হজ ইসলামের অতিগুরুত্বপূর্ণ একটি ফরজ ইবাদত। যা পালন করার উদ্দেশ্যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে অসংখ্য মানুষ জমায়েত হয় কাবা শরিফের চার পাশে। এ হজব্রত পালন করার জন্য প্রতিটি মুসলমান উদগ্রীব থাকে এবং সৌভাগ্যবান ব্যক্তিরা চরম আবেগ ও ব্যাকুলতা নিয়ে মক্কার তীর্থভূমিতে আগমন করে। উদ্দেশ্য, করুণাময় মহান প্রতিপালকের দান ও ইহসানে ধন্য হওয়া, পুরস্কার ও প্রতিদানে কৃতার্থ হওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে অনেকে খালি হাতে যায়, আবার খালি হাতেই ফিরে আসে। প্রাপ্তির ঝুলিতে কিছুই পড়ে না। এর কারণ কী? বহু কারণের অন্যতম কারণ হচ্ছে- অবশ্যপূরণীয় অনিবার্য শর্ত তথা পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই হজের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাওয়া। তাই আল্লাহ তায়ালা যাদেরকে হজে বায়তুল্লাহর জন্য কবুল করেছেন তাদের উচিত সফরে রওনা হওয়ার আগেই হজের প্রতি ঐকান্তিক হওয়া এবং সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করা।
মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি : সার্বিক প্রস্তুতির একটি অংশ হচ্ছে, মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করা এবং এ কথা মাথায় রাখা যে, সফল ও সুন্দরভাবে হজ পালন করা একটি শ্রমনির্ভর ও কষ্টসাধ্য বিষয়। ওমরার তাওয়াফ, সাঈ, মিনা, জামারায় পাথর মারা, মিনা থেকে মক্কায় গিয়ে হজের তাওয়াফ, সাঈ ইত্যাদি কার্য সম্পাদন করতে প্রচুর হাঁটাচলা করতে হয়। চাইলে যখন তখন যানবাহন পাওয়া যায় না। থাকা-খাওয়ার জন্যও বহু সমস্যা ও পেরেশানির মুখোমুখি হতে হয়। ইহরাম বাঁধার পর আর মুক্ত স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা যায় না এবং অভ্যস্ত ও নিয়মিত ক্রিয়াকলাপও সম্পাদন করা যায় না; বরং বহু অভ্যস্ত বিষয় পরিহার করে অনভ্যস্ত বিষয় করতে হয় এবং নতুন নতুন কাজ আঞ্জাম দিতে হয়। তাই হজের যাবতীয় অনুষ্ঠান ও আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি থাকতে হবে এবং সুস্থ-সবল শরীরে গন্তব্যে রওনা হতে হবে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘হজের নির্দিষ্ট কয়েকটি মাস আছে। যে ব্যক্তি সেসব মাসে (ইহরাম বেঁধে) নিজের ওপর হজ অবধারিত করে নেয়, সে হজের সময়ে কোনো অশ্লীল কথা বলবে না, কোনো গুনাহ করবে না এবং ঝগড়াও নয়।’ রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যে হজ করবে এবং পাপের কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকবে সে ওই দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে প্রত্যাবর্তন করবে যে দিন সে জন্মগ্রহণ করেছিল।’ (বুখারি-১৫২১)
অর্থের উৎস হতে হবে বৈধ : হজ যেমন একটি শারীরিক ইবাদত তেমনি একটি অর্থনৈতিক ইবাদতও। কষ্ট, ক্লেশ ও শ্রম ব্যয় হওয়ার সাথে সাথে প্রচুর টাকা-পয়সারও প্রয়োজন হয়। তাই হজের সফরে রওনা হওয়ার আগে অর্থনৈতিক প্রস্তুতিও পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে হবে এবং হজ পালনের যাবতীয় ব্যয় হালাল ও বৈধ উৎস থেকে বহন করতে হবে। কেননা ইবাদত-বন্দেগি ও দোয়া-প্রার্থনা কবুলের জন্য হালাল, পবিত্র ও অনুমোদিত রিজিক হওয়া অন্যতম প্রধান শর্ত। হজরত আবু হুরায়রা রা:-এর সূত্রে বর্ণিত- একদিন রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করলেন, ‘হে লোকেরা! নিঃসন্দেহে আল্লাহ পবিত্র। তিনি কেবল পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন। সব রাসূলকে তিনি যে আদেশ দিয়েছেন মু’মিনদেরকেও সেই আদেশ দিয়েছেন।’ আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘হে রাসূলরা! তোমরা উত্তম ও পবিত্র রিজিক আহার করো এবং সৎকর্ম করো। তোমরা যেসব আমল করো আমি সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত।’ (সূরা মু’মিনুন-৫১) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘হে মু’মিনরা! তোমরা হালাল ও উত্তম রিজিক আহার করো, যা আমি তোমাদের দিয়েছি।’ (সূরা বাকারাহ-১৭২) অতঃপর নবীজী এলোকেশী ও ধুলোমলিন হয়ে দীর্ঘ সফরকারী এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যিনি হাত প্রসারিত করে হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রতিপালক! বলতে থাকে।
অথচ তার খাবার হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম এবং হারাম বস্তু দিয়ে প্রতিপালিত। তো এসবের পর কিভাবে তার দোয়া কবুল করা হবে!’ (সহিহ মুসলিম) দুনিয়ার ঝক্কি-ঝামেলা থেকে মুক্ত হওয়া : হজের গুরুত্বপূর্ণ বিধান মূলত প্রেমিক বান্দার রহস্যময় প্রেমকীর্তি। শুভ্র-সুন্দর পোশাক পরে তালবিয়া পাঠ, কাবার চার পাশে তাওয়াফ, সাফা-মারওয়ার মধ্যে সাঈ, মুজদালিফা ও আরাফায় অবস্থান, জমারায় রমি, মিনায় কোরবানি- মহান স্রষ্টার প্রতি নগণ্য সৃষ্টির প্রেম নিবেদনমূলক এসব কীর্তি একজন মানুষ নিবিষ্টচিত্তে তখনই আদায় করতে পারে যখন দুনিয়ার সব ঝামেলা ও ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর ঘর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। তাই দুনিয়ার ঝক্কি-ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ একাগ্র চিত্ত নিয়ে হজব্রত পালন করতে যেতে হবে। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে আদম সন্তান! আমার ইবাদতের জন্য তুমি ঝামেলামুক্ত হও, আমি তোমার অন্তরকে প্রাচুর্য দিয়ে ভরে দেবো এবং তোমার দারিদ্র্য ঘুচিয়ে দেবো। যদি তা না করো তবে তোমার হাত ব্যস্ততায় ভরে দেবো আবার অভাবও দূর করব না।’ (তিরমিজি-২৪৬৬)
হজের আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কে জানা জরুরি : যেকোনো কাজ সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে- কাজটি সম্পর্কে সম্যক অবগতি লাভ করা এবং ইতঃপূর্বে যারা কাজটি করেছেন তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়া। ইসলামের অন্যতম রোকন হজের বিধান সর্বাঙ্গ সুন্দররূপে আদায় করতে হলে এ সম্পর্কেও পূর্ণ অবগতি লাভ করতে হবে। ইহরাম, তালবিয়া, তাওয়াফ, সাঈ, উকুফে মুজদালিফা, উকুফে আরাফা, রমি, কোরবানি প্রভৃতি বিধিবিধান সম্পর্কে জানতে হবে। প্রয়োজনীয় বিভিন্ন দোয়া, বিশেষ করে তালবিয়া তথা ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ শিখতে হবে। তা ছাড়া আল্লাহ তায়ালা যাদেরকে হজ পালনের অপূর্ব সৌভাগ্য দ্বারা ধন্য করেছেন এমন প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হজ ক্যাম্প বা এজেন্সিগুলোও হজের প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। হজে যাওয়ার আগে এসব ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ নিলে হজের আমলগুলো আদায়ের নিয়ম খুব সহজে রপ্ত হয়। রাসূলুল্লাহ সা: হজ পালন করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে এই বলে হজের বিধান শিখতে উদ্বুদ্ধ করেছেন যে, ‘তোমরা আমার থেকে হজের বিধিবিধান শিখে নাও।’ (সুনানে নাসায়ি-৩০৬২)
দায়মুক্ত হয়ে সফরে বের হতে হবে : হজ ফরজ হওয়ার অত্যতম শর্ত হচ্ছে সফরকালীন সময়ে পরিবারের খাদ্যবস্ত্রের ব্যবস্থা করে যাওয়ার সামর্থ্য থাকা। তাই সফরের এক-দেড় মাস সময়ে পরিবারের সদস্যরা কোথা থেকে প্রয়োজন মেটাবে তার ব্যবস্থা, দিকনির্দেশনা ও অর্থের জোগান দিয়ে যেতে হবে। যাতে গৃহকর্তার অবর্তমানে পরিবারস্থ কেউ সঙ্কট-সমস্যার সম্মুখীন না হয়। কেউ যদি কোনো টাকা পায় তাহলে যথাসম্ভব আদায় করে যেতে হবে। আদায় করা সম্ভব না হলে সময় চেয়ে নিতে হবে এবং এ ধরনের ঋণের কথা পরিবারের লোকজনের কাছে বলে যেতে হবে। কেননা, জীবন-মৃত্যুর সময় সন্ধিক্ষণ অনিশ্চিত। যেকোনো সময় যে কারো জীবনের যবনিকাপাত ঘটতে পারে। একইভাবে যদি বোনের অংশ না দেয়া হয়ে থাকে অথবা শয়তানের প্ররোচনায় যদি কারো হক নষ্ট করা হয়ে থাকে তাহলে হজের আগে অবশ্যই তার সমাধান করে যেতে হবে।
মানুষের হক মেরে, অধিকার খর্ব করে হজের প্রকৃত প্রাপ্তি ও সুফল লাভ করা সম্ভাব হবে না। নিয়তের বিশুদ্ধতা অনিবার্য।