সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পূর্বাহ্ন

বিএনপি রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা

মো: হারুন-অর-রশিদ
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০২২
  • ৩৫২ বার

বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আলোচনার রসদ প্রধানত দু’টি দল ঘিরে হয়ে থাকে। আওয়ামী লীগ পুরনো একটি রাজনৈতিক দল। বয়সের হিসেবে ৭২ বছর। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি এবং শামছুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়। দলের নামের সঙ্গে মুসলিম শব্দটি থাকায় পরবর্তীতে কেউ কেউ আপত্তি করেছিলেন। একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল গঠনের লক্ষ্যে মওলানা ভাসানী মুসলিম শব্দটি বাদ দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুসলিম শব্দটি থাকার পক্ষেই সমর্থন দিয়েছিলেন। কারণ হিসেবে তিনি মনে করেছিলেন ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিলে পশ্চিম পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা কমে যেতে পারে।

মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৫৫ সালে সংগঠনটির নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে নাম রাখা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। রাজনৈতিক দল হিসেবে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত অনেক আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে। যেসব আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়। একইভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানের কথা ছিল রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতাদের। ২৫ মার্চ যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দেশের নিরীহ, নিরস্ত্র, ঘুমন্ত মানুষের ওপর ‘অপারেশন সার্চ লাইটের’ নামে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালাল তখন দিশেহারা মানুষদের দিকনির্দেশনা দিতে তারা ব্যর্থ হয়েছিলেন। ওই সময় জনগণ শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর ভরসা করলেও তিনি গ্রেফতার হন এবং পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকেন। এ সময় পূর্বপাকিস্তানে এক ধরনের রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্যতা বিরাজ করছিল। সময়ের এ কঠিন মুহূর্তে দিশেহারা জাতিকে দিকের সন্ধান দিয়েছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। তিনি ২৬ মার্চের রাতে প্রথমে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন, তারপর প্রথমে নিজের নামে পরে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে জাতিকে স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করলেন। মূলত এ সময় থেকেই ‘জিয়াউর রহমান’ নামটি সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের কাছে কাণ্ডারি হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পায়। সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে তিনি ‘জেড ফোর্স’ এর অধিনায়কও ছিলেন। গবেষক মহিউদ্দীন আহমদের ভাষায় মূলত এই সময় থেকেই বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটির বীজ রোপিত হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সামাজিক ন্যায়বিচার। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই এগুলো ধুলায় মিশতে শুরু করল। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলেও সেই নির্বাচন কলঙ্কমুক্ত ছিল না। আওয়ামী লীগের শাসনকার্যে তখন জনগণ খুব একটা সন্তুষ্ট ছিল না।

আওয়ামী লীগের এত অল্প সময়ের শাসনকালে জনগণ যে বিতৃষ্ণ ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় কিছু দিন পরে অনুষ্ঠিত চারটি উপনির্বাচনে যেখানে দুটিতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরাজিত হয়েছিলেন। তারপরও সেই সময়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে একমাত্র আওয়ামী লীগই ছিল সংগঠিত। সব শ্রেণীর মানুষের কাছে আশা আকাক্সক্ষার প্রতীক। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান অল্প দিনের ব্যবধানেই দল হিসেবে আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে একমাত্র দল ‘বাকশাল’ কায়েম করলেন। যা ছিল স্বাধীনতার চেতনার বুকে প্রথম কুঠারাঘাত। যে দল, যে নেতার কাছে মানুষের চাওয়া পাওয়ার অনেক কিছুই ছিল, যার হাতে গণতন্ত্রের মশাল রেখে জনগণ নিশ্চিন্তে থাকতে চেয়েছিলেন তার হাত দিয়েই গণতন্ত্রের নির্বাসন, জনগণ মেনে নিতে পারেনি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান অবশেষে সিপাহি জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হন জিয়াউর রহমান। তিনি এসেই বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন করেন। বাকস্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে জিয়াউর রহমান দেশকে একটি সমৃদ্ধির পথ দেখাতে সক্ষম হন। জিয়াউর রহমানের শাসনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল ১৯ দফা কর্মসূচি। এই কর্মসূচির মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিভিন্ন দিক অন্তর্ভুক্ত ছিল। মূলত তার এ কর্মসূচি ছিল ‘উন্নয়নমুখী রাজনীতির’ অংশ। ১৯ দফা কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল-কৃষি উৎপাদন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, ব্যক্তি খাতে শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিকাশ। খাল খনন কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব সংঘটিত করেছিলেন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান।

জিয়াউর রহমানের আরেকটি সফলতা হলো তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, বাংলাদেশে বহুসংখ্যক বিভিন্ন মতের ও ধর্মের জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে। তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার মাত্রা ও ধরন বিভিন্ন। তাই শুধু ভাষা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে নয়, বরং ভূখণ্ডের ভিত্তিতেই জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করা উচিত।

ক্ষমতায় থাকাকালীন জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। জিয়াউর রহমানের উন্নয়নমুখী রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি এ দেশের মানুষের কাছে খুবই প্রশংসনীয় হয়। তারই শাসনকালে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং কূটনীতিতে মৌলিক বাঁক বদল ঘটে। বাংলাদেশের রাজনীতির ভাগ্যাকাশ প্রভুর কবল থেকে মুক্তি পায়নি কখনো। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের তথা পূর্ব বাংলার জনগণের স্বার্থবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছিল। এ অবস্থানের দ্বান্দ্বিক পরিণতিতে পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ দানা বাঁধতে থাকে এবং পরিশেষে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। এর পরিণতিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষমতার ক্রীড়নক পিন্ডির পরিবর্তে দিল্লির কবলে চলে যায়। এর ফলে নতুন মাত্রায় জাতীয় দ্বন্দ্বের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এ দ্বন্দ্বকে ভিত্তি করেই বাংলাদেশে আধিপত্যবাদবিরোধী চিন্তা-চেতনা দানা বাঁধতে থাকে। সব আধিপত্যবাদের বলয় থেকে দেশকে মুক্ত করে মাথা উঁচু করে বিশ্বদরবারে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রত্যয় নিয়ে জিয়াউর রহমান বিএনপি সৃষ্টি করেছিলেন। সুতরাং বিএনপি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব মজবুত করতে চায়, এমন আস্থা জনগণের একটি বড় অংশের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।

কিন্তু জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে বিএনপির কিছু নেতা দল ছেড়ে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন, নিছক ক্ষমতালিপ্সার কারণে। এর ফলে সাংগঠনিকভাবে বিএনপি নাজুক দশায় পড়ে যায়। এ সময় দলটির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন সদ্য স্বামীহারা বেগম খালেদা জিয়া। তার কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু সহজাত প্রবৃত্তিতে তিনিও ছিলেন জাতীয়তাবাদী এবং আধিপত্যবাদবিরোধী। বাংলাদেশের মানুষ তার মোহিনী নেতৃত্বে মুগ্ধ হয়েছিল। বিএনপি পরিণত হলো জাতীয়তাবাদী ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জনগণের একটি প্লাটফর্মে। এ প্লাটফর্ম ব্যবহার করেই বেগম খালেদা জিয়া এরশাদের বিরুদ্ধে লড়াই করলেন আপসহীনভাবে। তার আপসহীনতা জনমনে গভীর আস্থার সৃষ্টি করেছিল। তার আপসহীন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ১৯৯০ সালের নভেম্বর মাসে স্বৈরাচার এরশাদের পতন ঘটেছিল।

১৯৯১ সালে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল। অথচ ওই সময় তার সংগঠনটি ছিল খুবই অগোছালো। অন্যদিকে এরশাদের পতনের সময় আওয়ামী লীগ ছিল বেশ সংগঠিত। বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের একটি বড় অংশ আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। এই নির্বাচনী প্রচারণার সময় বেগম খালেদা জিয়ার কিছু ঐতিহাসিক উক্তি জনগণকে বিএনপির পক্ষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে অনুপ্রাণিত করেছিল। বেগম খালেদা জিয়া নজিরবিহীন দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘ওদের হাতে গোলামির জিঞ্জির, আর আমাদের হাতে মুক্তির পতাকা।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘সীমান্তের বাইরে বাংলাদেশের বন্ধু আছে, প্রভু নেই।’ এসব উক্তি জাতির মধ্যে সঞ্জীবনী শক্তির জন্ম দিয়েছিল।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পরাজিত হলেও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। ২০০৬ সালে বিএনপির ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হলে রাজনৈতিক দলগুলোর অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে ক্ষমতা চলে যায় ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দীন চক্রের হাতে। তারা অবৈধভাবে প্রায় দুই বছর রাষ্ট্রপরিচালনার পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। রাষ্ট্র মূলত এই সময় থেকেই একটি বিপদময় গর্তের মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। যার ফল ছিল ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন এবং ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে দখল করে তামাশার নির্বাচন। এই দুই সময়ে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম আমাদের দেশের ওপর প্রভুত্ব বিস্তারে পিন্ডির চেয়ে দিল্লি কতটা বেশি তৎপর।

বিএনপি মনে করে, দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে আনুকূল্য নয়, বন্ধুত্ব হবে সমতা ও জাতীয় স্বার্থকে রক্ষা করে। এটাই জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রাণশক্তি। একটি রাজনৈতিক দলের জন্য গণতান্ত্রিক বিশ্বে প্রাণশক্তির উৎস হলো জনগণ এবং জনগণের প্র্রাণোচ্ছল অংশগ্রহণ। রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবহার করে মসনদ দখলের খায়েশ বেগম খালেদা জিয়ার ছিল না বলেই বিএনপি আজ বেকায়দায় আছে। তবে একটি কথা না বললেই নয়; এই সময়ে বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আরো দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারলেই ভালো হতো। দলটি যদি সাংগঠনিক ও মতাদর্শিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করতে পারত, তাহলে বিএনপিকে এত সহজে ধরাশায়ী করা যেত না। আজ দেশনেত্রী খালেদা জিয়া জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দিচ্ছে না সরকার। জনমতের অভাব নেই কিন্তু কৌশল ও সাংগঠনিক দুর্বলতা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া দেখাতে বিএনপি ব্যর্থ হচ্ছে।

পরিশেষে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের ভাষায় বলতে হচ্ছে, ‘নির্বাচন কমিশন এখন আইসিইউতে আর তার পাশর্^প্রতিক্রিয়ায় গণতন্ত্র লাইফ সাপোর্টে।’ এ অবস্থা থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে বিএনপির রাজনীতির যেমন অপরিহার্যতা রয়েছে তেমনি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য বিএনপিকে শক্তি সামর্থ্য নিয়ে মাঠে ফিরে আসা ততটাই আবশ্যক হয়ে পড়েছে।

harun_980@yahoo.com

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com