রমজানের রোজা ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম। প্রতিটি সুস্থ, মুকিম, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও হায়েজ-নেফাসমুক্ত প্রাপ্তবয়স্কা নারীর ওপর রমজানের রোজা রাখা ফরজ। কুরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে- ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যেন তোমরা মুত্তাকি হতে পারো।’ (সূরা বাকারা-১৮৩) ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এ রমজান মাস পাবে, সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে।’ (সূরা বাকারা-১৮৫) মহানবী সা: ইরশাদ করেন, ‘যখন তোমরা রমজানের চাঁদ দেখো, তখন থেকে তোমরা রোজা রাখো। আর যখন শাওয়ালের চাঁদ দেখো তখন থেকে রোজা বন্ধ করো। যদি আকাশ মেঘলা থাকে, তাহলে ৩০ দিন রোজা রাখো।’ (বুখারি-১৯০৯, মুসলিম-১০৮০)
প্রতিদান দেবেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা : রোজার প্রতিদান দেবেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। এ ব্যাপারে মহানবী সা: ইরশাদ করেন, ‘আদম সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব বৃদ্ধি করা হয়। একটি নেক কাজের সওয়াব দশ গুণ থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘কিন্তু রোজার বিষয়টি ভিন্ন। কারণ রোজা একমাত্র আমার জন্য। এর প্রতিদান আমি নিজেই দেবো। রোজাদার বান্দা কেবল আমার জন্যই স্বীয় মনোবাসনা পরিত্যাগ করেছে এবং পানাহার বর্জন করেছে।’ (মুসলিম-১১৫১, ইবনে মাজাহ-১১৮)
রোজা ও অন্যান্য আমলের মধ্যে এই ব্যবধান কেন হলো? এর জবাবে মুহাদ্দিসিনে কেরাম বলেছেন, যদিও প্রকৃতপক্ষে সব আমলই হয়ে থাকে আল্লাহর জন্য, তাঁরই সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের আশায়। তবুও অন্যান্য ইবাদতের কাঠামোগত ক্রিয়াকলাপ, আকার-আকৃতি ও পদ্ধতিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যের পাশাপাশি রিয়া, লোক দেখানো ও নফসের স্বাদ গ্রহণের সুযোগও বিদ্যমান থাকে। তার অনুভূতির আড়ালেও তা লুকিয়ে থাকতে পারে। নিজে অনুভব করতে না পারলেও তার ভেতরে অবচেতনভাবেও তা বিদ্যমান থাকতে পারে। পক্ষান্তরে রোজার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ আলাদা। রোজা কাঠামোগত, আকার-আকৃতি ও নিয়ম-পদ্ধতিতে এমন যে, ‘রেজায়ে মাওলা’ ব্যতীত রোজাদারের অন্য কোনো স্বাদ গ্রহণের বিন্দুমাত্র সুযোগ থাকে না। নিজে মুখে প্রকাশ না করলে সর্বজ্ঞ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছে তা প্রকাশ হয় না। এ কারণেই রোজা ও অন্যান্য ইবাদতের মধ্যে এই ব্যবধান।
রোজাদারের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হয় : রোজাদারের জন্য আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন অফুরন্ত ও অবারিত নিয়ামত ও পুরস্কারের ওয়াদা। মহানবী সা: ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ (বুখারি-১৮৬৩)
রোজার সমতুল্য কোনো কিছুই নেই : হজরত আবু উমামা রা: বর্ণনা করেন, আমি বললাম ইয়া রাসূলুল্লøাহ! আমাকে এমন কোনো আমলের কথা বলে দিন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। তিনি বললেন, ‘তুমি রোজা রাখো। কারণ রোজার সমকক্ষ কোনো কিছুই নেই।’ আমি দ্বিতীয়বার তাঁর কাছে এসে একই কথা বললে, তিনি বললেন, ‘রোজা রাখো’। (মুসনাদে আহমাদ-২২১৪০)
জান্নাতে রোজাদারের দরজা: সাহাবি সাহল ইবনে সাদ রা:-এর বর্ণনায় রাসূলুল্লøাহ সা: বলেন, ‘রোজাদারের জন্য জান্নাতে বিশেষ একটি দরজা আছে। যার নাম রাইয়ান। এই দরজা দিয়ে কেবল রোজাদারই প্রবেশ করবে। অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। যখন সর্বশেষ রোজাদার ব্যক্তি তা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে, তখন সেই দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। যে সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে, সে জান্নাতের পানীয় পান করবে। আর যে সেই পানীয় পান করবে, সে আর কখনো তৃষ্ণার্ত হবে না।’ (সুনানে নাসায়ি-১/২৪১, হাদিস-২২৩৬, বুখারি-১/২৫৪, হাদিস-১৮৯৬)
রোজা ঢাল ও সুদৃঢ় দুর্গ : জাবের রা: বলেন, মহানবী সা: বলেছেন, ‘আমাদের মহামহিম রব ইরশাদ করেছেন, রোজা হলো ঢালস্বরূপ। মু’মিন বান্দা এর দ্বারা পরকালে জাহান্নামের আগুন থেকে আত্মরক্ষা করবে।’ (মুসনাদে আহমাদ-১৪৬৬৯) আবু হুরায়রা রা: বর্ণনায় এসেছে, নবী কারিম সা: ইরশাদ করেন, ‘রোজা হলো জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ লাভের ঢাল ও সুরক্ষিত, সুদৃঢ় দুর্গ।’ (শুআবুল ঈমান, বায়হাকি-৩৫৭১)
মুখের দুর্গন্ধও সুগন্ধীময় : আবু হুরায়রার বর্ণনায় মহানবী সা ইরশাদ করেন, ‘শপথ সেই সত্তার যার হাতে আমি মুহাম্মাদের জীবন, রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের সুগন্ধীর চেয়েও অধিক সুগন্ধীময়।’ (বুখারি-১৮৯৪) উল্লেøখ্য, বর্ণিত হাদিসে দুর্গন্ধ দ্বারা ওই দুর্গন্ধকেই বোঝানো হয়েছে, যা পানাহার বর্জনের কারণে পেটের ভেতর থেকে উৎপাদিত হয়।
রোজাদারের দোয়া কবুল হয় : আব্দুল্লøাহ ইবনে আমর থেকে বর্ণিত- মহানবী সা: ইরশাদ করেছেন, ‘ইফতারের সময় রোজাদার যখন দোয়া করে, তখন তার দোয়া ফিরিয়ে দেয়া হয় না। অর্থাৎ অবশ্যই কবুল হয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ-১৭৩৫) রোজাদারের দোয়া ফিরিয়ে দেয়া হয় না। অর্থাৎ অবশ্যই কবুল করা হয়। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা-৮৯৯৫)
রোজা পালনকারীর ব্যাপারে যেভাবে আল্লাহর অফুরন্ত ও অবারিত নিয়ামত এবং পুরস্কারের ওয়াদা বর্ণিত হয়েছে, ঠিক সেভাবে ইচ্ছাকৃত রোজা পরিত্যাগকারী ও ভঙ্গকারীর ব্যাপারেও বর্ণিত হয়েছে কঠোর ও চূড়ান্ত শাস্তিবাণী। রোজা ইচ্ছাকৃত ও বিনা ওজরে ভেঙে ফেললে বা না রাখলে বান্দা গুনাহগার ও জাহান্নামের শাস্তির উপযুক্ত হয় কেবল তাই নয়; ওই এক রোজার পরিবর্তে আজীবন রোজা রাখলেও রমজানের এক রোজার যে ফজিলত, বরকত ও কল্যাণ তা কখনো লাভ করতে পারবে না। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি সফর ও কোনো অসুস্থতা ব্যতীত ইচ্ছাকৃত একটি রোজাও ভাঙবে, সে আমৃত্যু রোজা রাখলেও সে রোজার যথার্থ ক্ষতিপূরণ আদায় হবে না।’(মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা-৬/১৩৫, ইবনে মাজাহ-১২০)
রোজার জাগতিক উপকারিতা : রোজার মাধ্যমে মানুষের ভেতর সবর, শুকরিয়া, হামদর্দি বা সহমর্মীতার মতো মহৎ গুণাবলি সৃষ্টি হয়। লোভ-লালসা, হিংস্র্রতার মতো ক্ষতিকারক স্বভাবগুলো দূর হয়ে যায়। এ ছাড়া বর্তমান চিকিৎসাবিজ্ঞানও বলে- শারীরিক সুস্থতায় রোজার ভূমিকা ব্যাপক ও প্রশংসনীয়। (মাসায়েলে রফআত কাসেমি-২/২৫-২৬, রোজা অধ্যায়)
লেখক : ইমাম ও খতিব, মসজিদুল আমান, গাঙ্গিনারপাড়, ময়মনসিংহ