আবরার হত্যাকাণ্ডের পর সারা দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে বসবাসরত সন্তানদের নিয়ে উদ্বিগ্ন বিমর্ষ অবস্থায় রয়েছেন অভিভাবকেরা। সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে বিরাজ করছে তাদের মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। সদ্য ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকেরা চিন্তিত সন্তানকে আবাসিক হলে রাখার বিষয়ে।
দেশের মেধাবী সন্তানদের নিরাপত্তা দিতে ও তাদের লেখাপড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যর্থ বলে মনে করেন অনেক অভিভাবক।
আবরার হত্যার পর অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলেও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের দ্বারা নানাভাবে নিরীহ শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। গণমাধ্যমের পাশাপাশি ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে বর্তমান ও সাবেক আবাসিক শিক্ষার্থীরা তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে টর্চার সেল, গণরুম, র্যাগিং সংস্কৃতি, মিছিলে অংশগ্রহণে বাধ্যকরাসহ নানা কারণে অনেক আবাসিক শিক্ষার্থী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার খবর কয়েক দিন ধরে প্রকাশিত হচ্ছে। এসব নির্যাতনের কিছু কিছু ভিডিও চলে এসেছে সামাজিক মাধ্যমে। যুগ যুগ ধরে দেশের নামকরা বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতিকে কেন্দ্র করে সঙ্ঘাত, হানাহানি, নিরীহ শিক্ষার্থী হত্যাসহ প্রায়ই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা খবরের কাগজে শীর্ষ খবরে পরিণত হচ্ছে। প্রতিটি হত্যা, সঙ্ঘাতের ঘটনায় বিচলিত হন অভিভাবক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি আবাসিক হলে প্রভোস্ট, আবাসিক শিক্ষকসহ প্রশাসন বিদ্যমান থাকলেও মূলত তারা আছেন নামে মাত্র। কিছু কাগজপত্রে স্বাক্ষর করা ছাড়া তাদের আর কোনো ভূমিকা নেই আবাসিক হলে। হলে নতুন শিক্ষার্থী ওঠানো, নামানোসহ যাবতীয় বিষয় মূলত নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতাসীনদের ছাত্রসংগঠন। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে এ নৈরাজ্য আর জিম্মিদশা। আর এ কারণে প্রায় প্রতিটি আবাসিক হলের প্রতিটি শিক্ষার্থীর হলে সিট পেতে দ্বারস্থ হতে হয় ক্ষমতাসীন দলের শাখা ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের কাছে। এভাবে শুরু থেকেই শিক্ষার্থীরা এক প্রকার অসহায়ের শিকার আর হাতের পুতুলে পরিণত হয়। আবাসিক হলে সিট দেয়ার বিনিময়ে তারা খবরদারি করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর। এমনকি সিট পাওয়া নিয়ে চলে অনেক ন্যক্কারজনক ঘটনা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও দেশের পুরনো নামকরা বিভিন্ন কলেজের আবাসিক হলের চিত্রও একই রকম। কয়েক বছর আগে দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় ঢাকার একটি প্রাচীন মহিলা কলেজের আবাসিক হলে ক্ষমতাসীন ছাত্রীসংগঠন কর্তৃক ছাত্রীদের দিয়ে নানা অপকর্মের খবরে।
আবাসিক ভবনে সিট পাওয়াসহ নানা কারণে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের দ্বারা হয়রানি নির্যাতনের ঘটনা কেউ কেউ মেনে নিতে পারলেও অনেকে এসব মেনে নিতে পারেন না। অনেকে ভোগেন তীব্র মানসিক যন্ত্রণায়। অনেকে সারা জীবন বয়ে বেড়ান এসব তিক্ত স্মৃতির দুঃসহ যন্ত্রণা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের সাবেক এক আবাসিক ছাত্র এ প্রতিবেদককে বলেন, একজন আবাসিক ছাত্র হিসেবে আমি নিশ্চিত যে, যেখানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ নয় এমন সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থী কোনো না কোনো মাত্রায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। কিন্তু নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীরা এসব ঘটনা তাদের অভিভাবকদের কাছে বলেন না। তারা পরিস্থিতির শিকার বলে ঘটনা মেনে নেয় এবং চেপে যায়। কিন্তু মা-বাবা জানেন না যে, তাদের আদরের মেধাবী সন্তানেরা দেশের নামকরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার পর আবাসিক ভবনে কিভাবে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কিভাবে তারা দীর্ঘদিন ধরে এক প্রকার জিম্মি জীবন যাপন করছেন। তারা জানতে পারেন কেবল মাত্র যখন কেউ আবরারের মতো করুণ পরিণতির শিকার হন তখন।
অনেক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, আগে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হতো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন কর্তৃক। কিন্তু বর্তমানে নামকরা অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলেও ছড়িয়ে পড়েছে র্যাগিং নামক এক জঘন্য বিকৃত আচরণের। এ কারণে কথিত বড় ভাই আর বড় আপাদের কাছে নির্যাতনেরর শিকার হয় প্রায় প্রতিটি নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থী। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ এমন কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের আবাসিক হলেও শিক্ষার্থীরা এসব জঘন্য বিকৃত আচরণের শিকার হচ্ছেন।
একজন অভিভাবক বলেন, তার ছেলে এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে মানবিক বিভাগে। কিন্তু ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করালেও হলে থাকা নিয়ে আমরা চিন্তিত। বিভিন্ন আবাসিক ভবনের যেসব খবর বের হচ্ছে তাতে আমরা বুঝতে পারছি সব শিক্ষার্থীই নানাভাবে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। শুধু আবাসিক ভবন নয়, মূলত অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো প্রশাসনই নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন। আবাসিক হলের প্রশাসন অনেক দিন ধরেই অকার্যকর। এটা মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে যে, আমাদের আদরের সন্তান এত কষ্ট করে দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পর তার এভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এটা আমরা মেনে নিতে পারছি না কোনোমতেই। এটা মানা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দেশের মেধাবী সন্তানদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের জন্য জ্ঞান চর্চার সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি। এটা দেশের জন্য চরম ক্ষতির একটি বিষয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া এখনো যেকোনো শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য অনেক গর্বের একটি বিষয়। কিন্তু তাদের এ করুণ পরিণতি নিয়ে আমরা ভীষণ রকমের চিন্তিত ও হতাশ।
একজন অভিভাবক জানান, তার ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থী। আবরার হত্যার পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলে শিক্ষার্থী নির্যাতনের পর আমরা তার কাছে জানতে চেয়েছি সে কখনো কোনো খারাপ পরিস্থিতি শিকার হয়েছে কি না। সে বলেছে শারীরিক নির্যাতনের শিকার না হলেও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের দ্বারা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে সে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য অনেক অভিভাবক বলেছেন, দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত।