মুদ্রাপাচার বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় একটি উদ্বেগের কারণ। প্রতি বছর বিপুল অর্থ ধনী দেশগুলোতে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। ২০৩০ সালে মুদ্রা পাচারের পরিমাণ ১৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আভাস দেয়া হচ্ছে। দারিদ্র্যপীড়িত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য এটা একটা বড় সঙ্কট। এ নিয়ে অনেক দেশের নেতারা ইতোমধ্যে কথা বলেছেন। কিন্তু কার্যকর প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে ওঠার লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। এ প্রবণতা সে দেশগুলোতে বেশি যেসব দেশে জবাবদিহির বড় অভাব বিদ্যমান। সরকারই কালো অর্থনীতির পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বিকাশমান। যেভাবে মুদ্রা পাচার হচ্ছে তাতে নির্দ্বিধায় বলা যায়, এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষের কোনো কাজে আসবে না।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির এক প্রকাশনায় বাংলাদেশের বিপুল মুদ্রা পাচারের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির বরাতে সিপিডি জানাচ্ছে, ২০৩০ সালে মুদ্রাপাচার এক হাজার ৪১৩ কোটি ডলারে পৌঁছতে পারে। মুদ্রা পাচারের ব্যাপারটি যদি আমরা লক্ষ করি তাহলে দেখা যাবে, সরকারের সাথে এর গভীর যোগসূত্র রয়েছে। বিশেষ করে সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ ও মেয়াদ শেষকে টার্গেট করে মুদ্রা পাচারের গতি বাড়ে-কমে। সাধারণত অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বা কালো টাকা পাচার করে নিরাপদ গন্তব্যে নিয়ে যায় অসাধু ব্যক্তিরা। ক্ষমতার পালাবদল হতে পারে এমন ভীতি থেকে তারা বেশি হারে মুদ্রা ধনী দেশগুলোতে পাঠায়। আবার সরকারের আনুকূল্য পেয়েও তারা এমনটি করে থাকে। বিশেষ করে আমদানি রফতানির আড়ালে অর্থপাচার বেশি হয়ে থাকে। ২০১৩ সালে সাড়ে ৯০০ কোটি ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে। বৈশ্বিক সূচকে অর্থ পাচারের তালিকায় বাংলাদেশ বিগত এক দশকে উপরের দিকে রয়েছে।
সরকারের তরফ থেকে উন্নয়নের বিপুল প্রচারণা করা হচ্ছে। অথচ দেশে তিন কোটি ৬০ লাখ মানুষ এখনো দরিদ্র। এর মধ্যে চরম দরিদ্রের সংখ্যা এক কোটি ৯০ লাখ। মধ্যবিত্ত হিসেবে বড় একটি শ্রেণী দেখানো হচ্ছে। বাস্তবে তাদের খাওয়া-পরা ও বাসস্থান মানসম্পন্ন নয়। কিংবা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জোয়ারে তাদের জীবনযাত্রায় দ্রুত টেকসই উন্নতি হচ্ছে এমন কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিশেষজ্ঞরা এ অবস্থায় বলছেন, জাতিসঙ্ঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাংলাদেশ সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে না। খবর হলোÑ সংসার চালাতে মধ্যবিত্তকে ক্রমেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ দিকে বিদেশে সেকেন্ডে হোম ও বেগমপাড়ার পরিধি বাড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতে বাংলাদেশী ধনীদের এই উত্থানের সাথে মুদ্রা পাচারের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। দেশীয় অর্থনীতির উন্নয়নের যে ফল সেটি ড্রেনআউট হয়ে চলে যাচ্ছে ধনী দেশগুলোতে।
উন্নয়নের সুফল জনমানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে সরকারের নীতি বদলানোর অন্য কোনো পথ খোলা আছে বলে আমরা মনে করি না। তাই অর্থনৈতিক অসততার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম দরকার অবৈধ অর্থের কারবারিদের শণাক্ত করা। চিহ্নিত করতে হবে মুদ্রা পাচারকারীদের। পাচার রুটগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো বন্ধ করতে হবে। আর যারা এমন কর্মকাণ্ডে জড়িত তাদের প্রচলিত আইনে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পাচার হওয়া টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। অন্য দিকে দেশের অর্থ পাচার করে বিদেশে গিয়ে অনেকে উন্নত জীবনযাপন করছেন; তাদের সেসব দেশে কালো তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। দেশে দেশে প্রবাসীরা উদ্যোগী হয়ে এমনটি করতে পারলে মুদ্রা পাচারকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।