রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:০৮ অপরাহ্ন

ডিএনএ : বিস্ময়কর প্রাকৃতিক কম্পিউটার

ডা: মো: তৌহিদ হোসাইন
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ৮ মে, ২০২২
  • ১১৪ বার

কোষ হলো জীবনের গঠনগত ও কার্যগত মৌলিক একক। এককোষী কিংবা বহুকোষী যে প্রাণীই হোক না কেন সব জীবিত প্রাণী স্বাভাবিকভাবে কাজ করার জন্য কোষের ওপর নির্ভরশীল। এক একটি কোষ যেন একটি কম্পিউটার। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মানবদেহে ৭৫ থেকে ১০০ ট্রিলিয়ন কোষ কম্পিউটার রয়েছে। আবার শরীরে যত কোষ আছে তার দশগুণ অণুজীব চামড়া, নাক-মুখ, গলা, বৃহদন্ত ইত্যাদিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যাদের ওজন সাকুল্যে সাড়ে সাত গ্রাম। কম্পিউটারের যেমন হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার রয়েছে; তেমনি কোষ নিজে হলো এর হার্ডওয়্যার এবং ভেতরে প্রতিনিয়ত যত ফিজিওলজিক্যাল কার্যকলাপ চলে তা এর সফটওয়্যার। শুধু কি তাই, প্রতিটি কোষের নিউক্লিয়াসের ভেতর যে ডিএনএ আছে, সেগুলো সবচেয়ে সফিস্টিকেটেড শক্তিশালী সুপার কম্পিউটার। কারণ ডিএনএর ভেতর যে জিন থাকে তার কাজ ও নির্দেশনা জেনে আধুনিক বিজ্ঞানীরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছেন।

ডিএনএ বা ডি-অক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড কী দিয়ে তৈরি
পবিত্র কুরআন মতে, প্রাণী সৃষ্টির সূচনার চারটি ধরন দেখতে পাই। প্রথমত, আল্লাহ প্রথম মানব হজরত আদম আ:কে সৃষ্টি করেছেন মাটি ও পানি থেকে। এরপর ভেতরে রুহ ফুঁকে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, আদম আ: থেকে বিপরীত লিঙ্গের হজরত বিবি হাওয়াকে সৃষ্টি করেছেন বিপরীত লিঙ্গের ক্লনিং করে (সূরা নিছা-১)। তৃতীয়ত, স্বামী-স্ত্রী থেকে সন্তান-সন্ততি ও বংশধারা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। চতুর্থত, ফার্টিলাইজেশন ছাড়া কিংবা অটো ফার্টিলাইজেশন প্রক্রিয়ায় যা এখনো মোমাছি বা পিঁপড়া জাতীয় প্রাণীর মধ্যে বিদ্যমান। এ প্রক্রিয়াকে পারথেনোজেনেসিস বলে। সৃষ্টির সূচনা যেভাবেই হোক তা উদ্দেশ্যহীন কিংবা নিয়মবিহীন নয়। হে আমাদের রব, তুমি এসব অনর্থক সৃষ্টি করোনি ( সূরা আলে ইমরান-১৯১)।

স্রষ্টা যখন কোনো কিছু সৃষ্টি করেন, তখন তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং বংশপরম্পরার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার নিয়মও বাতলে দেন। ‘যিনি সৃষ্টি করেন এবং সুষম করেন। অতঃপর নিয়তি নির্ধারণ করেন এবং কিভাবে চলতে হবে তার পথ নির্দেশনা দেন।’ (সূরা আ’লা : ২-৩)। এ জন্যই সব সৃষ্টির ক্ষেত্রে সূচনা যেভাবেই হোক, তার বেঁচে থাকা, বৃদ্ধি পাওয়া এবং বংশপরম্পরা রক্ষা করার বিধান সব প্রাণীর ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য। বেঁচে থাকার এই প্রয়োজনীয় নির্দেশনা আল্লাহ জেনেটিক কোড আকারে প্রতিটি প্রাণিকোষেই দিয়ে দিয়েছেন। আর তাই সৃষ্টিকর্তা সব প্রাণীর সব কোষেই একটি করে তথ্য সেন্টার ঠিক করে দিয়েছেন যেখান থেকে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সেই তথ্য সেন্টারের নাম হলো ডিএনএর ভেতরে থাকা নিউক্লিওটাইড বেজ পেয়ার। সুতরাং ডিএনএ ছাড়া কোনো জীবিত প্রাণী হয় না। তবে ১৯৪৩ সালের আগে, বেশির ভাগ বিজ্ঞানী মনে করতেন, প্রোটিনই জেনেটিক কোড সংরক্ষণ করে। কিন্তু এখন এটি পরিষ্কার যে, জেনেটিক কোড থাকে ক্রমোজমে অবস্থান করা ডিএনএর নিউক্লিওটাইড বেজ পেয়ারে।

১৮৬৯ সালে ফ্রেডরিচ মিশার প্রথম এই ডিএন এ সম্পর্কে ধারণা দেন। কিন্তু তিনি ডিএনএর গঠন সম্পর্কে ধারণা দিতে পারেননি। ব্রিটিশ আণবিক জীববিজ্ঞানী জেমস ওয়াটসন ও ফ্রান্সিস ক্রিক ২৫ এপ্রিল, ১৯৫৩-এ ডিএনএর গঠন আবিষ্কারের ঘোষণা দেন। ডিএনএর গঠনের বর্তমান মডেলটি মূলত জীববিজ্ঞানী ওয়াটসন ও পদার্থবিজ্ঞানী ক্রিকের ১৯৫৩ সালে বিখ্যাত ‘নেচার’ জার্নালে প্রকাশিত মডেলেরই প্রতিচ্ছবি। যে যুগান্তকারী আবিষ্কারের কারণে তারা ১৯৬২ সালে নোবেল পুরস্কার পান। প্রতিটি ক্রমোজম একেকটি দ্বি-সূত্রক ডিএনএ ফাইবার ও হিস্টোন নামক প্রোটিন দিয়ে তৈরি; অর্থাৎ প্রতিটি ক্রমোজম একেকটি নিউক্লিওপ্রোটিন।

ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড বা ডিএনএ হলো হিস্টোন নামের প্রোটিনের চার দিকে ঘুড়ির নাটাইয়ের সুতার মতো করে পেঁচানো কোটি কোটি নিউক্লিওটাইড অণুর তৈরি একটি ডাবল ফাইবার চেইন। এখানে হিস্টোন নামের প্রোটিনটি মূলত ঘুড়ির নাটাইয়ের ভূমিকায় আর নিউক্লিওটাইডের লম্বা চেইন দু’টি মিলে একটি সুতার ভূমিকায়। বেজ পেয়ারের ৯৯.৯ শতাংশেরও বেশি মানুষের জিন একই রকম। বাকি ১ শতাংশেরও কম ভ্যারিয়েশনের কারণেই মানুষে মানুষে এত পরিবর্তন। এখানে প্রকৃতি জানিয়ে দিচ্ছে, আমাদের ডিএনএর জিনেও মানুষের মাঝে ৯৯ শতাংশেরও বেশি মিল, সে জন্য বাকি যে অমিলটুকু আছে তা-ও দূর করে ফেলাটাই হলো ন্যাচারাল বিষয়। তা ছাড়া জিনসমৃদ্ধ ডিএনএ মোট ডিএনএর মাত্র ১-৩ শতাংশ।

একটি অক্ষর আরেকটি অক্ষরের সাথে মিলে যেভাবে একটি অর্থপূর্ণ শব্দ হয়, তেমনি একটি নাইট্রোজেন বেজ আরেকটি নাইট্রোজেন বেজের সাথে অক্ষরের মতো অর্থপূর্ণভাবে মিলিত হয়ে যে ডিএনএ সিকুয়েন্স তৈরি করে, তা-ই মূলত ডিএনএর ভাষা। সে তার ভাষায় বলে দেয় কখন কোথায় কিভাবে কতটুকু প্রোটিন তৈরি করতে হবে। কোনো প্রোটিন তৈরি করতে হলে ডিএনএ সরাসরি অংশগ্রহণ না করে জিনের নির্দেশে মেসেঞ্জার আরএনএ তৈরি করে। এই মেসেঞ্জার আরএনএ মেসেজ নিয়ে সাইটোপ্লাজমে যায় এবং রাইবোজমকে বলে প্রোটিন তৈরি করে দিতে। আরএনএ হলো পুরো একটি মইয়ের লম্বালম্বিভাবে অর্ধেক অংশ মাত্র। ডিএনএর সাথে আরেকটি বড় পার্থক্য হলো আরএনএর বেজ তৈরিতে অন্য তিনটি বেজ ডিএনএএর মতো ঠিক থাকলেও মাত্র একটি বেজ যা থাইমিনের পরিবর্তে ইউরোসিল থাকে।

আমরা জানি, ডিএনএর উৎস হলো দু’টি- একটি হলো নিউক্লিয়াস, অপরটি হলো মাইটোকন্ড্রিয়া। নিউইয়াসের ডিএনএর প্রতিটি বেজ পেয়ারের একটি অংশ আসে মা থেকে এবং অন্য অংশটি আসে বাবা থেকে। অর্থাৎ আমরা যে দ্বি-সূত্রক ডিএনএ দেখি তাতে মা-বাবার অংশগ্রহণ ফিফটি ফিফটি। কিন্তু মানবদেহের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ আসে পুরোপুরি মায়ের কাছ থেকে। বিস্ময়কর ব্যাপার- আলট্রামলিকুলার লেভেলেও সৃষ্টির জোড়া তত্ত্বের অস্তিত্ব খুঁজে পাই। যেমনটি পবিত্র কুরআনের সূরা নাবার ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায়’। দেখা যাচ্ছে সৃষ্টির জোড়া তত্ত্বের প্রয়োগ আলট্রা মলিকুলার লেভেল থেকেই শুরু হয়েছে। প্রতিটি নিউক্লিওটাইড অণুর তিনটি অংশ- এক অণু ডি-অক্সিরাইবোজ সুগার, এক অণু ফসফেট এবং আংটির মতো আকৃতির এক অণু নাইট্রোজেনাস বেজ। নাইট্রোজেনাস বেজ বা ক্ষার চার ধরনের- এডেনিন, গোয়ানিন, সাইটোসিন ও থাইমিন।

এক অণু নিউক্লিওটাইড গঠিত হয় এক অণু সুগার, এক অণু ফসফেট এবং চারটি বেজ বা ক্ষার এর যেকোনো একটি বেজ দিয়ে। নিওক্লিওটাইড অণুটিকে অনেকটা ইংরেজি ক্যাপিটাল ‘এল’ অক্ষরের মতো করে ব্যাখ্যা করা যায়, যার দুই বাহুর মিলন বিন্দুতে থাকে যদি এক অণু সুগার, বিন্দুর দুই সাইডে লাগানো দু’টি বাহুর একটি হলো এক অণু ফসফেট, আরেকটি হলো এক অণু বেজ। ফসফেট ও বেজের দু’টি বাহু সুগার বিন্দুর সাথে লম্বালম্বিভাবে যুক্ত থেকে ইংরেজি বর্ণমালা ‘এল’ আকৃতি ধারণ করে। একটি ‘এল’ মানে নিউক্লিওটাইডের একটি অণু (সুগার, ফসফেট, বেজ)। এভাবে একটি ‘এল’ মানে এক অণু নিউক্লিওটাইড আরেকটি ‘এল’-এর সাথে যুক্ত হয়ে লম্বা চেইন আকারে লক্ষ-কোটি নিউক্লিওটাইডের একটি পলিনিউক্লিওটাইডের লম্বা চেইন হয়। এ রকম দু’টি চেইন তৈরি হয়। পুঁতির মালার মতো একটার পর একটা যুক্ত হয়ে তৈরি হওয়া দু’টি চেইনই হিস্টোনের চার দিকে পেঁচিয়ে নিউক্লিক এসিডের একটি অণু গঠিত হয়, যা সংক্ষেপে ডিএনএ নামে পরিচিত। নিউক্লিওটাইডের চেইনটি থাকে অনেক লম্বা। হিস্টোনের চার দিকে পেঁচানোয় অল্প জায়গায় অনেক লম্বা চেইন জায়গা করে নেয়। নিউক্লিওটাইডের অণু থেকেই মূলত মানুষের ‘জিন’ তৈরি হয়। কিন্তু নিউক্লিওটাইডের সব অণুই ‘জিন’ গঠনে অংশগ্রহণ করে না। প্রতিটি ডিএনএর যে অংশ প্রোটিন উৎপাদনের নির্দেশিকা বহন করে তাদেরই জিন বলে। এই জিনের আকার ছোট-বড় আছে। একেকটি জিন এক হাজার থেকে ২০ লাখ বেজ পেয়ার দিয়ে হয়ে থাকে। তবে গড়ে ২৭ হাজারটি নিউক্লিওটাইডের অণুর বেজ পেয়ারের সমন্বয়ে তৈরি হয় একটি মানব জিন। মানবদেহের পুরো জিন তৈরিতে ডিএনএর মাত্র এক-দুই শতাংশ বেজ পেয়ার ব্যবহৃত হয়। একটি ক্রমোজম বা ডিএনএতে দুই হাজার থেকে দুই হাজার ১০০টি পর্যন্ত জিন থাকে। একটি কোষের ২৩ জোড়া ক্রমোজমে ২০ হাজার জিন থাকতে পারে।

ডিএনএ অণুটিকে যদি অন্যভাবে ব্যাখা করা হয় তা হলে বলতে হয়, ডিএনএ নিউক্লিওটাইড নামক অণু দিয়ে গঠিত। প্রতিটি নিউক্লিওটাইড অণুতে তিনটি উপাদান থাকে- একটি ফসফেট গ্রুপ যার একটি ফসফরাস চারটি অক্সিজেন পরমাণুর সাথে সংযুক্ত থাকে; একটি ডি-অক্সিরাইবোজ সুগার অণু এবং চারটির যেকোনো একটি নাইট্রোজেন বেজ। চার ধরনের নাইট্রোজেন বেজ অ্যাডেনিন (এ), থাইমিন (টি), গুয়ানিন (জি) ও সাইটোসিন (সি) একসাথে ডিএনএর ভাষা তৈরির ‘অক্ষর’ হিসেবে কাজ করে। এই চারটি ‘অক্ষর’ বা বেজ একটি নির্দিষ্ট নিয়মে সংযুক্ত হয়ে ডিএনএর ভাষা তৈরি হয়, যার মাধ্যমে তারা সঙ্কেত পাঠায় প্রোটিন তৈরির।

নিউক্লিওটাইডগুলো একটার সাথে আরেকটার একসাথে সংযুক্ত করে দু’টি দীর্ঘ সুতা তৈরি করে, যা সর্পিল হয়ে একটি কাঠামো তৈরি করে যার নাম ডাবল হেলিক্স। যদি ডাবল হেলিক্স গঠনটিকে একটি মইয়ের সাথে তুলনা করা হয়, ফসফেট এবং ডি-অক্সিরাইবোজ সুগার অণুগুলো মইয়ের পাশে অবস্থান করে এর ব্যাকবোন তৈরি করে এবং বেজ জোড়াগুলো হবে দু’টি ব্যাকবোনকে একত্রে ধরে রাখার দণ্ড, যা দু’টি ব্যাকবোনকে একত্রে ধরে রাখে। একটি ব্যাকবোন আরেকটি ব্যাকবোনের সাথে বেজ পেয়ার দিয়ে আঁটোসাঁটো করে বাঁধা থাকে। বেজ পেয়ারের এই বাঁধানোরও একটা নিয়ম আছে। আর তা হলো এডেনিন বেজের সাথে থাইমিন বেজের জোড়া (এ-টি) এবং গুয়ানিন বেজের সাথে সাইটোসিনের জোড়া (জি-সি)। একেক জিনের একেক কাজ। এ রকম অসংখ্য জিন থাকে একটি ডিএনএ অণুতে যাদের বলা হয় জেনেটিক মেটারিয়াল।

একটি কোষের পুরো নিউক্লিক এসিড চেইনটিতে যে কমপ্লিট সেট জিন থাকে, সে কমপ্লিট সেট অব জিনকে একত্রে জেনোম বলে। মানুষের জেনেটিক ইনফরমেশন ট্রান্সফার সিস্টেম এতটাই শক্তিশালী যে, ৮০০ মিলিয়ন বছর পর্যন্ত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জেনেটিক ইনফরমেশন ট্রান্সফার করতে পারে। একটি মানব কোষে ২৩ জোড়া ক্রমোজম আছে। কোষের ডিএনএ হলো হার্ডওয়্যার এবং এর ভেতর সংরক্ষিত সব নির্দেশনা হলো সফটও্যয়ার। সে হিসাবে মহাবিশ্বও কম্পিউটারের মতোই। কারণ মহাবিশ্বের সব গ্রহ নক্ষত্র হলো হার্ডওয়্যার আর এর মধ্যকার যে ন্যাচারাল বিধান যার কারণে এরা প্রতিনিয়ত ঘুরছে নিজস্ব কক্ষপথে তার সবই সফটওয়্যার। মানব জিন ডিএনএর একটি খণ্ডাংশ মাত্র। একটি ডিএনএ হলো চারটি বিভিন্ন ধরনের নিউক্লিওটাইড সাব-ইউনিটেরই একটি লম্বা চেইন মাত্র যা লম্বালম্বিভাবে মেলে ধরলে পাঁচ সেন্টমিটার লম্বা হবে। একটি মানব কোষে থাকা ৪৬টি ক্রমোজমকে একত্র করলে হবে দুই মিটার লম্বা। এভাবে একজন মানুষের সব কোষ মিলে যতগুলো ক্রমোজম আছে তার সবই লম্বালম্বিভাবে একত্র করলে হবে ১১০ বিলিয়ন মাইল লম্বা যা পৃথিবী থেকে সূর্যের ৯ কোটি ৩০ লাখ মাইল দূরত্ব ৬০০ বার যাতায়াত করা যাবে।

ডিএনএ’র কাজ কি
ডিএনএর মধ্যে থাকা ‘জিন’ তিন ধরনের কাজ করে থাকে। প্রথমত, জেনেটিক্যালি উত্তরাধিকারীর চরিত্র নির্ধারণ; দ্বিতীয়ত, ইমিউনোলজিকাল এবং তৃতীয়ত, স্ট্রাকচারাল বা কাঠামোগত পদার্থ যেমন- নানান প্রোটিন তৈরির নির্দেশনা। দেখা যাচ্ছে, একজন মানুষের জেনেটিক কনস্টিটিউশন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং শরীর গঠনের ক্ষমতা একেবারে মেয়েদের ওভাম আর ছেলেদের স্পার্ম নিষিক্তকরণের ক্ষণ থেকেই পেয়ে থাকে। তবে ডিএনএর মূল কাজ হলো প্রোটিন তৈরির বায়োলজিক্যাল ব্লুপ্রিন্ট জমা করে রাখা। বুক অব জেনেসিসের ১:২১-২৫ অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে, ‘প্রতিটি জীবন্ত প্রাণী তার মতো করে প্রাণীর পুনরুৎপাদন করে’ যার জন্য শিশুরা তাদের পিতা-মাতার মতো হয়। ডিএনএ আক্ষরিক অর্থে, পুরো জীবন পরিচালনার নীলনকশা। একটি ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে, আপনি খুঁজে পেতে পারেন, বিশ্বের কোন অঞ্চলে আপনার পূর্বপুরুষরা শত থেকে হাজার বছর আগে বসবাস করতেন, কেন ও কোথায় তারা স্থানান্তরিত হয়েছেন।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, আপনি যদি প্রতি মিনিটে ৬০ শব্দ, দিনে আট ঘণ্টা টাইপ করতে পারেন, তা হলে মানুষের জিনোম টাইপ করতে প্রায় ৫০ বছর সময় লাগবে। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীদের ধারণা, ডিএনএর বেজ পেয়ারে এত কনসেন্ট্রেটেড ফর্মে ইনফরমেশন জমা থাকে যে, এক মিলিয়ন বেজ পেয়ারের স্টোরেজ ক্ষমতা কম্পিউটারের এক মেগাবাইটের সমান। তিন বিলিয়ন বেজ পেয়ারে ইনফরমেশন স্টোরেজের জন্য কম্পিউটারের তিন গিগাবাইটের সমপরিমাণ স্পেস হলেই চলে। এ পর্যন্ত দুনিয়াতে যত লোক এসেছে, যত লোক এখন আছে এবং যত লোক কিয়ামত পর্যন্ত আসবে তত লোকের ডিএনএতে জমা ইনফরমেশনকে মাত্র এক আধুলি পরিমাণ হার্ডডিস্ক জায়গাতেই সংরক্ষণ করা যাবে। এক গ্রাম ডিএনএতে এক বিলিয়ন টেরাবাইট ইনফরমেশন জমা থাকে। (এক টেরাবাইট = এক হাজার গিগাবাইট)। ডিএনএ অণুর স্ট্র্যান্ডে এনকোড করা এত তথ্য আছে যে, মানব জীবনের সব কর্মকাণ্ড স্টোর করা এ তথ্য পড়ে আমাদের শরীরকে বিভিন্ন কাজের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিনের জোগান দেয়। ঠিক যেমন একটি কম্পিউটার হার্ডড্রাইভ থেকে তার নির্দেশাবলি পড়ে। আমরা জানি বাইনারি কোড হলো কম্পিউটার ও ইলেকট্রিক ডিভাইসের ভাষা। শূন্য ও এক সংখ্যাগুলো দিয়ে গঠিত হয় কম্পিউটারের বাইনারি কোড।

ঠিক তেমনি ডিএনএর আণবিক কোড, এ, টি, জি, সি অক্ষরগুলো হলো ডিএনএর ভাষার অক্ষর। এসব অক্ষর সমন্বয়ে গঠিত নির্দিষ্ট ক্রম দিয়ে গঠিত বেজ পেয়ার হলো ডিএনএর ভাষা। কম্পিউটারের ইলেকট্রনিক ডিভাইসে সব তথ্য জমা থাকে আর ডিএনএর মধ্যকার বায়োকেমিক্যাল ডিভাইসের বেজ পেয়ারে জমা থাকে জেনেটিক কোড হিসেবে সব তথ্য। ক্রমোজম আছে শুধু পড়া যায় এমন একটি ডাটা স্টোরেজ বায়োকেমিচাল ডিভাইস। সুতরাং ডিএনএ হলো একটি উচ্চ প্রযুক্তি তথ্য সঞ্চয় করার যন্ত্র। এটি এমন একটি তথ্য সঞ্চয় যন্ত্র, যা মানব জাতির উদ্ভাবিত সব কিছুকে হার মানিয়ে গেছে। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে সাইন্স জার্নালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেছেন এই বলে যে, ডিএনএ হলো প্রকৃতির সবচেয়ে ঘন এবং স্থিতিশীল বায়োকেমিক্যাল তথ্য বক্স।

ডিএনএ তথ্য সংরক্ষণের স্টোর হাউজ। পুরো হিউমান জেনোম হলো একটি বই, ৪৬টি ক্রমোজম হলো এক একটি অধ্যায় আর জিনগুলো হলো বিভিন্ন রেসিপি। জিনের সাইজ অনুপাতে মেসেঞ্জার আরএনএ থেকে শুরু করে একটি প্রোটিন তৈরি হতে মাত্র ২০ সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট সময় লাগে। রাইবোজম হলো প্রোটিন তৈরির ফ্যাক্টরি। জিনের আকারের ওপর নির্ভর করে, এমআরএনএ থেকে একটি সাধারণ প্রোটিন অণু তৈরি করতে ২০ সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট সময় লাগে। একাধিক রাইবোজম একই এমআরএনএ স্ট্র্যান্ডের ওপর কাজ করতে এবং একসাথে একাধিক প্রোটিন তৈরি করতে পারে। প্রতিটি কোষে এক কোটি পর্যন্ত রাইবোজম রয়েছে, যা অন্যান্য কোষের সাথে চাহিদা অনুযায়ী প্রোটিন তৈরি করে। এ ডেনিন সব সময় থাইমিন বেজের সাথে হাইড্রোজেন বন্ড দিয়ে যুক্ত থেকে বা জোড়া তৈরি করে মইয়ের একেকটি স্টেপ তৈরি করে আবার গুয়ানিন সর্বদা সাইটোসিনের সাথে হাইড্রোজেন বন্ড দিয়ে জোড়া তৈরি করে মইয়ের আরেকটি ধাপ তৈরি করে। এভাবে একেকটি বেজ পেয়ার মইয়ের একেকটি ধাপ তৈরি করে দুই সাইটেই ফসফেট আর সুগার দিয়ে মইয়ের ব্যাকবোন তৈরি হয়ে যায়। বেজ পেয়ারের মধ্যেই অর্থাৎ নিউক্লিওটাইড বেজ পেয়ারেই সব তথ্য জমা থাকে যার ভূমিকা কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের মতোই।

মইয়ের ধাপ বা বেজ দুই সাইটেই সবসময় সুগারের সাথে যুক্ত হয়। এই সুগারের সাথে আবার দু’টি ফসফেট যুক্ত হয়ে মইয়ের সাইট তৈরি করে ফেলে। এখানে নাইট্রোজেনাস বেজ+সুগারের সংযুক্তিকে একত্রে নিউক্লিওসাইড আর বেজ+সুগার+ফসফেটকে একত্রে নিউক্লিওটাইড বলে। একটি কোষের নিউক্লিয়াসে থাকা ক্রমোজম তৈরি হতে লাগে হিস্টোন নামের একটি প্রোটিন যাকে পেঁচিয়ে রাখে ডান থেকে বামে ঘূর্ণায়মান একটি মই, যে মইয়ে থাকে পাঁচ থেকে ২৫ কোটি বেজ পেয়ার। আমাদের একটি কোষের পুরো জেনোমে তিন বিলিয়ন বেজ পেয়ার থাকে।

ডিএনএর তিনটি বেজ পেয়ার মিলে একটি কোডন হয়, যা মূলত অ্যামাইনো এসিড তৈরির কোড যেখান থেকে তৈরি হয় নির্দিষ্ট প্রোটিন। এই কোডন আবার দুই রকম। একটি স্টার্ট কোডন যা মূলত প্রোটিন তৈরিতে অংশ নেয়। আরেকটি কোডন হলো স্টপ কোডন যারা প্রোটিন তৈরিতে অংশ নেয় না। কোডন হলো তিনটি নিউক্লিওটাইডের একটি ডিএনএ বা আরএনএ ক্রম যা একটি নির্দিষ্ট এসিড এনকোডিং বা প্রোটিন সংশ্লেষণ করার সঙ্কেত করে জিনোমিক তথ্যের একটি ইউনিট গঠন করে। এ রকম ৬৪টি ভিন্ন কোডন রয়েছে যার ৬১টি অ্যামাইনো এসিড নির্দিষ্ট করে।

ডিএনএর সাজানো বেজ পেয়ারের এক বা একাধিক পরিবর্তনই হলো মিউটেশন। একটি ক্রমোজমের ডিএনএ বেজ পেয়ারের মাত্র ২-৩ শতাংশ জায়গা দখল করে থাকে মানুষের জিন। একটি জিন ডিএনএর খণ্ডাংশ মাত্র যা গড়ে ১০-১৫ হাজার বেজ পেয়ার দিয়ে তৈরি। ডিএনএর যে অংশে জিন থাকে তা এক্সন ও ইন্ট্রন এই দুই ভাগে বিভক্ত। এক্সন অংশেই মূলত প্রোটিন তৈরির কোড থাকে কিন্তু ইন্ট্রন অংশকে জাংক ডিএনএ বলা হয়ে থাকে যারা প্রোটিন তৈরির কাজের রেগুলেটরের ভূমিকা পালন করে। মানুষের পুরো জেনোমে ২০-২৫ হাজার জিন থাকে। ফরেনসিক মেডিসিনে ডিএনএ বিশ্লেষণ করতে সাধারণত ১৩টি লোকেশনের নির্দিষ্ট ডিএনএ মার্কার (ডিএনএ সেগমেন্ট) দেখা হয়। দুই ব্যক্তির ১৩টি লোকেশনের ডিএনএ প্রোফাইল একই থাকবে এমন সম্ভাবনা এক বিলিয়নের মধ্যে একটি মাত্র। এভাবে দুই ব্যক্তির ডিএনএ আলাদা করে চেনা যায়।

ডিএনএ ফিগারপ্রিন্টেও ডিএনএ মার্কার ব্যবহার করা হয়, কারণ আইডেন্টকাল টুইন ছাড়া দুনিয়ার কারো সাথে কারো ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলবে না। তবে মা-বাবার সাথে ছেলেমেয়েদের ও ভাইবোনদের সাথে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ৫০ শতাংশ মিলে যাবে। পলিমারেজ চেইন রিয়েকশন ব্যবহার করে ডিএনএকে বহুগুণে বর্ধিত করে রোগ নির্ণয়ের কাজে ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়াও পিতৃত্ব নির্ণয়, অপরাধী শনাক্ত করা, নিরপরাধীকে শনাক্ত করে মুক্তি দেয়া এবং শস্যের পিউরিটি নির্ণয়সহ আরো বহু কাজে ডিএনএকে ব্যবহার করা হয়।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ডিপার্টমেন্ট অব হিস্টোপ্যাথলজি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি, শের-ই-বাংলা নগর, ঢাকা

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com