প্রত্যেক ঋতুর আগমনে বাংলাদেশের প্রকৃতি নবনব সাজে সজ্জিত হয়৷ গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত্, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত-এ ছয় ঋতুতে প্রকৃতি সাজে ছয় রকম৷ হেমন্তের কুহেলী গুঞ্জন, শীতের শীর্ণ নদী ও কুয়াশার নেকাব আর বসন্তের দখিনা মৃদুমন্দ বাতাস, গ্রীষ্মের দুঃসহ দহন, বর্ষার মুষলধারে বৃষ্টি, শরতের কাশফুল ষড়ঋতুরই অবদান৷ শরতের শেষ প্রহর থেকেই বাতাসে মৃদু গুঞ্জন তোলে হেমন্তের রৌদ্রাঙ্কিত মোহনীয় নিবিড় তরঙ্গ৷ সবুজ-শ্যামল জমিনে এখন শোভা পাচ্ছে সোনালি বর্ণের উজ্জ্বলতর হেমন্তের আলোক রেখা৷ ধান ও ঘাসের ডগায় আলগোছে পা ফেলে নামছে কুয়াশা৷ প্রকৃতিতে শীতের আগমনি বার্তা বয়ে নিয়ে এসেছে হেমন্ত৷ শিশির বিন্দু ঝরার টুপটাপ শব্দ আর মৃদু শীতলতা জানান দিচ্ছে ঋতু পরিবর্তনের খবর৷ এভাবেই প্রকৃতিতে হেমন্তের গহন উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়, হয় অনুভূত৷ রৌদ্রোজ্জ্বল আভার প্রকৃতি মানেই হেমন্ত৷ হেমন্তকে বলা হয় বিচিত্র রঙের ঋতু৷ কার্তিক ও অগ্রহায়ণ দুই মাস হেমন্তকাল৷ শিশিরস্নাত সকাল, কাঁচাসোনা রোদমাখা স্নিগ্ধসৌম্য দুপুর, পাখির কলকাকলি ভরা ভেজা সন্ধ্যা আর মেঘমুক্ত আকাশে জোছনা ডুবানো আলোকিত রাত হেমন্তকালকে যেন আরও রহস্যময় করে তোলে সবার চোখে; প্রকৃতিতে এনে দেয় ভিন্নমাত্রা৷ হেমন্তের এ মৌনতাকে ছাপিয়ে বাংলার মানুষের জীবনে নবান্ন প্রবেশ করে জাগরণের গান হয়ে, মানুষের জীবনে এনে দেয় সর্বজনীন উত্সবের ছোঁয়া৷ হেমন্তক বলা হয় বিচিত্র রঙের ঋতু৷ হেমন্তের শিশিরঝরা নিশিতে ফোটে গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি আর কামিনী৷ হেমন্তেই দিঘির জলে, বিলে, ঝিলে ফোটে কত না রঙের পদ্ম৷ হেমন্তের চরিত্র আর তার বাইরের রূপ নিয়ে জগত্জুড়ে সৃষ্টি হয়েছে শত শত গল্প, শিল্প, গান ও কবিতা৷ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লিকবি জসীমউদদীন, জীবনানন্দ দাশ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে কবি আল মাহমুদসহ পরবর্তীকালের অনেক কবিই লিখেছেন এ হেমন্তকে নিয়ে৷
অসাধারণ সৌন্দর্যচেতনায় ভাবুক হৃদয়ের বিলাসিতায় এ ঋতুকে নিজের প্রিয়তমারূপে কল্পনা করেছিলেন বিখ্যাত ইংরেজ কবি জর্জ এলিয়ট৷ বলেছিলেন- ‘হে অপরূপা সুন্দরী ঋতু হেমন্ত/তোমার সঙ্গে আমার অন্তরাত্মা এখন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ/যদি ডানাওয়ালা পাখির মতো পৃথিবীজুড়ে উড়ে বেড়াতে পারতাম/তোমার মনোলোভা রূপের এ সৌন্দর্যের বিস্তারে, তাহলে উপভোগ করতাম সর্বত্র৷’ ‘অঘ্রারে সওগাত’ কবিতায় হেমতের আগমনি, এর প্রকৃতি ও স্বভাবের এক চঞ্চলরূপ এঁকেছেন কাজী নজরুল ইসলাম৷ হেমন্ত নিয়ে কবি লেখেন-‘চাঁদের প্রদীপ জ্বালাইয়া নিশি জাগিছে একা নিশীথ/নতুনের পথ চেয়ে চেয়ে হলো হরিত পাতারা পীত৷’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখেন-‘হিমের রা েওই গগনের দীপগুলিরে/ হেমন্তিকা করল গোপন অাঁচল ঘিরে/ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো/জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে৷’
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি আল মাহমুরে কবিতায় হেমন্ত এসেছে মানুষের প্রেমে-কামে প্রকৃতির সৌন্দর্যে৷ তার কাছে হেমন্ত একধরনের পরিপূর্ণতার নাম৷ ‘আঘ্রাণ’ কবিতায় লিখেছেন-‘আজ এই হেমতের জলদ বাতাসে/আমার হৃদয় মন মানষীর গন্ধে ভরে গেছে/রমণীর প্রেম আর লবণ সৌরভে/আমার অহংবোধ ব্যর্থ আত্মতুষ্টির ওপর/বসায় মর্চের দাগ, লাল কালো/কটু ও কষায়৷’ কবি রবীন্দ্রনাথ লেখেছিলেন-‘তোমার অশ্রুজরে করুণ রাগে, যাও, যাও গো এবার যাবার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাও৷’
হেমতের অন্য নাম নবান্ন৷ এক সময় বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে৷ কারণ ধান উত্পাদনের ঋতু হলো এ হেমন্ত৷ নবান্ন মানেই চারদিকে পাকা ধানের ম-ম গন্ধ, নতুন অন্ন, গ্রামের মাঠে মাঠে চলে ধান কাটার ধুম, হেমন্তে এ ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই ঘরে ঘরে শুরু হয় নবান্ন উত্সব৷ গৃহস্থবাড়িতে নতুন ধানে তৈরি পিঠাপুলির সুগন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়৷ বর্ষার শেষ দিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে ওঠে৷ আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে ধান পরিপক্ব হয়৷ নতুন ধানের আগমনে কৃষকের গলায় ধরে আনন্দের গান৷ আর ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই নবান্ন উত্সবের সূচনা৷ বলা যায়, হেমন্ত বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্যোত্সব৷