কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকায় নির্মীয়মাণ গুলাম রসুল মসজিদের কাছে এক ঘিঞ্জি গলি। সেই এঁদো গলির এক অন্ধকার ঘরে শয্যাশায়ী ৮৫ বছরের বৃদ্ধ, তার ছয় ছেলেমেয়ে সমেত অপেক্ষা করছেন জুলাই মাসের। কারণ সেই মাসে আসামের এক আটক কেন্দ্র, অর্থাৎ ডিটেনশন সেন্টার থেকে ছাড়া পাওয়ার “ক্ষীণ আশা” রয়েছে অশীতিপর ওই বৃদ্ধের বড় ছেলে আসগর আলির।
আশির দশক থেকে গুয়াহাটিতে কাঠমিস্ত্রির কাজ করে আসছেন বছর পঞ্চাশের আসগর। আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগে, ১৪ জুলাই, ২০১৭, তাকে বিদেশি ঘোষণা করে আসামের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল, এবং আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জির আওতায় আসগরের স্থান হয় গোয়ালপাড়া আটক কেন্দ্রে।
কলকাতায় তার পরিবারের একমাত্র আশা এখন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, যে আসামের আটক কেন্দ্রে তিন বছরের বেশি কাউকে বন্দী করে রাখলে তাকে মুক্তি দিতে হবে। আটক হওয়ার আগে পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী সদস্য ছিলেন আসগর। সেই ভূমিকায় ফের তাকে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন তার পরিবার। যাতে তার বোনের বিয়েটা, যা গত বছর অর্থাভাবে বাতিল করতে হয়, এবার দেওয়া যায়। বা তাঁর বাবা মহম্মদ জরিফকে একজন ভালো ডাক্তার দেখানো যায়।
বিদেশ থেকে আসগরের উকিল আমন ওয়াদুদ হোয়াটসঅ্যাপে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানান, “আসগর আলির এসএলপি (স্পেশ্যাল লিভ পিটিশন) গত বছর খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু ১৪ জুলাই, ২০২০-র পর তাকে ছেড়ে দেয়া হবে, কারণ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ রয়েছে যে তিন বছরের বেশি কাউকে আটকে রাখা হলে তাকে মুক্তি দিতে হবে।”
ওয়াদুদ আরো জানান, “কিছু প্রক্রিয়াগত কারণে তাকে বিদেশি ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল – এবং নির্বাসন দেয়ার জন্য আটক করা হয়। কিন্তু কোনো ভারতীয় নাগরিককে যদি বিদেশি ঘোষণা করা হয়, তবে তাঁকে কোথায় পাঠাবেন? এবং যদি নির্বাসন দেয়া সম্ভব না হয়, তবে আদৌ আটক করা কেন? মুক্তির পরেও তো তিনি রাষ্ট্রহীনই থাকছেন।”
আসগরের সবচেয়ে ছোট ভাই আরশাদ বলছেন তাদের পরিবার “বহুযুগ” ধরে কলকাতা নিবাসী। “বড় ভাই আসামে যায় কাজের জন্য – ভালো উপার্জন হচ্ছে বলে ওখানেই থেকে যায়। পরে ওখান থেকে ভোটার কার্ডও করিয়ে নেয়,” বলছেন আরশাদ, যিনি কলকাতায় একটি ব্যাগ বানানোর কারখানায় কাজ করেন। বিয়ের পর স্ত্রীকেও গুয়াহাটি নিয়ে যান আসগর। তাদের ছেলের বয়স বর্তমানে ১২।
ট্রাইব্যুনাল তাকে বিদেশি ঘোষণা করার পর প্রথমে গৌহাটি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন আসগর, কিন্তু ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তই বহাল রাখে হাইকোর্ট। এরপর সুপ্রিম কোর্টে যান আসগর। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ এবং বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার একটি বেঞ্চ ১০ মে, ২০১৯ তার আবেদন খারিজ করে দেয়।
আসগরের পরিবারের দাবি, কয়েক বছর আগে নিজের নাম পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নেন আসগরের বাবা মোহাম্মদ জরিফ, এবং সেখান থেকেই শুরু হয় সমস্যা। ২০০৮ সালে ভোটার আইডি কার্ডে, এবং ২০১৩-১৪ সালে আধার কার্ডে পরিবর্তিত নাম নথিভুক্ত করান জরিফ, যার ফলে আসামে সমস্যায় পড়তে হয় আসগরকে।
আসগরের বোন রাদিয়া বিবি বলছেন, “আগে ভোটার লিস্টে আমার বাবার নাম ছিল শেখ মোড়ল। সবাই ওই নামের জন্য আমাদের খেপাত (মোড়ল কথাটির বাংলা অর্থের ভিত্তিতে)। তখন বাবা নাম পাল্টে করেন মোহাম্মদ জরিফ, আধার কার্ডেও সেই নাম আছে। এর ফলেই ট্রাইব্যুনালের সামনে সমস্যায় পড়ে আসগর।”
“বাবা তখন অসুস্থ, তবু তাকে নিয়েই আমরা সবাই গেলাম, সব অ্যাফিডেভিট আর কাগজপত্র নিয়ে। কিন্তু কেউ আমাদের কথা শুনল না, আমার বড় ভাইকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিল।”
সেবছরের জুলাই মাস থেকেই পরিবারের অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। আসগরের আর এক ভাই আশরাফ কলকাতায় একটি টুপির কারখানায় কাজ করেন। তিনি জানাচ্ছেন, “আমাদের সবচেয়ে ছোট বোন রাজিয়া খাতুনের বিয়ে ঠিক করি গত বছর। ওর বয়স ৩০। কিন্তু আমাদের যথেষ্ট টাকা ছিল না বলে বিয়ে ভেঙে যায়।”
আশরফ আরো বলছেন, “বাবার বয়স ৮৫, নড়তে-চড়তে পারেন না। বড় ভাই থাকলে একজন ভালো ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে পারত। এখন আমাদের উকিল বলছেন যে জুলাই মাসে ও ছাড়া পেতে পারে। সেই অপেক্ষাতেই রয়েছি আমরা।”
আসগরের দুই ভাইয়ের দৈনিক রোজগার মাথাপিছু ২০০ রুপির কাছাকাছি। এই উপার্জন থেকেই দেখাশোনা করতে হয় চার বোন এবং অসুস্থ বাবার।
সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস