রোজা ও রমজান মাস পুরোটাই বরকতময়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, রোজা আমার জন্য, আমি নিজ হাতে এর প্রতিদান দেবো অথবা আমি নিজেই এর প্রতিদান। (বুখারি, ৭৪৯২) রোজার কাক্সিত ফল পেতে হলে আমাদের তা যথাযথভাবে আদায় করতে হবে। রোজার সাথে এমন কিছু আমল আছে যা আমরা অজানা বা অবহেলায় পরিত্যাগ করছি। এমন কিছু কাজ বা আমল নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
১. ঝগড়া করলে বলতে হবে ‘আমি রোজাদার’ : রোজা অবস্থায় কেউ গালি দিলে করণীয় কী? এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে- আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কারো রোজার দিন হবে, সে যেন অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ না করে ও হৈ-হট্টগোল না করে। আর যদি কেউ গালাগালি করে অথবা তার সাথে লড়াই ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে যে, ‘আমি রোজাদার।’ (সহিহ বুখারি-১৮৯৪)
২. রোজায় শ্রমিকদের কাজ হালকা করে দেয়া : অধীনস্থ লোকদের রোজা অবস্থায় কাজের চাপ কমিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে হাদিসে। এটি একটি উত্তম আমল, এতে গুনাহ মাফ হয়। সালমান আল ফারসি থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, শাবান মাসের শেষ দিনে রাসূল সা: আমাদেরকে উদ্দেশ করে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, হে লোক সকল! একটি মহিমান্বিত মাস তোমাদেরকে ছায়া হয়ে ঘিরে ধরেছে। এ মাস একটি বরকতময় মাস… যে ব্যক্তি এ মাসে তার অধীনস্থদের ভার-বোঝা সহজ করে দেবে, আল্লাহ তাকে মা করবেন। তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেবেন। (য‘ঈফ আত্ তারগিব ৫৮৯)
৩. সাহরিতে খেজুর খাওয়া : সাহরিতে আমরা অনেক ধরনের খাবার খেয়ে থাকি। কিন্তু রাসূল সা: খেজুর খেতেন। রাসূল সা: বলেছেন : মু’মিনের জন্য সাহরির উত্তম খাবার হলো খেজুর। (আবু দাউদ-২৩৪৫) দুঃখের সাথে বলতে হয়, সাহরিতে খেজুর খাওয়ার এ সুন্নাতটি আমাদের মাঝে নেই বললেই চলে।
৪. ইফতারের সময় দোয়া করা : হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তিন ব্যক্তির প্রার্থনা ফিরিয়ে দেয়া হয় না। তাদের মধ্যে একজন হলেন রোজাদার ব্যক্তি। ‘ইফতারের সময় রোজাদারের জন্য এমন একটি দোয়া রয়েছে যা ফিরিয়ে দেয়া হয় না।’ (ইবনে মাজাহ, হাকিম)
৫. সব রাতে শবেকদর অনুসন্ধান করা : রমজানের শেষ দশকের যেকোনো রাত কদরের রাত। আয়িশা রা: থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সা: রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন এবং বলতেন, তোমরা রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো। (সহিহ বুখারি-২০২০) আমাদের দেশে জাঁকজমকের সাথে ২৭ তারিখের রাত্রিকে লাইলাতুল কদরের রাত হিসেবে পালন করা হয়। এভাবে মাত্র একটি রাতকে লাইলাতুল কদর সাব্যস্ত করার কোনো হাদিস নেই।
৬. বিশ রমজানের পর ইবাদতে বেশি মনোযোগী হওয়া : রমজান পুরোটাই মুবারকময়। বিশেষ করে শেষ দশক। হাদিসে এসেছে- আয়িশা রা: থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, যখন রমজানের শেষ দশক আসত তখন নবী সা: তাঁর লুঙ্গি কষে নিতেন (বেশি বেশি ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত জেগে থাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন। (সহিহ বুখারি-২০২৪) আর আমরা ২০ রমজানের পর ঈদকেন্দ্রিক ব্যস্ততা বাড়িয়ে দিই, ইবাদত বন্দেগি কমিয়ে দিই। দুঃখের সাথে বলতে হয়, রমজানের শেষের দিকে কেউ কেউ তারাবিহ সালাতও পড়ার সময় পান না।
৭. ইতিকাফ করা : আয়িশা রা: থেকে বর্ণিত : নবী সা: রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ করতেন। তার ওফাত পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল। এরপর তার সহধর্মিণীরাও (সে দিনগুলোতে) ইতিকাফ করতেন। (সহিহ বুখারি-২০২৬) ইতিকাফকে তিনি খুবই গুরুত্ব দিতেন। এখন তো আমাদের সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত আমলে পরিণত হয়েছে ইতিকাফ। রাসূল সা: ছিলেন মদিনার রাষ্ট্রপতি, তারপরেও তিনি ইতিকাফ করেছেন। রাষ্ট্রপতির চেয়েও কি আপনি বেশি ব্যস্ত?
৮. মহিলাদের ইতিকাফ করা : আয়িশা রা: থেকে বর্ণিত : নবী সা: ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকেই ইতিকাফ করতেন। তাঁর ইন্তিকালের পর তাঁর সমধর্মিণীরাও ইতিকাফ করতেন। (সহিহ বুখারি-২০২৬)
৯. রোজা থেকে শিা গ্রহণ করা : অন্যান্য ইবাদতের মতো রোজার মধ্যে আমাদের জন্য শিণীয় অনেক বিষয় রয়েছে। আমাদের জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে হলে এসব শিা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। এক. হারাম থেকে দূরে থাকা। দুই. তাকওয়া অর্জন। তিন. সহানুভূতি প্রদর্শন। চার. লৌকিকতা বর্জন করে একনিষ্ঠতা অর্জন করা। পাঁচ. সবর বা ধৈর্য ধারণ। ছয়. কুপ্রবৃত্তি দমন। সাত. ভ্রাতৃত্বের বন্ধন মজবুত করা। আট. ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। নয়. সম্প্রীতি অর্জন। দশ. মানুষকে আহার করানো। এগারো. সুন্দর আচরণ। রোজা থেকে এসব শিা গ্রহণ করে সারা বছর জারি রাখতে হবে। তবেই রোজা হবে সার্থক।
লেখক : কলেজ শিক, সভাপতি,
বাংলাদেশ সাহিত্য ছাউনি