্য দোয়া করব।
বিকেল বেলা গেলাম। প্রথমে বেসামরিক কবরস্থান পরিদর্শন করলাম। বনানী কবরস্থানে এই প্রবেশ ছিল আমার জন্য দ্বিতীয়বার। ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন রাজনীতিবিদ আমলা, বড় বড় ব্যবসায়ী আরো সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রভাবশালী অনেকের কবর দেখলাম। পাকিস্তান আমলের একজন স্পিকারের কবরও দেখলাম। আওয়ামী লীগের প্রথম সারির অনেক নেতাদের কবর দেখলাম। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র মরহুম আরাফাত রহমানের কবর দেখলাম। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের ও তার স্ত্রীর কবর দেখলাম। আরো নামকরা অনেকের।
সেখানে কবরস্থান পরিপাটি! প্রায় প্রতিটি কবর টাইলস বা উন্নতমানের পাথর দিয়ে বাঁধাই করা। ফুলগাছ লাগানো। সেখানকার পরিবেশটা এমন যেন গুলশান বনানীর অভিজাত ফ্ল্যাট বাড়ির লোকজনের যে একটি ভাব আছে; ঠিক কবরগুলোরও তেমনি। যদিও মহান আল্লাহ সবাইকে আমল অনুযায়ী ন্যায্যবিচার করবেন। কবরকে যদি হাজার টন স্বর্ণ দিয়ে বাঁধাই করা হয় তাতেও বিশেষ কোনো সুযোগ আসবে না। এই পৃথিবী থেকে লাখ লাখ নবী-রাসূল বিদায় নিয়েছেন তাদের অনেকের কবরের চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
কিছু দিন আগে এক ইংরেজি পত্রিকায় কবরের জমির দাম নিয়ে একটি রিপোর্ট হয়েছিল। যেটি ভাইরাল হয়। অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত বনানীর কবরস্থানে একজনের কবরের জায়গা ২৫ বছরের জন্য কিনতে দেড় কোটি টাকা লাগবে এমন প্রতিবেদন হয়েছিল। ঢাকার আরো কয়েকটি কবরস্থানের বিষয়েও সেখানে অনেক তথ্য দেয়া হয়েছিল। সেসব তথ্য পড়লে চমকে উঠতে হয়।
ঢাকার সাঁতারকুল এলাকার কবরস্থানে ভিন্ন একটি সিস্টেম। যদিও সেখানকার বিষয় নিয়ে রিপোর্ট করেননি। সাঁতারকুল কবরস্থানে আদি বাসিন্দাদের কবর দিতে টাকা লাগে না। জায়গা কিনে ওই এলাকায় বাড়ি করলেও তিনি সেখানে বহিরাগত হিসেবে পরিচিত এবং ভাড়ায় যারা থাকেন তাদের জন্য কবর দিতে ৮০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়।
আমি একাধিকবার কবরে নেমেছি। স্বজনের লাশ কবরে শুয়ে দিয়েছি। তা ছাড়া ঢাকার আজিমপুরে, মিরপুরের কবরস্থানেও গেছি আত্মীয়ের মৃত্যুর পর। ক’দিন আগে ছোট মামার জানাজা নিজে পরিয়েছি। ঢাকা থেকে মামার লাশের সাথে বাগেরহাটে নানাবাড়ির কবরস্থানে গেছি। যে কবরস্থানে আমার নানাবাড়ির শতজনের ওপরে কবর রয়েছে। আমরা বহু স্বজনকে হারিয়েছি। দাদার বাড়ির ভাগের অংশের কবরস্থানে আমার দাদা-দাদী ও মায়ের কবর। যেখানে সময় পেলে যাই।
২৫ ফেব্রুয়ারি এলে ৫৭ জন শহীদদের কথা মনে পড়ে। ৫৭ জন সামরিক কর্মকর্তা নির্মমভাবে শহীদ হন। তারা আমাদের আত্মীয় নন। সরাসরি পরিচিতও নন। কিন্তু তাদের জন্য মন থেকে দোয়া আসে। আবেগে চোখে পানি আসে। কারণ আমরা দেশকে ভালোবাসি। সেদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি সামরিক কবরস্থানেও গিয়েছিলাম। নীরব এক জায়গা। কোকিলের ডাক শুনতে পাওয়া যায়। যদিও মাঝে মধ্যে পাশের স্টেডিয়ামের উচ্চ শব্দের মিউজিকও শোনা যায়।
৫৭ জন শহীদের কবরের কাছে গেলাম। ভেতর থেকে কান্না এসেছিল কিন্তু চেপে রেখেছি। একজন ভদ্র মহিলাকে দেখলাম মন খারাপ করে কবর দেখছিলেন। জিজ্ঞেস করলাম, আপনার কোনো স্বজনের কবর আছে এখানে? বললেন, এটি আমার স্বজনের কবর। অর্থাৎ ৫৭ জনের একজনের তিনি স্বজন।
কিছুক্ষণ পর আমরা কয়েকটি সূরা পড়ে কিবলামুখী হয়ে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করলাম। আল্লাহর কাছে এ শহীদদের জন্য জান্নাতুল ফেরদাউস কামনা করছি এবং আমাদের জন্য দোয়া করেছি।
এ দেশের কোটি কোটি নাগরিক অপেক্ষায় রয়েছেন এ বর্বর হত্যাকাণ্ডের ন্যায্য বিচারপ্রাপ্তির জন্য।