রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫৪ অপরাহ্ন

দেশের অর্থনীতিতে অশনিসঙ্কেত

ড. মিজানুর রহমান
  • আপডেট টাইম : শুক্রবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২২
  • ১২৮ বার

ভালো নেই দেশের অর্থনীতি। বরং দিন দিন খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। অনেক সূচকেই খারাপ হচ্ছে। এর মধ্যে অন্তত চারটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক সতর্কসঙ্কেত দিচ্ছে। কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ দুই বছর পরে, এখন অনেকটাই কমেছে। বিশ্বঅর্থনীতির সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর কথা। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। ফলে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সাথে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা আছে, এমন প্রায় সব ক্ষেত্রেই সমস্যা দেখা দিয়েছে।

কোভিড অতিমারীর সময় সারা বিশ্বেই পণ্যসামগ্রীর চাহিদা ছিল অনেক কম; ফলে উৎপাদনও কম হয়েছে। বিঘিœত হয়েছে যোগাযোগব্যবস্থাও। কোভিডের প্রভাব চলে যেতে থাকলে সমস্ত পণ্য ও সেবার চাহিদা বাড়তে শুরু করে। কিন্তু সে তুলনায় বাড়েনি উৎপাদন। ফলে শুরু থেকেই দেখা দেয় মূল্যস্ফীতির চাপ। বাংলাদেশও এর বাইরে থাকতে পারেনি। এরপরই রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ। এতে আরো বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে।

ক’বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির চলতি হিসাবে কমবেশি ঘাটতি দেখা দিতে শুরু করে। তবে, এই ঘাটতি মারাত্মক আকার ধারণ করে চলতি অর্থবছরে। এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এই চলতি হিসাবের ঘাটতি এক হাজার ছয় কোটি ডলারে পৌঁছায় যা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি নতুন রেকর্ড। এই ঘাটতি রফতানিজনিত নয় বরং আমদানিজনিত। অর্থাৎ রফতানি ভালো হয়েছে। গত ৯ মাসে দেশের রফতানির পাঁচটি শীর্ষ খাত যেমন- তৈরী পোশাক, হোম টেক্সটাইল, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং প্রকৌশল পণ্যের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ক্ষেত্রভেদে ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত। তবে আমাদের দেশের রফতানি মূলত তৈরী পোশাক সেক্টরের ওপর বেশির ভাগ নির্ভরশীল। ভিয়েতনাম ও ইথিওপিয়াসহ আফ্রিকার দেশগুলো এই সেক্টরে এগিয়ে আসছে। সুতরাং আমাদের সতর্ক থাকতে হবে; বিকল্প রফতানি সেক্টরের কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। আমাদের পোশাক রফতানির প্রধান বাজার ইউরোপে; রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়লে রফতানি বাণিজ্যে প্রভাব ফেলতে পারে; সতর্ক থাকতে হবে, বিকল্প বাজার খুঁজতে হবে।

তবে, একই সময় আমদানি ব্যয় বাড়ছে বিপজ্জনক গতিতে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসের প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, এই সময় আমদানি ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি ডলার। আমদানির এই পরিমাণ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৬ শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশে এর আগে পুরো অর্থবছরের সর্বোচ্চ আমদানি ব্যয় হয়েছিল সাড়ে ছয় হাজার কোটি ডলারের কিছুট বেশি। এই বছরের আমদানির এই ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থবছর শেষে আমদানি ব্যয় ৯ থেকে ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়াবে।

চলতি অর্থবছরে জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ৩৩ দশমিক ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি ৪৬ দশমিক ২১ শতাংশ। ফলে সর্বশেষ হিসাবে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ; ডলারের অঙ্কে যা এক হাজার ৫৬১ কোটি ৬০ লাখ ডলার। অথচ আগের অর্থবছরের একই সময়ে তা ছিল ৬৮৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার। সুতরাং বাণিজ্য ঘাটতিতেও তৈরি হচ্ছে নতুন রেকর্ড।

আমদানি-রফতানির এই ভারসাম্যহীনতার সাথে মাত্রা যোগ করেছে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ, যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ। আর এই অর্থবছরে এখন পর্যন্ত কোনো প্রবৃদ্ধি নেই, বরং কমেছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এবার প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে ১৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ফলে আগের বছর যেভাবে ফুলেফেঁপে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বড় হচ্ছিল, এবার আর তা সেভাবে হচ্ছে না। বরং আমদানি ব্যয়ের অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি রিজার্ভ কমিয়ে দিচ্ছে।

আমদানি ব্যয় বিপুলভাবে বেড়ে যাওয়ায় ডলারেরও সঙ্কট দেখা দিয়েছে। উল্লেøখ্য, ২০২১ সালের ৩০ জুন দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ছিল চার হাজার ৬৩৯ কোটি ১৫ লাখ ডলার। আর এখন সেটি কমে হয়েছে চার হাজার ৩৪৩ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। ডলার সঙ্কটের কারণে টাকার মান কমে যাচ্ছে। এমনিতেই বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে পরোক্ষ হস্তক্ষেপ করে টাকা-ডলার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করে। এই চেষ্টার অংশ হিসেবে এই অর্থবছরেই বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে প্রায় ৩৭৫ কোটি ডলার বাজারে ছেড়েছে।

মূল্যস্ফীতির চাপও রয়েছে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে। কাগজ-কলমে মুদ্রাস্ফীতি প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ, বাস্তবে হয়তো আরো বেশি। মূল্যস্ফীতির চাপের অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ, দেশে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে মার্কিন ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সব ব্যাংকের কাছে পর্যাপ্ত ডলার হাতে থাকছে না। এই ডলার সংগ্রহ করতে কিছু ব্যাংক বেশি দাম দিয়ে প্রবাসী আয় আনছে। সেই অর্থ বেশি দামে ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক ও ছোট ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে আমদানি করা ভোগ্যপণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে; ফলে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। বর্তমানে প্রতি ডলারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত দাম ৮৬ টাকা ২০ পয়সা। অথচ এই ডলার ব্যবসায়ীদের কিনতে হচ্ছে ৮৯ টাকারও বেশি দরে। আর খোলাবাজারে দর আরো অনেক বেশি। টাকার বিনিময় হার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আছে উভয়সঙ্কটে। অবমূল্যায়ন করলে রফতানিকারকরা লাভবান হবে ঠিকই, তবে তাতে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। আর এখন তো এমনিতেই আমদানি ব্যয় বাড়ছে বিপজ্জনকভাবে। সুতরাং রফতানিকারকরা দাবি জানালেও সংযত থাকছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

মূল্যস্ফীতির অন্য একটি কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া। ফলে আগের চেয়ে বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে আমদানিকারকদের। এতে আমদানির পরিমাণ যতটা বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে এর ব্যয়। ফলে রফতানি আয় বাড়লেও সে তুলনায় আমদানি ব্যয় এতটাই বেড়েছে যে, বাণিজ্য ঘাটতি হয়ে গেছে বিশাল। অন্য দিকে, করোনার সময় প্রবাসী আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশে ছিল বরাবরই ভালো প্রবৃদ্ধি। কিন্তু চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই এই আয় নিম্নগামী। অর্থাৎ সব মিলিয়ে বৈদেশিক প্রায় সব ক্ষেত্রেই আয় কমে গেছে, অথচ বেড়েছে ব্যয়। এতে চলতি হিসাবে বড় ধরনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। ভারসাম্যহীনতা আছে সামগ্রিক লেনদেনেও।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক এখন চলতি আয়ের ভারসাম্যহীনতা। দেশে সবসময় বাণিজ্য ঘাটতি থাকলেও রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি কারেন্ট অ্যাকাউন্ট বা চলতি হিসাবকে বেশির ভাগ সময়ই ভারসাম্যপূর্ণ রেখেছে। তবে এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আগেই বলেছি, বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি হিসাবের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি পর্যন্ত ঘাটতি এক হাজার ছয় কোটি ডলার। বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনোই চলতি আয়ে এত বড় ঘাটতি দেখা দেয়নি। এমনকি, গত বছরেও এই খাতে ছিল ১৫৫ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত। মূলত রেকর্ড পরিমাণ আমদানি ব্যয় এবং প্রবাসী আয়ের ‘ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি’র কারণেই এই রেকর্ড। প্রবাসে শ্রমিক পাঠানোর জন্য নতুন নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে হবে। অদক্ষ শ্রমিক না পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগ নিতে হবে। শ্রমিক প্রবাসে পাঠানোর ক্ষেত্রেও রয়েছে অনেক দুর্নীতি যার মূলোৎপাটন করে প্রবাসে শ্রমিক পাঠানোর মাত্রা বাড়াতে হবে।

চলতি আয়ে এত বড় ঘাটতির কারণে সামগ্রিক লেনদেনেও এবার ঘাটতি দেখা দেবে। এ অবস্থায় এখনই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কারণ, আন্তর্জাতিক খাতে বর্তমান যে সঙ্কট, তা সহজেই মিটার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। দেশী-বিদেশী ঋণের মাধ্যমে এই ঘাটতি মিটাতে গিয়ে দিনে দিনে ঋণের পরিমাণ বাড়ছে ব্যাপকভাবে। গত তিন মাসেই বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ছয় বিলিয়ন ডলার যা বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রায় ১৩ শতাংশ। বর্তমানে দেশী-বিদেশী ঋণের পরিমাণ ১৩ লাখ কোটি ডলার যা দেশের মোট জিডিপির ৪৬ ভাগ। অথচ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এই ঋণের সহনীয় মাত্রা জিডিপির ৪০ শতাংশ; ইতোমধ্যে আমাদের দেশের সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। দেশের বাজেটের সবচেয়ে বড় ব্যয় খাত এখন ঋণের সুদ। এই ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে দেশ ঋণের ফাঁদে পড়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমরা শ্রীলঙ্কা যে ঋণের ফাঁদে পড়েছে এবং ফলে দেশের অর্থনীতি যে ভয়াবহ মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সে উদাহরণকে বিবেচনায় রাখতে পারি এবং এখনই সতর্ক হতে পারি।

চলতি আয়ের ঘাটতি কমানোর জন্য রফতানি বৃদ্ধি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ জন্য বিলাসদ্রব্যের আমদানি বন্ধ করার পাশাপাশি যেসব পণ্য দেশে উৎপাদিত হয় অথবা উৎপাদন করা সম্ভব সেগুলোর আমদানি বন্ধ অথবা কর বৃদ্ধির মাধ্যমে আমদানি অনুৎসাহিত করা যেতে পারে।

অর্থনৈতিক সূচকের সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অশনিসঙ্কেত হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতি। সমাজের সর্বক্ষেত্র এখন দুর্নীতিতে সয়লাব। রাষ্ট্রীয় সম্পদে চলছে লুটপাট।

ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদ-আমলা-আইনপ্রয়ণকারী-আইনপ্রয়োগকারী সব যেন একাকার; ফলে জবাবদিহিতা কমে আসছে। দুর্নীতি-লুটপাট এবং গরিবদের শোষণের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছে মুষ্টিমেয় লোকজন। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো, এই লুটপাটকৃত অর্থ তারা দেশে না রেখে বিদেশে পাচার করছে, ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতিতে প্রভাব ফেলছে। একদিকে ধনী আরো ধনী হচ্ছে, অন্যদিকে, গরিব দিনে দিনে আরো গরিব হচ্ছে, সৃষ্টি হচ্ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। আর এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রভাব পড়ছে দেশের সব ক্ষেত্রে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com