ইউরোপের অচ্ছুত আচরণ আর চিরাচরিত বর্ণবাদ থেকে রেহাই পায়নি কাতার বিশ্বকাপ। সব ষড়যন্ত্র আর প্রোপাগান্ডা ব্যর্থ করে কাতার বিশ্বকাপ সফল। ফিফা সভাপতির সার্টিফিকেট হলো কাতার বিশ্বকাপ সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপ। সৌন্দর্য, আয়োজন, সাম্য, আতিথেয়তার কমতি নেই কোথাও। সমকাম, অ্যালকোহলসহ অনৈসলামিক সকল কাজ নিষিদ্ধ করেও যে বৈশ্বিক ইভেন্ট সুন্দরভাবে করা যায় সেই উদাহরণ সৃষ্টি করলো কাতার।
পশ্চিমের কাছে কাতার পৌঁছে দিতে পেরেছে ইসলামের সামাজিক রিচুয়াল। পশ্চিমা মিডিয়া তাদের জনগোষ্ঠীর কাছে শতাব্দী ধরে ইসলামকে কদর্যভাবে তুলে ধরে যে জনমত তৈরি করেছে সেটাতে ফাটল ধরাতে পারবে এই আয়োজন। কাতারের এই চেষ্টাকে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ হিসেবে নেয়া যেতে পারে। যারা এর গায়ে ধর্মের রং দিয়ে আবেগ, অনুকম্পা কিনতে চাচ্ছে অথবা বিরোধিতা করছে, তারা মূলত এই সাংস্কৃতিক যুদ্ধে বিজয়ের পথে প্রতিবন্ধকতা করছে। সারা দুনিয়াকে একত্রিত করার মতো ইভেন্টকে কাতার যেভাবে কাজে লাগিয়েছে, ইউরোপে হলে করতো তার উল্টো।
খেলা কখনোই ধর্মের অংশ না। সংস্কৃতির অংশ। ইতিহাসের নির্মাণকে টিকিয়ে রাখে সংস্কৃতি। সংস্কৃতির সৌন্দর্য বাড়ে বা কমে ধর্মের প্রভাবে। ফুটবলকে কেন্দ্র করে বাকি যে চর্চাগুলো বহাল আছে সেগুলো কাতারে যেভাবে উদযাপিত হচ্ছে অন্যকোনো অমুসলিম দেশে সেভাবে হতো না এবং দুয়ের পার্থক্যও বিরাট।
বাংলাদেশের সমর্থকদের দুটি বড় অংশ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলে বিভক্ত। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলে ঘুরেফিরে আবেগ আর ফুটবলীয় সাফল্য ও সৌন্দের্যের নানান কথাই ঘুরে ফিরে আসবে।
যদি মরক্কোর কথা বলি, তাহলে এই দুই দলের বেশিরভাগই ঐক্যবদ্ধভাবে মরক্কো সাপোর্ট করবে। তবে সেখানে মরক্কোর ফুটবলের সাথে উঠে আসবে মরক্কোর ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। ফুটবলকে ছাড়িয়ে মরক্কোর ইতিহাসের উত্থান-পতন, ভাঙ্গা-গড়া, সুখ-দুখ, যুদ্ধ-উপনিবেশ। আলোচনায় আসবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইউরোপের অত্যাচার আর নিষ্পেষণের ইতিহাস।
প্রতিযোগিতার দ্বন্দ্বের সীমানা সুতা দিয়ে বাধা যায় না। তার ওপর যদি থাকে ইতিহাসের পাতায় পাতায় রক্তাক্ত গল্প ও গাঁথা। আফ্রিকাকে এখনো লুটেপুটে খাচ্ছে ফ্রান্স। স্পেন তো ৫০০ বছর ধরে মরক্কোর দুটি শহর সিউটো আর মেলিল্লা আজো দখল করে আছে। ইউরোপের কুখ্যাত কলোনিয়াল ইতিহাস পড়ে পড়ে বড় হওয়া কয়েক প্রজন্মের ভেতরে জন্ম নিয়েছে ঔপনিবেশিক চর্চা। এরকম পরিস্থিতিতে সকল ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ফলাফলের জয় বিজয়ে রক্তক্ষরণের ইতিহাস আসবেই।
মরক্কোর প্লেয়াররা অনেকে ইউরোপের নাগরিক। ইউরোপের ক্লাবে খেলে থাকেন। ইউরোপের বিরুদ্ধে বিজয়ের পরে হাতে তুলে নেন ফিলিস্তিনের পতাকা। কারণ ফিলিস্তিন আর মরক্কো এখনো দখলদারদের দেওয়ালে আটকা পড়ে আছে। আরবরা ইতিহাসকে কতখানি ধারণ করেন, শিকড় কিভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হয়- সেটারই প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায় এই পতাকা প্রদর্শনে। আমরা আরবদের এতদিন দেখে এসেছি রাজতন্ত্রের মিডিয়ার চোখ দিয়ে। কিন্তু কাতার বিশ্বকাপে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখাচ্ছে ভিন্নচিত্র।
খেলার জয়-পরাজয় নিছকই খেলার মধ্যে আর থাকে না। মরক্কো স্বাধীন হয়েছে স্পেন ও ফ্রান্স থেকে। ইউরোপকে হারানোর মধ্য দিয়ে আফ্রিকা তাদের বিজয় দেখছে। আরবরা দেখছে তাদের বিজয়। মরক্কোর বিজয় যেন আফ্রিকা, আরবসহ সকল মজলুমের বিজয়। কথা উঠতে পারে এটাতো খেলা। তবে এই খেলার প্রধান তথা ফিফা প্রধান ইউরোপীয়ান ব্যক্তিত্ব জিয়ান্নি ইনফান্তিনো বলেছেন, বিগত তিন হাজার বছর ইউরোপ যে অন্যায় করেছে সেই অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত আগামী তিন হাজার বছর করতে হবে। ইউরোপীয়ান মিডিয়ায় আরব ও আরব সংস্কৃতি বিদ্বেষ এবং নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে গিয়ে নানান মিথ্যাচার ইতোমধ্যে করেছে, ক্ষমাও চেয়েছে। অবহেলিত, নির্যাতিত ফিলিস্তিনের প্রতি খেলা দেখতে আসা আন্তর্জাতিক দর্শকদের আবেগ আর ভালোবাসার সত্যায়িত স্বরূপ দেখেছে দুনিয়া। মরক্কো যতদিন এই মঞ্চে টিকে থাকবে ততদিন এইসব আলোচনা ঘুরেফিরে আসবেই।
আজ মরক্কোর খেলা। প্রতিপক্ষ ফ্রান্স। আকাঙ্ক্ষা থাকবে খেলার বিজয় উদযাপনের ভেতর দিয়ে সভ্যতার সঙ্ঘাতের ইতিহাসের ঝাঁপি খুলে যাবে দুনিয়ার কাছে। নানানভাবে লেখা হবে বিজয়গাঁথা। সেখানে ইতিহাস আসবে অবধারিতভাবে। ফলাফল যাই হোক মরক্কো হৃদয় কেড়েছে সবার। ফিলিস্তিনের প্রতি সহমর্মিতা তাদের নিয়ে গিয়েছে অনন্য এক উচ্চতায়। দুনিয়ার ভালোবাসা আর অনন্য উচ্চতার শিখরে থাকা মরক্কো যদি হেরেও যায়। তাতে কিছুই আসে যায় না। যদি নিগৃহীত লাতিন আমেরিকা আর আফ্রিকা মুখোমুখি হয় ফাইনালে। তবে সেটা হবে বিশ্বফুটবলের ইতিহাসে সৌন্দের্যের মহাকাব্য।