বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। হাজার বছরব্যাপী মানুষের খাদ্যতালিকার প্রধান উপাদান এই শর্করাসমৃদ্ধ খাবার। আমরাও ভেতো বাঙালি। জুঁইফুলের মতো সাদা, তাও আবার গরম ভাপ বেরোচ্ছেÑ এমন ভাত আমাদের প্রিয় ও প্রধান খাদ্য। বিশ্বে প্রায় এক লাখ দশ হাজার প্রজাতির চাল রয়েছে। মূলত কলে আর ঢেঁকিতে তৈরি হয় এসব চাল। কলে যখন ধান ভাঙানো হয়, তখন চাল হয় মসৃণ। কুঁড়া চাল থেকে ওপরের আবরণ বের হয়ে যাওয়ায় চাল হয় চকচকে পলিসড। কলে ভাঙানো এ চাল সভ্যতার নতুন সংযোজন। বিগত শতাব্দীর সত্তরের দশকের আগে কলের চালের ব্যবহার ছিল না বললেই চলে।
ঢেঁকিছাঁটা চালের শ্রেষ্ঠত্ব : কলে ভাঙালে চাল থেকে বের হয়ে যায় শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু খাদ্য উপাদান। এর মধ্যে রয়েছে ভিটামিন-বি, খনিজ লবণ, বায়োটিন, আমিষ, চর্বি, ফাইটো কেমিক্যাল ও ফাইবার। চলে যায় আয়রন, জিঙ্ক, ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন-এ এবং ই। কলে ভাঙানো চালের ভাত খেলে এসব উপাদানের অভাব হওয়া তাই স্বাভাবিক ঘটনা। এক কাপ ঢেঁকিছাঁটা চালে ৭৮ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম থাকে। এর বিপরীতে কলে ভাঙানো চালে থাকে মোটে ১৯ মিলিগ্রাম। পটাসিয়াম থাকে ১৭৪ মিলিগ্রাম আর কলের চালে ৫৫ মিলিগ্রাম। ঢেঁকিছাঁটা চালে ৩ গ্রাম ফাইবারের বিপরীতে কলের চালে ফাইবার একেবারে নেই বললেই চলে। এক কাপ ভাতে আমাদের দৈনন্দিন চাহিদার শতকরা ৮০ ভাগ ম্যাঙ্গানিজ থাকে। ম্যাঙ্গানিজ আমাদের স্নায়ু এবং প্রজননতন্ত্রের কার্যক্রমে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ঢেঁকিছাঁটা চালে সেলেনিয়াম নামক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিদ্যমান, যা হৃদরোগ, কর্কটরোগ এবং বাতের ঝুঁকি কমায়। তাই ঢেঁকিছাঁটা চালের শ্রেষ্ঠত্ব তো প্রমাণিত। আর বলাই বাহুল্য, এসব ফাইবার, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান।
কলে ভাঙানো চালে ডায়াবেটিস : কলে ভাঙানো চালের ভাতের সঙ্গে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের যোগসূত্র রয়েছে। ডায়াবেটিক কেয়ার নামক বিখ্যাত জার্নালের এক গবেষণা প্রকাশ হয়েছে ২০২০ সালে। সেখানে ২১টি দেশের এক লাখ ত্রিশ হাজার মানুষের ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখানো হয়েছে, কলের চালের ভাত ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। অতিরিক্ত ভাত খাওয়ার পর রক্তে হু হু করে বেড়ে যায় চিনির মাত্রা। সঙ্গে বেড়ে যায় ইনসুলিনের চাহিদা। এভাবে চলতে থাকলে এক পর্যায়ে আমাদের অগ্ন্যাশয় হয়ে পড়ে ক্লান্ত, বিপর্যস্ত। সামাল দিতে পারে না অতিরিক্ত চিনির মাত্রা। তখন শরীরে দানা বাঁধে ডায়াবেটিস। ঢেঁকিছাঁটা চালে এমন কিছু উপাদান রয়েছে, যা হৃদরোগ ও ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে পারে কিন্তু কলের চাল তা মোটেও পারে না।
পান্তাভাতের মাহাত্ম্য : গবেষণায় দেখা গেছে, গরম ভাত ঠা-া করে রাখার পর এর মধ্যে একটি উপাদান তৈরি হয়, যাকে বলা যায় রেজিস্ট্যান্স শ্বেতসার। এসব শ্বেতসার খাওয়ার একটি সুফল হচ্ছে, এটি যখন অন্ত্রে প্রবেশ করে, তখন ফাইবারের মতো কম শোষিত হয়। ফলে বৃহদন্ত্রে এটি গাঁজন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। এতে শরীরে চর্বির ব্যবহার জ্বালানি হিসেবে বেড়ে যায়। এ কারণে সদ্য রান্না করা গরম ভাপ ওঠা ভাতের চেয়ে আট-দশ ঘণ্টা রেখে ঠা-া ভাত গরম করে খাওয়া ভালো।
উপসংহার : তবে মনে রাখা দরকার, কোনো খাদ্যই এককভাবে শরীর ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ভাঙতে বা গড়তে পারে না। আমাদের শর্করার প্রধান উৎস এই ভাত খেয়েই বাঁচতে হবে। তবে এই ভাত থেকে কী করে আরও বেশি স্বাস্থ্য রক্ষার উপযোগী উপাদান পেতে পারি, সেটা অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। আর সে কারণেই হয়তো আবার আমাদের ফিরতে হবে ঢেঁকিছাঁটা চালের কাছে।
লেখক : ক্লাসিফাইড মেডিসিন স্পেশালিস্ট ও এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট; সহযোগী অধ্যাপক, সিএমএইচ, ঢাকা। ০১৮১৯০৮৬৫০৫