১০৯৯ সালে প্রথম ‘ক্রুসেড যুদ্ধে’ মুসলমানরা খ্রিষ্টানদের কাছে পরাজিত হওয়ার পর গডফ্রে জেরুসালেমের শাসনকর্তা হয়ে যান। তিনি জেরুসালেমে প্রবেশ করেই মুসলমান ও ইহুদিদের নির্বিচারে হত্যার নির্দেশ দেন। ক্রুসেডাররা বায়তুল মোকাদ্দাস প্রাঙ্গণে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম ও হৃদয়বিদারক গণহত্যা চালানোর পরদিন সারি সারি লাশ ডিঙিয়ে পর্যটক ও যাজকরা শহরে ঢোকেন। তখন রক্তের বন্যায় তাদের হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যায় বলে ঐতিহাসিকরা বর্ণনা দিয়েছেন। কয়েক দিন ধরে চলা এই নির্বিচার গণহত্যায় ৭০ হাজার নিরীহ মুসলমান ও ইহুদি প্রাণ হারান। (সূত্র : Guillaume de tyr অধ্যায় ১, পৃষ্ঠা-৩৫৪)
এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের ঠিক ৮৮ বছর পর জগতকে চমকে দেন জেরুসালেম পুনরুদ্ধারকারী মুসলিম মহাবীর সালাহউদ্দীন আইয়ুবি। জেরুসালেম বিজয় করে মহানুভব মহাবীর সালাহউদ্দীন (Saladin) জেরুসালেমের সব যুদ্ধবন্দীসহ আটকাপড়া নাগরিকদের মুক্তির নির্দেশ দেন। যুদ্ধবন্দী ক্রুসেডারদের শুধু মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্ত করা হয়। যাদের মুক্তিপণ দেয়ার সামর্থ্য ছিল না, সুলতান সালাহউদ্দীন নিজ অর্থে তাদের পণের অর্থ আদায় করতে সহায়তা করেন। শুধু হত্যাকারী যুদ্ধাপরাধীদেরকে বিচারের আওতায় আনা হয়। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ স্ট্যানলি এডওয়ার্ড লেনপুল লিখেন : ‘সুলতান সালাহউদ্দীন একদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পুরো সময় নগরীর প্রবেশদ্বার খুলে রেখে অসহায় দরিদ্রদের মুক্তিপণ ছাড়াই তাদের নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যেতে দেন।’ ১১৯৩ সালে এই জেরুসালেমেই বিশ্ববিজয়ী মহাবীর সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবি ইন্তেকাল করেন।
বিশ্ব সাক্ষী, জেরুসালেম বিজয়ের পর ক্রুসেডাররা কী করেছে সেখানে এবং কতটা মানবিকতা ও মহানুভবতা দেখিয়েছেন মহাবীর মহান মুসলিম বিজয়ী সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবি। তারপরও বলা হয়, মুসলিমরা মধ্যযুগীয় আর ক্রুসেডাররা উদার! হিটলারের যুদ্ধমন্ত্রী গোয়েবলস যেমনটি বলেছিলেন, ‘একটি মিথ্যা তুমি হাজারবার বলো, সেটিই সত্যে পরিণত হবে।’ তারা আজ ‘সভ্যতার সঙ্ঘাত’ (Clash of Civilization) তত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে! ফ্রেঞ্চ ইতিহাসবিদ Bandri Cort জেরুসালেমে দখলদার ক্রুসেডারদের নৃশংসতার বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেন : ‘আমাদের সৈনিকরা জেরুসালেম অভিযান শেষে ছাউনিতে ফিরে নিজেরাই লজ্জিত হয়। তারা ১৮ হাজার গাছপালাই শুধু পুড়িয়ে খাক করেনি, অগণিত নারী, শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকেও নারকীয় পন্থায় হত্যা করে। আরব নারীরা ছেলেবেলায় স্বর্ণ ও রুপার বাজুবন্ধ পরত। তারা বড় হলে সেই বাজুবন্ধগুলো বাহুর সাথে স্থায়ীভাবে আটকে যেত। আমাদের সেনাদের সময় ছিল না সেগুলো খোলার। তাই তারা তাদের হাত কেটে গয়নাগুলো লুট করে এবং তাদের অঙ্গচ্ছেদ করে মুমূর্ষ, রক্তাক্ত অবস্থায় ছেড়ে দেয়।’ অথচ সেই নিষ্ঠুর পিশাচ ক্রুসেডারদের নিয়ে গর্ববোধ করে পাশ্চাত্য ‘সভ্যতার’ জয়গান গেয়েছেন কারলাইল ও দান্তের মতো মনীষীরা! যেমন বাংলা লুটকারী বর্গি মারাঠিদের জয়গান গেয়ে গেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার ‘শিবাজী’ কবিতায়।
বুঝি না রক্তপিপাসু হানাদার খুনিরা যতই স্বধর্মী বা স্বজাতি হোক, একজন মনীষী কিভাবে তাদের ‘জয়গান’ গাইতে পারেন? বাংলাদেশকে যে মারাঠা হানাদাররা লুট করেছে, যাদের নামে ভয় দেখিয়ে বাংলার মায়েরা তাদের কোলের শিশুদের ঘুম পাড়াতেন (খোকা ঘুমাল, পাড়া জুড়াল, বর্গি এলো দেশে)। আলীবর্দী খান থেকে মুরশিদকুলি, সিরাজউদ্দৌলাহ পর্যন্ত বাংলার জনপ্রিয় সুলতান ও নবাব কত শত বছর ধরে এই বর্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলার স্বাধীনতা ও জনগণের জানমাল হিফাজত করেছেন। অথচ রবীন্দ্রনাথ সেই বর্গি পাণ্ডব ছত্রপতি শিবাজীকে জাতীয় বীর আখ্যা দিয়ে লিখলেন : ‘মারাঠির সাথে আজি, হে বাঙালি এক কণ্ঠে বলো ‘জয়তু শিবাজী।’/মারাঠির সাথে আজি, হে বাঙালি, একসাথে চলো মহোৎসবে সাজি।/আজি এ সভাতলে ভারতের পশ্চিম-পূরব/দক্ষিণে ও বামে/একত্রে করুক ভোগ একসাথে একটি গৌরব/এক পুণ্য নামে। (শিবাজী উৎসব কবিতা, রবীন্দ্রনাথ)
অথচ শায়েস্তা খাঁ এই হানাদার মারাঠিদের কঠোর হাতে দমন করতে সক্ষম হন বলেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এতটা নির্ঝঞ্ঝাট হয় যে, তার আমলে বাংলার মানুষ টাকায় আট মণ চাল ক্রয়ের সৌভাগ্য অর্জন করে। রবীন্দ্রনাথ এত লিখেছেন; এত পড়েছেন, অথচ ইতিহাসের দিকে একটিবারও ভ্রুক্ষেপের প্রয়োজন বোধ করলেন না? আশ্চর্য! বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এই রবীন্দ্রনাথকে অর্থাৎ এত অচেনা মনে হলো। অথচ তিনি সজ্ঞানে কখনোই ইতিহাস বিকৃত করেছেন বলে জানা যায় না। জ্ঞানী ও মনীষী জনরা জানেন ইতিহাসকে ধামাচাপা দেয়া যায় না। তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথ নিজেই এক সময় অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের মূল ইতিহাস খর্ব করার প্রবণতাকে খণ্ডন করে লিখেছিলেন : “ইংরেজ রাজ কর্মচারী হলওয়েল কর্তৃক প্রচারিত ‘অন্ধক‚প হত্যার’ কাহিনীটি সত্য নয়, অতিরঞ্জিত।” রবীন্দ্রনাথ আরো লিখেন : ‘সেই পরিণামদারুণ মহানাটকের মধ্যে সিরাজউদদৌলাই একমাত্র লোক যিনি প্রতারণা করিবার চেষ্টা করেননি।’ (ম্যালিসন-১৮৮৫, পৃষ্ঠা-৭১, রবীন্দ্রনাথ ১৩৮৫, পৃষ্ঠা-১২৮)। রবীন্দ্রনাথ নাট্যকার অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়কে ‘ইতিহাস নীতি লঙ্ঘনের’ অপরাধে ভর্ৎসনা করে বলেন, ‘ইহাতে সত্যের শান্তি নষ্ট হইয়াছে এবং পক্ষপাতের অমূলক আশঙ্কায় পাঠকের মনে মধ্যে মধ্যে ঈষৎ উদ্বেগের সঞ্চার করিয়াছে।’ (রবীন্দ্রনাথ-১৩৯৫, পৃষ্ঠা-১২৯)। এই মনীষী বিশ্বকবি যখন মুঘলদের তথা মুসলিম শাহীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করায় মারাঠি বীর ছত্রপতি শিবাজীর পূজায় প্রবৃত্ত হন তখন তাকে আসলেই ‘অচেনা’ মনে হয়। এখানেই তিনি একজন হিন্দু কবির অতি সঙ্কীর্ণ উঠানে নিজেকে বন্দী করে ফেলেছেন। নইলে মারাঠিরা বাঙালির ‘বীর’ হয় কোন যুক্তিতে?
শিবাজী তো সেই প্রতারক যিনি সন্ধি করতে ডেকে এনে আফজাল খাঁকে কোলাকুলির সময় পিঠে তার ব্যাঘ্র নখ ঢুকিয়ে হত্যা করে বাস্তবে ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের পুনরাবৃত্তি করেন। সেই শঠ, ভণ্ড প্রতারক ‘বীর’ হতে পারেন কি? সিরাজের মহান দেশপ্রেমিক চরিত্র কেবল ভারতীয় উচ্চ বর্ণাহঙ্কারী বাবু শ্রেণী বা ব্রিটিশ-জার্মান প্রাচ্যবিদরাই (Orientalist) বিকৃত করেননি। ব্রিটিশ অনুগ্রহধন্য মুসলিম লেখকরাও তাদের ‘সিয়ারে মুতাখখারিন’, ‘রিয়াজুস সালাতিন’, ‘মোজাফফরনামা’ বা তাওয়ারিখ-ই-বাঙ্গালাহ’ ফারসি ভাষায় লেখা বইগুলোতেও সিরাজউদ্দৌলাকে কদর্য করে দেখানোর অপপ্রয়াস চালিয়েছেন। এখানেই দুঃখটি বেশি করে বিঁধে। ইতিহাসবিদরা এখন বলছেন সিরাজ নেপোলিয়নের চেয়েও সাহসী দেশপ্রেমিক ছিলেন। ইতিহাসবিদ সুশীল কুমার চৌধুরী লিখেছেন : নবাব আলীবর্দী খাঁ (প্রকৃত নাম আল্লাহওয়ার্দী খান) ১৭৪০-৪১ সালেই বর্গিবিরোধী যুদ্ধে কিশোর সিরাজউদদৌলাহকে সাথে করে নিয়ে যান এবং ১৭৪৯ সালে মারাঠা লুটেরাদের দমন করতে বালাশোর যুদ্ধে সেনাপতি বানান সিরাজকে। তার আগের বছর মারাঠা গুপ্তচরদের হাতে প্রাণ হারান সিরাজের পিতা জয়নুদ্দীন।
বাংলার স্বাধীনতা এবং বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার জনসাধারণের জান-মাল-ইজ্জত সুরক্ষার তেজস্বিতা ছিল সিরাজের রক্তের মধ্যে। অথচ সিরাজকে অবহেলা করে বাংলার দুশমন ছত্রপতি শিবাজীকে রবীন্দ্রনাথ বানালেন ‘জাতীয় বীর!’ এ যুগে যেমন সভ্যতার শত্রু বানালেন বুশ আরব বীর সাদ্দাম হোসেনকে। সেদিন দেখলাম ‘ফেসবুকে’ এক বাচ্চা মেয়ে তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, আমেরিকা জানত, সাদ্দামের কাছে পরমাণু বোমা বা Weapons of Mass Destruction (WMD) নেই, তাই তারা হামলা করল ইরাকের ওপর। অথচ উত্তর কোরিয়ার কাছে অজস্র্র পরমাণু বোমা আছে জেনেও তারা কোরিয়ার ওপর হামলা চালাতে সাহস পায় না। কারণ তারা জানে কিম বোমা দাগলে ফ্লোরিডা, ইটস্টোন, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, ডেলাওয়ার, নিউইয়র্ক ছাইভস্ম হয়ে যাবে। এতখানি নির্র্ভুল উত্তর কোরিয়ার আন্তঃমহাদেশীয় পরমাণুবাহিত ক্ষেপণাস্ত্রের!
পরদেশ দখল ও ক্রুসেড যুদ্ধ নতুন করে শুরু করা যাদের বাসনা তাদের কখনোই ‘কুযুক্তির’ অভাব হয় না। মিসর দখলের সময় যেমন নেপোলিয়ন মিসরকে মামলুক শাসকদের হাত থেকে আরব ভূমিপুত্রদের ‘নাজাত’ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন, পলাশী যুদ্ধের সময়ও ইংরেজরা ঠিক তেমনভাবেই সিরাজের ‘ঔদ্ধত্য’ থেকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাকে মুক্ত করার কুমন্ত্রণা ছড়ায় আর এই সর্বনাশা চক্রান্তে ইন্ধন জোগায় নবাববিরোধী মাড়োয়ারি বণিক গোষ্ঠী এবং রাজ অমাত্যদের একটি অংশ, যারা আলীবর্দী খাঁ কর্তৃক সিরাজকে তার উত্তরাধিকারী ঘোষণার পর থেকেই ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে মরছিল। ঠিক ইরাক হামলার কালেও আমেরিকানরা সাদ্দামের দুঃশাসনের অবসান ঘটানোর আবেগ নামক ‘বিষ’ ঢালছিল আরব মনে। অথচ ‘আরব বসন্ত’ এর সময় তারা ঠিকই মিসরের মার্কিনপন্থী সমর নেতা ও ধনী আরবদের পক্ষ নেয় এবং নির্বাচিত ও জনপ্রিয় ব্রাদারহুডকে ধ্বংস করার চক্রান্ত চালাতে থাকে। ‘স্যুয়েজ সঙ্কট’কালেও দেখা গেছে, পশ্চিমাদের এই একই ধরনের শঠতা ও প্রতারণামূলক দ্বৈতাচার নীতি। সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করে জামাল নাসের রাতারাতি পশ্চিমা স্বার্থের দুশমনে পরিণত হন। মিসরে মামলুকরা ফরাসি ‘সওদাগরদের নির্যাতন করছে’, নেপোলিয়ন সেদিন যে ‘কুযুক্তি’ দাঁড় করান, ব্রিটিশরাও তেমনি বাংলার নবাবের হাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ওপর ‘নির্যাতনের’ বিষয়টিকে মুর্শিদাবাদের সার্বভৌমত্ব হরণের জন্য কুযুক্তি হিসেবে দাঁড় করায়। ব্রিটিশ সেনাপতি ওয়ারেন হেস্টিংস মিসর দখল করে হাত পাকান আর সেই দখলদারি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই লর্ড ক্লাইভ ও ক্যাপ্টেন ড্রেক পলাশী যুদ্ধ ঘটানোর সাহস পায়। ফরাসিরা তছনছ করে মহান তুর্কি ওসমানিয়া (অটোম্যান) সুলতানাত; আর বাংলা দখল করে অপর এক মহান সাম্রাজ্য মুঘলশাহীকে তছনছ করে ব্রিটিশ নৌদস্যুদল। সপ্তদশ শতক নাগাদ যেমন মহান ওসমানিয়া সালতানাতের সুশাসনে বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র ছিল মিসর ও তুরস্ক; অষ্টাদশ শতাব্দী নাগাদ তেমনই মহান মুঘল বাদশাহীর সুশাসনে বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় ভারত।
প্রাচ্যকে এভাবেই সর্বস্বান্ত করে আসছে পাশ্চাত্য বা পশ্চিমা শক্তিজোট। কখনো যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে, কখনো সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে, কখনো নিষেধাজ্ঞা জারি করে, কখনো বা ইতিহাস-ঐতিহ্য বিকৃত করে, পশ্চিমা ‘ক্রুসেডারদের’ মূল লক্ষ্য হলো প্রাচ্যকে হেয় করা এবং ‘ক্রুসেডের’ বদলা নেয়া। সেই যুদ্ধ এখনো থামেনি। কখনো সুযোগ বুঝে তারা কৌশলগত ‘মৈত্রী’ করে; কখনো আবার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া মাত্র তালাক দেয়। প্রাচ্যবাসী সর্বস্বান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত টেরও পায় না, কী ক্ষতির মধ্যে পড়ল তারা।