এ পৃথিবীতে যে মানুষেরই জন্ম হবে, তার বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। এর পাশাপাশি সে জন্মের সাথেই যে সব অধিকার, স্বাধীনতা ও দায়িত্ব-কর্তব্য এ পৃথিবীতে নিয়ে আসে, তার ওপর পরিপূর্ণ স্বাধীনতার অধিকারও সে সংরক্ষণ করে। যখনই মানবাধিকারের বিষয়ে কথা আসে, সেটা বংশ, বর্ণ, ধর্ম ও জাতির ভেদাভেদ থেকে ঊর্ধ্বে থেকে আলোচনা করা হয়। আর এটাই সর্বগ্রাহ্য নিয়ম। যদি আমরা এক মুহূর্তের জন্যও এই নিয়মনীতিকে উপেক্ষা করি, তাহলে এর স্পষ্ট অর্থ দাঁড়ায়, আমরা কোথাও না কোথাও এই নীতিকে পদদলিত করে বিদ্বেষের বশবর্তী হচ্ছি। ৭৪ বছর ধরে যেখানে কাশ্মির সঙ্কট ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, সেখানে বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র ও বিতর্কেরও শেকড় গজিয়ে উঠেছে। সম্প্রতি ভারতে ‘কাশ্মির ফাইলস’ নামে একটি সিনেমা রিলিজ করা হয়েছে।
কাশ্মির থেকে পণ্ডিতদের উচ্ছেদ ও তাদের হত্যাকে কেন্দ্র করে এই সিনেমা নির্মিত হয়েছে। এই সিনেমার প্রতি মোদি সরকারের শুধু পূর্ণ সমর্থনই নয়, বরং ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিশেষ সহায়তাও দেয়া হয়েছে। যেমন-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সিনেমা দেখার জন্য ফ্রি টিকিটের ব্যবস্থা, সিনেমা দেখার জন্য ছুটির ব্যবস্থা এবং সিনেমার ওপর ট্যাক্স ছাড়ের ব্যবস্থা যাতে করে এ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায় যে, বিপুল সংখ্যক ভারতীয় জনগণ এই সিনেমা অবশ্যই দেখবে, যে সিনেমা কাশ্মিরি মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও বিদ্বেষের ভিত্তিতে নির্মিত। সিনেমা রিলিজ হওয়ার পর শুধু ভারত নয়, বরং বিভিন্ন দেশের নামকরা ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে এই সিনেমাকে সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে বলা হয়েছে, ‘এই সিনেমায় কাশ্মিরের একপেশে কাহিনী উপস্থাপন করা হয়েছে।’ সেখানে কাশ্মিরি মুসলমানদের সাথে হওয়া জুলুম-অত্যাচারকে পরিকল্পিতভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে এ সিনেমার যে উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে দেখা যায়, তা হচ্ছে, এতে মুসলমানদের সন্ত্রাসী বানিয়ে উপস্থাপন করা, কাশ্মিরি পণ্ডিত ও কাশ্মিরি মুসলমানদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি ও বিদ্বেষকে আরো বেগবান করা এবং ভারতে হিন্দু উগ্রবাদীদের পক্ষ থেকে মুসলমানদের সাথে হওয়া জুলুম, অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ডের জন্য বৈধতা সৃষ্টি করে মুসলমানদেরই অভিযুক্ত সাব্যস্ত করা। এটাই সঙ্গত হতো যে, কাশ্মির ফাইলসের সূচনা হওয়া উচিত ছিল সেখান থেকে, যখন ১৩ জুলাই, ১৯৩১ সালে একটি আজানকে পূর্ণ করার জন্য ২২ জন কাশ্মিরিকে নিজেদের প্রাণ দিতে হয়েছিল।
অনুরূপ, ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে ভারত ভাগের পর যখন মহারাজার রাজ ব্যক্তিত্ব বিলুপ্ত করা ও গণতন্ত্র শাসনব্যবস্থা চালুর আন্দোলন তুমুল আকার ধারণ করেছিল, তখন জম্মুতে দুই লাখ ৩৭ হাজার মুসলমানকে শুধুই তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে হত্যা করা হয়েছিল। ওই গণহত্যার ব্যাপারে একটি বিষয় স্পষ্ট নজরে পড়ে যে, এতে শুধুই মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছিল, যাদের অপরাধ ছিল- তারা এই এলাকার স্থানীয় অধিবাসী ছিল। জম্মুতে তাদের উপস্থিতি নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। ফলে মহারাজাকে নিজের পৈতৃক শহরে পরাজয়ের মুখোমুখি হতে হবে। কাশ্মিরের ইতিহাসে জম্মু রাজ্যে ঘটিত এত বড় ধরনের গণহত্যা এটাই প্রথম ছিল, যা রীতিমতো ভেবেচিন্তে পরিকল্পনামাফিক করা হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু এতে মুসলমানদের হত্যা করা হয়েছিল, সম্ভবত এ কারণে কিছু মানুষ ব্যক্তিগত বিদ্বেষ বা শত্র“তার কারণে এটাকে মানবাধিকারের বিষয় মনেই করে না। ‘কাশ্মির ফাইলস’ সিনেমায় যেখানে উগ্রপন্থীদের হাতে কাশ্মিরি পণ্ডিতদের উচ্ছেদ ও হত্যার ঘটনাকে বিষয়বস্তু বানানো হয়েছে, সেখানে সেই উগ্রপন্থী গোষ্ঠীদের হাতে শহীদ হওয়া মুসলমানদের উপেক্ষা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে মীর ওয়ায়েজ উমর ফারুক, ড. আহাদ গুরু, কাশ্মির বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. মুশিরুল হক, মৌলভী মুহাম্মাদ হুসাইন, আবদুল গনি লোন, প্রখ্যাত সাংবাদিক শুজায়াত বুখারি ও অ্যাডভোকেট বাবর কাদেরিসহ এমন অসংখ্য ব্যক্তি রয়েছেন, যারা উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসের প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন। ফলে তারা গুলির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। তাদের সবাইকে এই সিনেমায় একেবারে উপেক্ষা করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ওই উগ্রবাদীদের লক্ষ্য কি শুধুই পণ্ডিত ছিল? এই বিশিষ্ট কাশ্মিরি মুসলমানদের ব্যাপারে মতামত কী, যাদের শুধু এ জন্য হত্যা করা হয়েছিল যে, তারা কাশ্মিরের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন, কোনো উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসী মতাদর্শের পক্ষে ছিলেন না? নব্বই দশকে কিছু উগ্রবাদী গোষ্ঠীর কারণে পণ্ডিতদের হত্যা ও উচ্ছেদের যে ঘটনা ঘটেছে, তা কোনোভাবেই ন্যায়সঙ্গত ছিল না। কোনো কাশ্মিরিই এটাকে ভালোভাবে নেয়নি। কিন্তু এর জন্য সব কাশ্মিরিকে অভিযুক্ত করা যুক্তিসঙ্গত নয়। যদি ওই সময়ের পরিস্থিতি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা যায়, তাহলে দেখা যাবে, পণ্ডিতদের উচ্ছেদ ও হত্যাকে বাধা দেয়ার কোনো শক্তি সাধারণ কাশ্মিরিদের ছিল না। কেননা, তারা ওই সময়ের পরিস্থিতিতে উগ্রবাদীদের সামনে নিরুপায় ছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, কাশ্মিরি মুসলমানরা তাদের পণ্ডিতদের জন্য সবসময় প্রশস্ত মনের প্রকাশ ঘটিয়েছে। তারা চায়, পণ্ডিতরা তাদের পৈতৃক ভিটায় ফিরে আসুক। এখানে একটি কথা ভাবনার বিষয়, পণ্ডিতদের উচ্ছেদের চর্চা আগামীতেও হতে থাকবে, কিন্তু ওই সব অসংখ্য কাশ্মিরি মুসলমান পরিবারের আলোচনা কোথাও শোনা যায় না, প্রাণ বাঁচানোর জন্য যাদের কাশ্মির থেকে এ জন্য পালাতে হয়েছে যে, উগ্রবাদী মতাদর্শের গোষ্ঠীর মানসিকতার সাথে তাদের মতের মিল ছিল না। Right to information-এর আওতায় ভারত অধিকৃত কাশ্মিরে এমন ১৭৪৯ জন মানুষের নাম সামনে এসেছে, যারা উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর গুলির লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। তন্মধ্যে পণ্ডিতের সংখ্যা মাত্র ৮৯। বাকিরা ছিল কাশ্মিরি মুসলমান। এই সিনেমা দেখার পর বোধসম্পন্ন বিবেকের মাঝে বহু প্রশ্ন তৈরি হয়। যদি কাশ্মিরি পণ্ডিত ও কাশ্মিরি মুসলমান একই মানসিকতার অধিকারী উগ্রবাদীদের গুলির লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকে, তাহলে কাশ্মির ফাইলসে শুধু কাশ্মিরি পণ্ডিতদের ব্যাপারে কেন দেখানো হলো এবং কাশ্মিরি মুসলমানদের ব্যাপারে চুপ থাকা হলো কেন? এই সিনেমায় ওই সব কাশ্মিরি মুসলমানের কথা কেন বলা হলো না, যারা ওই সঙ্কটময় সময়ে নিজেদের কাশ্মিরি পণ্ডিত ভাইদের নিজেদের গৃহে আশ্রয় দিয়েছিলেন? এমন কর্মে তাদের জীবন বিপন্ন হতে পারে, এটি জানা সত্তে¡ও ওই কাশ্মিরি মুসলমানরা পণ্ডিতদের জন্য পরিবহন ও থাকার ব্যবস্থা করে। পণ্ডিতরা তো কাশ্মির ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু তারা কি কখনো ভেবেছেন, উগ্রপন্থী ও ভারতীয় বাহিনীর জুলুম-অত্যাচারের মুখোমুখি হওয়ার জন্য কাশ্মিরে যে সব মুসলমান থেকে গিয়েছিল, তাদের কী হয়েছে? কুনান পোসপোরা ঘটনা, যেখানে ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক কাশ্মিরি মুসলিম নারীদের গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে, গাওকাদাল গণহত্যা, বিজবেহারা গণহত্যা, মীর ওয়ায়েজ মৌলভী ফারুকের জানাজায় অংশগ্রহণকারী ৭২ জনকে হত্যা এবং এমন ধরনের আরো ঘটনার কথা কেন স্মরণ করা হয়নি? তাদের পরিকল্পিতভাবে কেন উপেক্ষা করা হলো? যখন এ সব প্রশ্ন নিয়ে ভাবা হয়, তখন একটাই জবাব পাওয়া যায়- এ সিনেমা সুপরিকল্পিত প্রপাগান্ডার অংশ হিসেবে নির্মিত হয়েছে যার উদ্দেশ্য শুধুই কাশ্মিরি পণ্ডিত ও কাশ্মিরি মুসলমানদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি এবং বিদ্বেষ ও শত্র“তা বৃদ্ধি করে সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫-এ ধারা বিলুপ্তির বৈধতাকে পাকাপোক্ত করা।
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট যখন জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা বিলুপ্ত করে সেটাকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বানানো হয়, তখন রাজ্যের কিছু মানুষ তো অবশ্যই এতে আনন্দ প্রকাশ করেছিল, কিন্তু অতি দ্রুতই তারা এটা বুঝতে পারে যে, এ রাজ্য জনগণের জন্য কখনোই লাভজনক হবে না। এ নিয়ে এখন তাদের প্রকাশ্যে সমালোচনা করতে দেখা যাচ্ছে। যখন শুধু মানবাধিকার বিষয় নিয়ে কথা হয়, তখন সব ভারতীয় মিডিয়া ও রাজনীতিবিদ এবং বেশির ভাগ মানুষকে কোনো না কোনোভাবে বিদ্বেষভাবাপন্ন দেখা যায়। তারা শুধু এ বিষয়টি নিয়েই কথা বলে যে, কাশ্মিরি পণ্ডিত শ্রেণীর সাথে জুলুম হয়েছে। কিন্তু তারা কাশ্মিরি মুসলমানদের ওপর হওয়া জুলুমের ব্যাপারে চোখ-মুখ বন্ধ করে ফেলে। এটাকে বিদ্বেষ বলবেন না তো কী বলবেন? এই সিনেমায় কাশ্মিরে সঙ্ঘটিত হৃদয়বিদারক অসংখ্য ঘটনাকে একেবারেই উপেক্ষা করা হয়েছে, যে ঘটনাগুলো কাশ্মিরের ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। আজ যখন কাশ্মিরি পণ্ডিত ও কাশ্মিরি মুসলমান একে অপরের কাছাকাছি আসছে, তখন এই কাশ্মির ফাইলস সিনেমা আরো একবার তাদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি ও বিদ্বেষ ছড়ানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- এখন কাশ্মিরিরা এতটাই সচেতন হয়ে গেছে যে, তারা যেমন উগ্রবাদের অংশ হতে প্রস্তুত নয়, তেমনি তারা কাশ্মিরিদের মাঝে বিদ্বেষকে বাতাস দানকারী প্রপাগান্ডার অংশ হতেও চায় না।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ২৬ মার্চ, ২০২২ থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক ও কলামিস্ট