রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫২ অপরাহ্ন

প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে হবে

আবু আহমেদ
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ১০ এপ্রিল, ২০২২
  • ২৬০ বার

শ্রীলঙ্কায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবন এখন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। মানুষকে দিনের অর্ধেক সময় বিদ্যুত্হীন থাকতে হয়। জ্বালানি তেলসহ আবশ্যক পণ্য আমদানি করার মতো বৈদেশিক মুদ্রা দেশটির নেই।

 

বিজ্ঞাপন

স্থানীয় মুদ্রার মানের মারাত্মক অবনতি হচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশটির অর্থনীতির চাকা প্রায় থমকে গেছে। পাকিস্তানের অবস্থাও শ্রীলঙ্কা থেকে খুব ভালো নয়। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে কমতে দুই বিলিয়ন ডলারে এসে ঠেকেছে। পাকিস্তানের রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের মতো। একসময় শ্রীলঙ্কা এই অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অর্থনীতির দেশ ছিল। মাত্র ১০-১৫ বছর আগের কথা এটা। শিক্ষায় দেশটি এই অঞ্চলে এগিয়ে ছিল এবং ট্যাক্সিচালক থেকে শুরু করে বেশির ভাগ মানুষ ইংরেজি ভাষা জানে। তাদের পর্যটনশিল্প রমরমা ছিল। সব কিছু মিলিয়ে শ্রীলঙ্কার অবস্থা খুবই ভালো ছিল। কিন্তু সেই শ্রীলঙ্কার আজকের পরিণতির জন্য একটাই কারণ, সেটা হচ্ছে সাধ্যের বাইরে গিয়ে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি করা।

 

সরকারি ব্যয় যখন সাধ্যের বাইরে গিয়ে ঘটবে, তখন বেশি বেশি ঋণ নেওয়া হবে—এটাই স্বাভাবিক। এ জন্য শ্রীলঙ্কা সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট থেকে, এআইএমএফ থেকে, বিশ্বব্যাংক থেকে, দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় নানা উৎস থেকে ঋণ নিয়েছে। এভাবে ঋণ নিতে নিতে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে এখন তাদের জিডিপির বেশির ভাগ ঋণের সুদ ও কিস্তি দিতে চলে যায়। এখন দেশটির যে সংকট, সেটা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটের কারণেই হয়েছে। শ্রীলঙ্কার খাদের কিনারে আসার পেছনে এটাই কারণ।

kalerkanthoপাকিস্তানও শ্রীলঙ্কার মতো বহুদিন ধরে ঋণ করে ঘি খেয়েছে, এখনো খাচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তানের ভিন্নতা হচ্ছে, এখনো তাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ ভালো এবং অনেক দেশ আছে তাদের এখনো ঋণ দেয়। সে জন্য তারা অতটা সংকটে পড়েনি। পাকিস্তানের বর্তমান খারাপ অবস্থার জন্য আগের সরকারগুলো, এ সরকার নয়। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারই কেবল দায়ী নয়, গত ১০ বছরের ধারাবাহিকতায়ই আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতিটা এক দিনে তৈরি হয়নি।

এখন শ্রীলঙ্কায় যতই সরকার বদল করুক, খুব বেশি লাভ হবে না। কারণ তাদের হাতে কোনো ম্যাজিক নেই যে কিছু একটা করে ফেলবে। মন্ত্রীদের সবাই পদত্যাগ করেছেন। হয়তো প্রেসিডেন্টও পদত্যাগ করবেন। কিন্তু সমাধান খুব বেশি কিছু আসবে বলে মনে হয় না। জনগণকে দুঃখের মধ্য দিয়ে পার হতে হবে। এটা তাদের সরকারের একটা ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হবে।

এই প্রেক্ষাপটে আমি বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলতে চাই। বাংলাদেশের ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। আমাদের ঋণ তখন একেবারেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য ছিল। জিডিপির তুলনায় ঋণ খুব বেশি ছিল না। আমরা বরং প্রত্যাশিত মাত্রা থেকে কমের মধ্যে ছিলাম। কিন্তু গত দুই বছরে বাংলাদেশ অনেক বেশি ঋণ করে ফেলেছে এবং এখনো সমানে করছে। চলতি অর্থবছরে সম্ভবত এক লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি এক বিশাল ঋণ করছে সরকার। কিছু মেগাপ্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলে এই ঋণগুলো আসছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রকল্পের কোনোটা হয় তো আমরা যথেষ্ট স্ট্যাডি করে নিইনি। কোনোটা নিয়েছি দরকার আছে বলেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমাদের কোট সেলাই করতে হবে আমাদের সক্ষমতার মধ্য থেকে। যেমন—রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র। এটার ব্যয় হচ্ছে এক লাখ কোটি টাকা। এটা থেকে আমরা যে বিদ্যুৎ পাব, অন্যান্য মাধ্যম থেকে পাওয়া বিদ্যুতের তুলনায় তার খরচ অনেক বেশি। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় আমরা কি শুধু সম্মানের জন্য, প্রেসটিজের জন্য করছি কি না। যদিও সেখান থেকে আমাদের আর সরে আসার সুযোগ নেই।

মেগাপ্রকল্পের একটা অসুবিধা হচ্ছে যে এগুলোর মেগা-মিসইউজ (বড় অনিয়ম) হয়। প্রকল্প ব্যয় বাড়তে থাকে, সময়ের মধ্যে শেষ হয় না। যে প্রকল্পের জন্য যে বাজেট বা বরাদ্দ ধরা হয়, পরে সে প্রকল্পেই তার থেকে দ্বিগুণ বা তিন গুণ খরচ করতে হয়। বাংলাদেশে এটা নিয়মিতই হচ্ছে। সড়ক ও জনপথে এমন অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যেখানে এই অনিয়মগুলোও হয়েছে। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। আমাদের অন্যান্য মেগাপ্রকল্পেও তাই হচ্ছে, আমরা যে সময়ের মধ্যে, যে টাকার মধ্যে বাজেট করেছি, সেটা না হয়ে তার থেকে দ্বিগুণ বা তার চেয়ে বেশি খরচ হয়েছে। কারণ সময়ের মধ্যে আমরা প্রকল্পের কাজটা করতে পারিনি।

এসব প্রকল্পে বিদেশিরা আমাদের ঋণ দিচ্ছে কেন? এর কারণ হচ্ছে ঋণ পরিশোধ করার ভালো সক্ষমতা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার নিজার্ভ এখন ৪৬ বিলিয়ন ডলার। এটা তারা খুব ভালো করে দেখে। যারা ঋণ বিক্রেতা, তারা খুব ভালো করেই দেখে একটা দেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কতটুকু। বিশ্বের যেসব দেশ ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতার দিক থেকে ওপরের দিকে, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। সে জন্য বিশ্বব্যাংক ঋণ দিতে আগ্রহী, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও দিতে আগ্রহী। আইএমএফের কাছে চাইলেই দেবে। আর দ্বিপক্ষীয়, ত্রিপক্ষীয় উৎস হিসেবে কেউ ক্রেডিট লাইন দিচ্ছে, কেউ সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটে ঋণ দিচ্ছে, এ জন্য ঋণদাতারা খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে।

এ অবস্থায় আমাদের সরকারকে খুব চিন্তা-ভাবনা করে বৈদেশিক ঋণ নিতে হবে। আরেকটা কথা এখানে বলা ভালো। আমাদের যদি রিজার্ভ কমতে থাকে, তাহলে আমাদের মূল্যস্ফীতি বাড়বে। মূল্যস্ফীতি বাড়লে ডলারের দামও বাড়বে। তখন এক্সচেঞ্জ রেট আমাদের বিপক্ষে যাবে। তখন ঋণ ফেরত দেওয়া আরো কঠিন হবে। আমাদের ওপর তখন আরো বোঝা আসবে। সুতরাং বাংলাদেশের অবশ্যই চিন্তা-ভাবনা করা উচিত যে ঋণ চাইলে পাওয়া যাবে সেটা ঠিক আছে। যেকোনো প্রকল্পের ব্যয় সুবিধা বিশ্লেষণ (কস্ট-বেনিফিট অ্যানালিসিস) করে ঋণ নিতে হবে। মানে, আমরা একটি মেগাপ্রকল্পে অর্থ ব্যয় করে কী সুবিধা পাব সেটা চিন্তা করতে হবে। কিন্তু যেভাবে মেগাপ্রকল্প নেওয়া হচ্ছে এবং এর বিপরীতে ঋণ নেওয়া হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে ব্যয় সুবিধা বিশ্লেষণ করা হয়েছে কি না সে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। কারণ এই বিশ্লেষণ ছাড়াই যদি আমরা বৈদেশিক এক্সচেঞ্জে ঋণ নিতে থাকি, সেটার বোঝা অনেক বেশি।

এখন শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তান তাদের বাজেট থেকে কিছু করতে পারছে না। কারণ তাদের বাজেটের ৮০ শতাংশই চলে যাচ্ছে তাদের ঋণের সুদ ও কিস্তি পরিশোধ করতে। তারা একটা ঋণ নিচ্ছে আরেকটা ঋণ দেওয়ার জন্য। নতুন ঋণ নিচ্ছে পুরনো ঋণ শোধ করার জন্য। আমরা আশা করি, বাংলাদেশ যেন ওই ফাঁদের মধ্যে না পড়ে। এই দুই বছরে বাংলাদেশ যে ঋণ নিয়েছে সেটা প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। এ জন্য বাংলাদেশের এসব জিনিস খোলাখুলিভাবে আলোচনা হওয়া উচিত, যেটা হচ্ছে না এখন। আমরা যদি কাপড় অনুযায়ী কোট সেলাই না করি, তাহলে শেষ পর্যন্ত দেশের জনগণকেই মূল্য দিতে হবে, যেটা এখন শ্রীলঙ্কার জনগণ দিচ্ছে। তখন পরিবর্তন বা সমন্বয় করেও কোনো লাভ হবে না।

আমি মনে করি, এই পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এখন থেকে আমাদের দুটি বড় প্রতিষ্ঠান অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক চিন্তা-ভাবনা করে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। একই সঙ্গে সরকারের উচ্চ মহলও সেটা ভাববে। উদ্বেগের বিষয়ে সবারই অবগত হওয়া উচিত।

শ্রীলঙ্কা থেকে আমাদের অনেক কিছু শিক্ষার সুযোগ আছে। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি আমাদের থেকে ওপরে ছিল। মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে সেটা আমাদের থেকে নিচে চলে গেছে। ভুল ব্যবস্থাপনা, লুটপাট, স্বজনপ্রীতি, স্বজন-তোষণ, অর্থপাচার—এ সবই যোগ হয়েছে দেশটির অর্থনীতিতে। যখন অর্থনীতি নিচের দিকে ডুবতে থাকে, তখন এসব জিনিস দেখা দেয়। স্বজন-তোষণ হয়, দুর্নীতি বেড়ে যায় এবং অর্থপাচার বাড়তে থাকে। কারণ অর্থনীতির ওপর থেকে অনেক মানুষ তখন বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। আমাদের অর্থনীতির ওপর জনগণ যত দিন বিশ্বাস রাখবে, তত দিন আমাদের অর্থনীতি ইনশাআল্লাহ এগোতে থাকবে।

এ জন্য আমি এখনো সরকারকে অনুরোধ করব, আপনারা বেশি বেশি ঘাটতি বাজেটের দিকে যাবেন না। বেশি বেশি বৈদেশিক ঋণের দিকে যাবেন না। বিচার-বিশ্লেষণ করে প্রকল্প গ্রহণ করুন। দরকার হলে আমরা আস্তে আস্তে এগোব। আমাদের অর্থনীতির ডিসিপ্লিনটা যেন বজায় থাকে। অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এই বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্য বিতর্কের সুযোগ দেওয়া উচিত। না হলে কায়েমি স্বার্থবাদী মহল নিজেদের সুযোগ সৃষ্টির জন্য অনেক কিছুই বলতে থাকবে, তৃতীয় পক্ষ দিয়ে বলাবে এবং অনেক কিছুই সরকার দিয়ে করিয়ে নিতে চেষ্টা করবে। কিন্তু এর সুবিধা জনগণ পাবে না, ওই কায়েমি স্বার্থবাদীরাই পাবে। অল্প কিছু লোক পাবে। আর তারাই অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত থাকে। তারাই হচ্ছে সেসব লোক, যারা অতি ধনী হওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকা ১ বা ০.৫ শতাংশ লোকেকর অংশ। তারাই সেকেন্ড হোম, থার্ড হোম, ফোর্থ হোম করে দেশে দেশে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভোগে জনগণ। এত দিন অর্থনীতি ভালোভাবেই ম্যানেজমেন্ট হয়ে আসছে। জাতির এই আস্থাটা যেন বজায় থাকে, সেদিকে সরকারকে নিবিড়ভাবে মনোযোগ দিতে হবে। একই সঙ্গে শ্রীলঙ্কার যে অধোগতি ও দুর্গতি সেটা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com