শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৫৮ পূর্বাহ্ন

করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার নিয়ে রাজনীতি

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১ এপ্রিল, ২০২০
  • ৩১৯ বার

করোনা ভাইরাস থেকে রেহাই পেতে বিশ্বজুড়ে চলছে গবেষণা, যাতে স্বল্প সময়ে একটা কার্যকর ভ্যাকসিন অথবা ওষুধ তৈরি করা যায়। যদিও সহসাই তার দেখা মিলবে বলে মনে হয় না। খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, সুখবর আসতে আরও সময় লাগবে।

করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা পরিকল্পনা করেছিলেন, মানুষের শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে যদি জনসাধারণকে এই মরণব্যাধি থেকে বাঁচানো যায়। এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই কাতারে কাতারে মানুষের মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে সহজ বুদ্ধিতে যা করার, অধিকাংশ দেশ তা-ই করতে শুরু করল। দূরত্ব রচনা এবং আইসোলেশন, তার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা এবং সচেতনতা।

ওদিকে কিন্তু করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে দক্ষযজ্ঞ চলছে। একটা রাসায়নিক ফর্মুলা! আর তার পেছনে মরিয়া গোটা বিশ্ব। ল্যাবরেটরিতে কিছু মানুষের দিনরাত এক চাপা উত্তেজনা, টেস্টটিউব আর কনিক্যাল ফ্ল্যাস্কের ঠুকঠাক শব্দ, আর গোপন বার্তা, ‘উপরমহল থেকে ফোন এসেছিল। কাজ কতদূর এগোল?’

এ কাহিনির শুরু মাত্র মাসচারেক আগে। ছোট-বড় সব দৈনিকেই খবর হয়েছিল, চীনে এক ‘অজানা জ্বরে’ আক্রান্ত অনেকে। প্রথম মৃত্যু হলো ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহানে। সেই শুরু। এ পর্যন্ত সেই মরণজ্বর ‘কোভিড-১৯’-এ গোটা পৃথিবীতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ২৯ হাজার। মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ইতোমধ্যে প্যানডেমিক বা অতিমারী ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আতঙ্ক গ্রাস করেছে গোটা বিশ্বকে। উন্নত দেশের সরকারগুলো বলছে, ‘যুদ্ধ-পরিস্থিতি’। অনেকে এ-ও বলছেন, ‘এ হলো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এবারের যুদ্ধটা নোভেল করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে।’

তবে পাশাপাশি একটা অন্য ‘যুদ্ধও’ চলছে, সবার অলক্ষ্যে। যে দিন থেকে ভাইরাসটি তার জাল ছড়াতে শুরু করেছে, চীন, ইউরোপ ও আমেরিকা নেমে পড়েছে এক অন্য লড়াইয়েÑ ‘কে আগে প্রতিষেধক আনবে বাজারে।’ ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্য সময়ে তীব্র রেষারেষি লেগে থাকে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তারাও পরস্পরকে সব রকম সহযোগিতায় রাজি। যদিও ক্ষমতার লড়াইয়ে রাষ্ট্রনেতারা ভুলতে পারছেন না ‘প্রথম’ হওয়ার স্বাদ। প্রশ্নগুলো ঘুরছেÑ ভ্যাকসিনের পেটেন্ট পাবে কোন দেশ, বিপুল মুনাফা লুটবে কে! আমেরিকা, ইউরোপ, চীনে ইতোমধ্যেই ক্লিনিকাল ট্রায়াল (গবেষণাগারে তৈরি ওষুধ মানুষের ওপর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ) শুরু হয়ে গেছে। আমেরিকাতেও হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশ আগে থেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করছেন, প্রতিষেধক এলেও বাজারে তার জন্য হাহাকার পড়ে যাবে। কারণ যে দেশ তৈরি করবে, তারা আগে দেশের বাসিন্দাদের জন্য প্রতিষেধক নিশ্চিত করে তবে বাজারে ছাড়বে এবং মুনাফা লুটবে।

চীনে অন্তত হাজার জন বিজ্ঞানী ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছেন এবং গোটা বিষয় চলছে সেনা নিরাপত্তায়। ‘চাইনিজ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’-এর অধিকর্তা ওয়াং জুনঝির ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তা দিয়েছেন, ‘আমরা কারও থেকে পিছিয়ে নেই।’ কয়েকদিন আগে একটি ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল ইন্টারনেটে, চীনের ভাইরোলজিস্ট চেন ওয়েই পরীক্ষামূলকভাবে একটি ইনঞ্জেকশন নিচ্ছেন। এ ছবির সত্যতা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। তার নির্দেশ, আমেরিকার মাটিতেই ভ্যাকসিন তৈরি করতে হবে। শুধু নির্দেশ দিয়েই ছাড়েননি তিনি। শোনা যাচ্ছে, জার্মানির একটি সংস্থাকে ‘ঘুষ’ দেওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন তিনি। ব্যাপারটা এ রকমÑ সম্প্রতি জার্মানির এক সরকারি কর্মকর্তা দাবি করেন, তাদের দেশের ‘কিয়োরভ্যাক’ নামে একটি সংস্থা ভ্যাকসিনটি প্রায় তৈরি করে ফেলেছে। এ কথা জানতে পেরে ট্রাম্প ওই সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং কয়েকশ কোটি ডলারের বিনিময়ে রিসার্চ-রিপোর্ট কিনতে চান। সংস্থাটি অবশ্য এই খবর অস্বীকার করেছে। কিন্তু জার্মানির তদন্তকারী দলের দাবি, ট্রাম্প যে এ ধরনের প্রস্তাব নিয়ে যোগাযোগ করেছিলেন, সে প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। ‘ডিয়েভিনি হপ বায়োটেক’ সংস্থার ৮০ শতাংশ অংশীদারি রয়েছে ডিটমার হপের। একটি জার্মান পত্রিকার কাছে তিনি বলেছেন, তার সঙ্গে ট্রাম্পের সরাসরি কথা না হলেও সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সংস্থার শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা সঙ্গে সঙ্গে তাকে খবর দেন। হপ বলেছেন, ‘আমরা প্রতিষেধক তৈরি করলে, সেই ফর্মুলা বিক্রির কোনো প্রশ্ন নেই।’ ওই জার্মান সংস্থার খবর প্রকাশ্যে আসতেই ইউরোপিয়ান কমিশন আবার তাদের ৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার অর্থসাহায্য দিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। চীনের এক সংস্থাও নাকি জার্মানির একটি সংস্থাকে ১৩ কোটি ৩৩ লাখ ডলারের বিনিময়ে ভ্যাকসিনের মালিকানার অংশীদারি কেনার প্রস্তাব দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেভাবে দেশগুলো এখন নিজেরা ড্রোন তৈরি করছে, সাইবার-অস্ত্র তৈরি করছে, ঠিক সেভাবেই তারা ওষুধের জন্য অন্য দেশের মুখাপেক্ষী হতে চায় না। ২০০৯-এ সোয়াইন ফ্লু মহামারীর সময়ে অস্ট্রেলিয়া প্রথম প্রতিষেধক আনে। কিন্তু তারা তাদের দেশের নাগরিকদের জন্য ওষুধ নিশ্চিত করে অনেক পরে আমেরিকাকে পাঠিয়েছিল। তাতে ওয়াশিংটনের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছিল সিডনিকে। শোনা যায়, ষড়যন্ত্রও চলেছিল। বেকায়দায় পড়তে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকে। গবেষণার প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাঠানো বন্ধ করে দেয় আমেরিকা।

এক সুইস সংস্থার সিইও সেভেরিন শোয়ানের কথায়, ‘বিদেশিদের দেব না, প্রতিষেধক শুধু দেশের মধ্যেই থাকবে… রাষ্ট্রনেতাদের এই প্রলোভনে পা দেওয়া উচিত নয় কখনো। তাতে সমূহ বিপদ। বিদেশি রাষ্ট্রগুলো প্রয়োজনীয় সামগ্রী রপ্তানি বন্ধ করে দেয়।’

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পরমাণু বোমা তৈরি নিয়ে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘এত মাথা খাটিয়ে পরমাণুর গঠন আবিষ্কার হয়ে গেল, কিন্তু সেই পরমাণুকে রাজনৈতিক অস্ত্র হওয়া থেকে আটকানো গেল না কেন?’ জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘পদার্থবিদ্যার থেকে অনেক বেশি জটিল রাজনীতি।’

সেই রাজনীতি কিন্তু এখনো অব্যাহত আছে। সার্স বা ইবোলা নিয়ে গবেষণা বেশিদূর এগোয়নি। কারণ? টাকার অভাব। আরেকটি বিষয় ছিল ওই ভাইরাসগুলো শক্তিমান দেশগুলোকে সেভাবে আঘাত করেনি। করোনা ভাইরাস বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবন ও অর্থনীতিতে প্রচ- আঘাত করেছে। এর ক্ষেত্রে টাকার অভাব হবে না বলেই আশা করা যায়।

অবশ্য পেটেন্ট পাওয়ার রাজনীতির পাশাপাশি পৃথিবীতে যে কোনো রোগের ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময়েরও প্রয়োজন হয়ে থাকে। অতীতে এমনটাই দেখা গেছে। কিছু ক্ষেত্রে লেগে গেছে দশকের পর দশক। ঠিক এই কারণেই নতুন করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি প্রসঙ্গে ওপরের দুটি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ইবোলা ভ্যাকসিনের কথা বলা যেতে পারে। ১৯৭৬ সাল থেকে এই রোগের বিষয়ে স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন সংস্থা ও বিজ্ঞানীরা ওয়াকিবহাল। ২০১৪ সালে এই রোগ পশ্চিম আফ্রিকায় মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। মহামারী চলার সময় থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন বায়োটেক প্রতিষ্ঠান ইবোলার ভ্যাকসিন তৈরির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দীর্ঘদিনের চেষ্টার পর অবশেষে ২০১৯ সালের নভেম্বরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ইবোলার একটি পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিনকে ব্যবহারের উপযোগী বলে স্বীকৃতি দিয়েছে।

মূলত ভ্যাকসিন তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটিই অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ। নানান ধাপ পেরিয়ে ধীরে ধীরে একটি ভ্যাকসিন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। এসব ধাপের মধ্যে রয়েছে ভ্যাকসিন আবিষ্কার থেকে শুরু করে প্রাণীর দেহে তার সফল পরীক্ষা পর্যন্ত একটি বিশাল চক্র। ধাপে ধাপে আছে অনুমোদন পাওয়ার মতো কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা। সব পার হওয়ার পর থাকছে তৈরি করা ভ্যাকসিন বাজারজাত করা ও তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টিও। এসব প্রক্রিয়া পার হতেই লেগে যায় বছরের পর বছর।

ভ্যাকসিনটি তৈরি হয়ে গেল এবং প্রয়োজনীয় সব অনুমোদনও পেল। কিন্তু এর পর সেই ভ্যাকসিনটির ব্যাপক উৎপাদন ও মহামারী ঠেকাতে তার ব্যবহার অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। প্রচুর পরিমাণে ভ্যাকসিন তৈরির জন্য বিশাল কারখানার প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে ব্যাপক হারে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের দামও নাগালের মধ্যে রাখার বাধ্যবাধকতা থাকে। যদিও এ ধরনের ভ্যাকসিনের উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারলে, তা যে কোনো ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য সুনাম বয়ে আনে। কিন্তু এ ধরনের ভ্যাকসিন উৎপাদনে লাভের অঙ্ক খুব কম থাকে। আবার প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন এবং তা আক্রান্ত সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়া এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। অনেক ক্ষেত্রে এতে রাজনীতিও ঢুকে পড়ে এবং বিভিন্ন দেশের সরকার তাতে নাক গলানোর চেষ্টা করে থাকে। ফলে রোগ ঠেকানো ও মানুষের জীবন বাঁচানো কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ে।

পুঁজিবাদী দেশগুলোর স্বার্থচিন্তা, মুনাফার লোভ, প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রতার পরও আজকে যক্ষ্মা, গুটিবসন্ত, চিকেন পক্স, মাম্পস, হাম, ফ্লু, পোলিওÑ এমন অনেক মহামারী থেকে রক্ষার ওষুধ আমরা পেয়েছি। খুব শিগগির করোনা ভাইরাসের একটি কার্যকর ভ্যাকসিনও আমরা পাব, সেটাই এখন মানবজাতির আশা।

চিররঞ্জন সরকার : কলাম লেখক

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com