দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর স্বাধীন দেশগুলোতে বিশেষত উপমহাদেশের ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে পাশ্চাত্য ধাঁচের গণতন্ত্র অনুসৃত হচ্ছে। এ ধারার গণতন্ত্র এসব দেশে দুর্নীতি ও বৈষম্য বিস্তারে কতটা পারঙ্গম তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ফলে দীর্ঘ দিন থেকেই বর্তমানের এবং অতীতের সরকারগুলোর শাসনামলে অনুসৃত অর্থ ও অন্যান্য বিষয়ক দুর্নীতি নিয়ে বিভিন্নজন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বেশ লিখছেন। অনেকেরই অভিমত এসব দেশে গণতন্ত্র নেই। যে গণতন্ত্র নেই বলে অনেকেই হা-হুতাশ করছেন তা পাশ্চাত্য ধারার গণতন্ত্র। সে গণতন্ত্র নেই বলেই দুর্নীতি ও এর সাথে যুক্ত অন্যান্য অপছন্দনীয় ও ক্ষতিকর বিষয় যেমন বৈষম্য ও দুর্নীতি এসব দেশে প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। অনেকেই বুঝতে চান না, সব দুর্নীতি ও বৈষম্য আসলে পাশ্চাত্য ধারার গণতন্ত্রের সহচর। যে পাশ্চাত্য ধাঁচের গণতন্ত্র তারা চাচ্ছেন তাতে করে দুর্নীতি ও বৈষম্য থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো উপায় নেই। যে দল ক্ষমতায় আছে কিংবা যারাই আবার ক্ষমতায় যাবে বলে মনে হয় তাদের গণতন্ত্র এই বৈষম্য ও দুর্নীতির গণতন্ত্রই। আসলে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্রের খাছিয়তই এই এবং তা সব দেশেই। এসব দেশের নেতারা সবাই গণবিচ্ছিন্ন নির্যাতনকারী ও দুর্নীতিবাজ। দেশের পঁচানব্বই শতাংশ দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগণের সাথে এদের কোনো নাড়ির যোগাযোগ নেই। জনগণকে এরা দূর থেকে কেউ দেখে দূরবীন দিয়ে, কেউ আকাশে পা রেখে; ব্যাপার একই।
পশ্চিমা পুঁজিতান্ত্রিক ধাঁচের গণতন্ত্র যা বাংলাদেশের মতো দেশগুলো অনুসরণ করছে সে গণতন্ত্রের স্বরূপ বিষয়ে লেনিন যথার্থই বলেছেন যে, ‘Democracy for an insignificant minority, democracy for the rich– that is the democracy of capitalist society. If we look more closely into the machinery of capitalist democracy, we see every where, in the ‘petty’ – supposedly petty – details of suffrage (residential qualification, exclusion of women, etc.) in the technique of the representative institutions, in the actual obstacles of the right of assembly (public buildings are not for ‘poupers’!), in the capitalist organization of the daily press etc.etc. – we see restriction after restriction upon democracy. These restrictions, exclutions, obstacles for the poor seem slight, especially in the eyes of one who has never known want himself and has never been in close contact with the oppressed classes in their mass life (and nine out of ten, if not ninety nine out of a hundred, bourgeois publicists and politicians come under this category), but in their sum total these restrictions exclude and squeeze out the poor from politics, from active participation in democracy.
‘Marx grasped this essence of capitalist democracy splendidly when, in analyzing the experience of the commune [এখানে Paris Commune-এর কথা বলা হয়েছে], he said that the oppressed are allowed once every few years to decide which particular representative of the oppressing class shall represent and repress them in parliament.” (Lenin, Marx, Engles Marxism, pp. 103-104)। এই যেখানে অবস্থা, সেখানে পুঁজিতান্ত্রিক দেশে ক্ষমতায় কে এলো আর কে গেল তাতে কার কি-ই বা এসে যায়! কার বিচার কে করবে যেখানে ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী একই গোষ্ঠীভুক্ত? ক্ষমতার বাইরে এবং ভেতরে এরা সবাই পুঁজিবাদী। অর্থাৎ পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের কথাই বলেন এবং এর ভেতরে থেকে দুর্নীতি ও বৈষম্যের অবসান ঘটাতে চান, সবটাই অসম্ভব।
আমাদের দেশে তথা একটি ‘বুর্জোয়া’ শাসিত সমাজে কে কিভাবে ধনী হয় সে সম্বন্ধে সবারই কমবেশি ধারণা আছে। সে কাহিনী ব্যাখ্যা করে বুঝাবার দরকার পড়ে না কারণ প্রায় প্রতি দিনের খবরের কাগজেই তা আমরা পড়ি। ক্ষমতাসীনরা যেভাবে ধনী হয় বিরোধীরাও সেভাবেই হয়। ক্ষমতায় গেলে পথ প্রশস্ত, ক্ষমতার বাইরে থাকলে একটু বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয়। কাঠখড় পোড়ানোর ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে হলে ক্ষমতা চাই। নইলে লাখ লাখ কিংবা কয়েক কোটি টাকা খরচ করে নির্বাচিত হয়ে জনসেবা করার এত গরজ কেন? পাশ্চাত্য ধারার গণতন্ত্রে নিজের খেয়ে বনের মোষ কে কবে তাড়িয়েছে? কেউ তাড়ায় না- কিন্তু উতরে যায় সবাই। তাই ক্ষমতা চাই। নির্বাচনে খরচ করা টাকা সুদে আসলে দ্বিগুণ তিনগুণ যতগুণ পারা যায় উঠিয়ে আনা চাই। এসব নির্বাচনী খরচকে একধরনের জনসেবা শিল্পে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ বলা চলে। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বে তথা পশ্চিমা সাহায্যপুষ্ট দেশে এ জাতীয় বিনিয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে পারলে মুনাফা ও সম্মান প্রচুর। আর তাই তাদের মুখে কত মধুর মধুর কথা! সবাই পরীক্ষিত। কোনো প্রকার বাছ বিচার না করেই সবার জন্যই এ কথা প্রযোজ্য- বিশেষত পশ্চিমা ধাঁচের পুঁজিবাদী গণতন্ত্রীদের ক্ষেত্রে।
সত্য এই যে, সৎ বুদ্ধিজীবীদের কথা পুঁজিবাদীদের তো শোনার কথাই ওঠে না, এ জাতীয় কথায় যারা উপকৃত হতে পারে তারাও শোনে না। পুঁজিপতিরা বরঞ্চ হাসে, ভাবখানা এই, ‘বকে যাও যত পারো; আমরা হাততালি দেবো। চাও তো কিছু উচ্ছিষ্ট হালুয়া রুটি!’
কথাটি এ জন্য বললাম যে, এর প্রতিবাদে লেখালেখি তো কম হচ্ছে না; কিন্তু ফলাফল কোথায়? ফলাফলের অনুপস্থিতির অন্য কারণও আছে। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ে গেল। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক যখন যুক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী তখন কোনো একটি পত্রিকা তার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছিল। এক ভক্ত বিষয়টি হক সাহেবের গোচরীভূত করলে হক সাহেব বলেন, ‘তুমি এটা পড়েছ, ব্যাস্, আর কাউকে বলো না। আমাকে যারা ভোট দেয় তারা পত্রিকা পড়ে না।’ গল্পটি সত্য মিথ্যা যাই হোক এ কথা সত্য যে, আমাদের দেশে সম্ভবত নব্বই শতাংশ লোকই পত্রিকা পড়ে না। যারা পড়ে তারাও সুবিধাভোগীদেরই অন্তর্ভুক্ত এবং একটি উদ্দেশ্য নিয়েই পড়ে। সুতরাং যে যাই লিখুক না কেন পুঁজিপতিদের তাতে কিছু যায় আসে না। যারা পত্রিকা পড়ে তারাও পুঁজিপতিদের ভয় পায় দু’কারণে। এক. পুঁজিপতিদের বিপক্ষে গেলে স্বার্থহানি ঘটতে পারে। যেহেতু ক্ষমতা তাদেরই হাতে। দুই. কেননা ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে ভোট তো তারা এদেরই দেবে বা এদের শ্যালককে, যে অন্য দল করে, যে পার্টির সাথে তাদের দূরত্ব যতটা সাইনবোর্ডের ততটা ক্ষমতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির নয়। তাই ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কী? এই হলো সৎ পাঠকেরও মনোভাব কিংবা এখানেই তাদের অসহায়ত্ব। সুতরাং জনগণ উপেক্ষিতই রয়ে যায়।
আমাদের মনে হয় (যদিও ব্যাপারটি বলা যত সহজ, করা তত সহজ নয়) পত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি এই সংখ্যাগরিষ্ঠ নিরক্ষর জনগণের দেশে সৎ বুদ্ধিজীবীদের জনগণের কাছাকাছি পৌঁছার একটি বিকল্প মাধ্যম বের করে নেয়া দরকার। পুঁজিপতি রাজনীতিবিদরা যে কতটা ভণ্ড এবং মতলববাজ তা শুধু পত্রিকায় লিখে জনগণকে বুঝাবার সময় আমাদের দেশে এখনো আসেনি। এই কঠিন কাজটি ‘বাম’ রাজনীতিবিদদের হাতে ছেড়ে দিয়ে বিশেষ কোনো ফল লাভ হয়নি প্রথমত তাদেরও ভণ্ডামির কারণে, দ্বিতীয়ত জনগণের দুর্বিষহ দারিদ্র্যের কারণে। নিবেদিতপ্রাণ ‘বাম’ রাজনীতিবিদদের পুঁজিপতিরা সহজেই কোণঠাসা করে ফেলে। আদর্শে যে যত সৎ, নিষ্ঠাবান, যে বিবেকের সাথে প্রতারণা করতে শিখেনি, ভোগান্তি তার তত বেশি। তবুও উপায় একটি বের করতেই হবে। নইলে সততার কিংবা আদর্শের মূল্য থাকল কী? তবে আমাদের মতো দেশে যেখানে জনগণ ধর্মভীরু সেখানে ‘বাম’ রাজনীতিকদের মূল সমস্যা হলো এরা নাস্তিক। আপাত দৃষ্টিতে তাদের কথাবার্তা ও আদর্শ শুনতে যতটা ভালোই লাগুক না কেন এ কারণে জনগণ তাদের গ্রহণ করতে রাজি নয়। ধর্মদ্রোহীদের জনগণ পছন্দ করেন না। পুঁজিপতিরা কিন্তু কাজে যতটা না হোক কথাবার্তায় জনগণের ধর্মকে মান্য করে চলে। যে কারণে বৈষয়িক দিক দিয়ে প্রতারিত হলেও জনগণ এদের মধ্য থেকেই নিজেদের প্রতিনিধি বাছাই করে।
বাংলাদেশে জনগণের ৯২ শতাংশই ধর্মভীরু মুসলমান। সত্যিকার অর্থেই যারা ধর্মভীরু তাদের হাতে দেশ ও দেশের লোক নিরাপদ। এর উদাহরণ ইসলাম অনুসারী নেতাদের থেকে টানা যায়। খিলাফতের শাসনামলে দেখা গেছে শাসকরা কত সৎ এবং দায়িত্বশীল ছিলেন। মুসলিম জাহানের খলিফা হজরত উমর রা: বলতেন, ‘সুদূর দজলার তীরে যদি একটি বকরির বাচ্চাও না খেয়ে মারা যায়, আমার ভয় হয় হয়তো এ জন্য আল্লাহর কাছে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে’ (দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, ২০০০, পৃষ্ঠা, ৫১১)। শাসন বিষয়ে তার আরেকটি উক্তি, ‘সুদূর ফোরাতের তীরে যদি একটি কুকুরের বাচ্চাও হারিয়ে যায়, আমার ভয় হয় হয়তো আল্লাহর কাছে এ বিষয়ে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে’ (দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম)। এই হলো ইসলামী গণতন্ত্রের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। ইসলামী ধারার গণতন্ত্র চর্চা করলে দেশ ও দশের অনেক আপদই অপনোদন করা যাবে। জনকল্যাণে বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশে এটি চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। আজকের বাস্তবতায় ইসলামী শাসন পরিচালনা করার মতো পর্যাপ্তসংখ্যক পরহেজগার নেতা আছেন কি না দেখতে হবে।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। ঈমান-আকিদা থেকে শুরু করে লেনদেন, ইবাদত, সামাজিক জীবন, পারিবারিক জীবন অর্থনীতি, রাজনৈতিক জীবন, দাওয়াত, জিহাদ এবং তাসাউফসহ এতে সবকিছুর দিকনির্দেশনা রয়েছে। প্রকৃত মুমিন হওয়ার জন্য যেভাবে সহিহ্ আকিদা ও বিশুদ্ধ আমল জরুরি তেমনি সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি আর অর্থনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রেও ইসলামী অনুশাসন মেনে চলতে হয় বিধায় এতে বৈষম্য ও দুর্নীতির স্থান শূন্য। ইসলাম শান্তি ও সাম্যের ধর্ম। সমাজে যদি বিভেদ বৈষম্য লোপ পায় তবে জনগণের মধ্যে হিংসাবিদ্বেষের স্থান থাকবে না। সমাজ শান্তির মধ্যেই স্থিত হবে।
লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ও ভাইস প্রিন্সিপাল, মহিলা সরকারি কলেজ, কুমিল্লা।