করোনা ভাইরাসে বিপর্যস্ত পৃথিবী। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে এ পর্যন্ত ২৪ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এতে কয়েক মিলিয়ন মানুষের প্রাণনাশ হতে পারে। ভয়ানক এই ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়ায় চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতিরোধই এই মুহূর্তে সর্বোত্তম ব্যবস্থা। আর তা করতে হবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে। ইসলাম মানুষকে সর্বাবস্থায় সর্বোচ্চ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়। ব্যক্তিগত জীবন থেকে পারিবারিক ও সামাজিক জীবন—সর্বত্র পরিচ্ছন্ন জীবনের শিক্ষা দেয় ইসলাম; বরং ইসলাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে ঈমানের অংশ ঘোষণা করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অংশ।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২২৩)
পবিত্র কোরআনে পবিত্রতাকে (নির্ধারিত পদ্ধতিতে অর্জিত পরিচ্ছন্নতা) দ্বিনের অন্যতম উদ্দেশ্য এবং তাকে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের মাধ্যম হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের কষ্ট দিতে চান না; বরং তিনি তোমাদের পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ পরিপূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৬)
করোনা প্রতিরোধে সহায়ক সুন্নত
ইসলামী শরিয়ত মুমিনকে তার জীবনের সব পর্যায়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার নির্দেশ দিয়েছে। তবে মহানবী (সা.)-এর সুন্নত ও জীবনচরিত পাঠ করলে এমন কিছু সুন্নতের খোঁজ পাওয়া যায়—যা করোনাভাইরাস প্রতিরোধে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের পরামর্শের অনুকূল। এখানে তেমন কয়েকটি সুন্নত তুলে ধরা হলো।
১. হাত পরিষ্কার রাখা : রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষকে তার হাত পরিষ্কার রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। যেন তা দ্বারা শরীরের অন্য অঙ্গ, কাপড় ও অন্যান্য ব্যবহার্য বস্তু অপরিষ্কার না হয়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হাত পরিষ্কার না করেই হাতে গোশতের গন্ধ ও তৈলাক্ততা নিয়ে ঘুমাল, এতে তার কোনো ক্ষতি হলে সে যেন নিজেকেই তিরস্কার করে।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৩৮৫২)
একইভাবে তিনি ঘুম থেকে ওঠার পর প্রথম হাত ধোয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা ঘুমের ভেতর মানুষের হাত নোংরা হওয়ার ভয় থাকে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ ঘুম থেকে উঠলে সে যেন পাত্রে হাত দেওয়ার আগে হাতে তিনবার পানি প্রবাহিত করে। কেননা সে জানে না তার হাত রাতে কোথায় বিচরণ করেছে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৮৮)
২. খাবার গ্রহণের আগে হাত ধোয়া : সালমান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘খাবারের বরকত লাভের উপায় হলো তার আগে ও পরে অজু করা।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৩৭৬১)
হাদিসবিশারদরা বলেন, এখানে অজু দ্বারা উদ্দেশ্য—ভালোভাবে হাত ও মুখ পরিষ্কার করা, শরীরে ময়লা থাকলে তা পরিষ্কার করে বসা। ইসলামী আইনজ্ঞরা এ হাদিসের আলোকেই খাওয়ার আগে দুই হাত ধোয়াকে সুন্নত বলেন। আর এখানে বরকত দ্বারা শারীরিক উপকারই বোঝানো হয়েছে। (মিরকাতুল মাফাতিহ : ৭/২৭১৪)
৩. পরিষ্কার খাবার গ্রহণ করা : মহানবী (সা.) পরিষ্কার খাবার গ্রহণে উৎসাহিত করেছেন এবং তা যেন ভালো থাকে সে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘আবু হুমাইদ (রা.) এক বাটি দুধ নিয়ে এলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে বললেন, এটি ঢাকলে না কেন? একটি কাঠি দিয়ে হলেও ঢেকে রাখা দরকার।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৬০৫)
৪. নখ ছোট রাখা : ইসলামী শরিয়তে সপ্তাহে অন্তত একবার নখ কাটা সুন্নত বলা হয়েছে। যেন নখের মধ্যে কোনো জীবাণু আটকে না থাকে। শুধু নখ নয়, জীবাণু আটকে থাকতে পারে শরীরের এমন সব অঙ্গই পরিষ্কার রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন, ১০টি কাজ মানুষের স্বভাবসুলভ : ১. গোঁফ কাটা, ২. দাড়ি ছেড়ে দেওয়া, ৩. মিসওয়াক করা, ৪. পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করা, ৫. নখ কাটা, ৬. আঙুলের জোড়াগুলো ধোয়া, ৭. বগলের পশম তুলে ফেলা, ৮. নাভির নিচের পশম চেঁছে ফেলা, ৯. পানি দিয়ে ইস্তিনজা করা। মুসআব (বর্ণনাকারী) বলেন, দশম কাজটি আমি ভুলে গেছি। সম্ভবত তা কুলি করা। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫৬)
৫. কাপড় ও বিছানা পরিষ্কার রাখা : রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও কাপড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতেন এবং অন্যদেরও উৎসাহিত করতেন। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘… রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তির কাপড় ময়লা দেখে বলেন, এই ব্যক্তি কি কাপড় পরিষ্কার করার মতো কিছুই পায়নি।’ (মুজামু ইবনিল আরাবি, হাদিস : ৫০৯)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, যদি তোমাদের কোনো ব্যক্তি শয্যা গ্রহণ করতে যায়, তখন সে যেন তার লুঙ্গির ভেতর দিক দিয়ে নিজ বিছানাটা ঝেড়ে নেয়। কারণ, সে জানে না যে বিছানার ওপর তার অনুপস্থিতিতে পীড়াদায়ক কোনো কিছু আছে কি না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৩২০)
৬. মসজিদ পরিষ্কার রাখা : রাসুলুল্লাহ (সা.) মসজিদ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মসজিদের মর্যাদার দাবি হলে জনসমাগমের স্থান হিসেবে তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাও বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ নির্মাণ করার এবং তা পরিচ্ছন্ন ও সুগন্ধিময় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৫৫)
৭. ঘর-বাড়ি পরিষ্কার রাখা : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ পবিত্র—তিনি পবিত্রতা ভালোবাসেন, তিনি পরিচ্ছন্ন—পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করেন, তিনি মহান ও দয়ালু—মহত্ত্ব ও দয়া ভালোবাসেন, তিনি দানশীল—দানশীলতা ভালোবাসেন। সুতরাং তোমাদের (বাড়ির) চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখো। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৭৯৯)
হাদিসবিশারদরা বলেন, বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখার নির্দেশ থেকে বাড়ি-ঘর পরিষ্কার রাখার তাগিদ বোঝা যায়।
৮. পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা : পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে মহানবী (সা.) যেমন রাস্তাঘাট ও জনসমাগমের স্থানে ময়লা-আবর্জনা ফেলতে নিষেধ করেছেন, তেমনি কেউ তা ফেললে অন্যদের পরিষ্কার করতে উৎসাহিত করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা দুই অভিশপ্ত (কাজ) থেকে বেঁচে থাকো। তারা বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! দুই অভিশপ্ত কী? তিনি বললেন, যে মানুষের চলাচলের পথে বা তাদের বিশ্রামের স্থানে মলমূত্র ত্যাগ করে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬৮)
অন্য হাদিসে তিনি বলেন, ‘ঈমানের সত্তরের বেশি বা ষাটের বেশি শাখা রয়েছে। তার মধ্যে সর্বোত্তম হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা এবং সর্বনিম্ন হলো রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে ফেলা; লজ্জা ঈমানের অঙ্গ।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫৪)
৯. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে মসজিদে যাওয়া : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কোনো ব্যক্তি উত্তমরূপে অজু করে শুধু নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে রওনা হলে মসজিদে পৌঁছা পর্যন্ত তার প্রতিটি পদক্ষেপের বিনিময়ে আল্লাহ তার জন্য এক ধাপ করে মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং তার একটি গুনাহ মাফ করে দেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬৪৯)
১০. হাঁচি, কাশি ও হাই তোলার শিষ্টাচার রক্ষা করা : হাঁচি, কাশি ও হাই তোলার শিষ্টাচার হলো অন্যদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, মুখে হাত বা কাপড় দেওয়া, হাঁচি দিলে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়া এবং হাই তুললে ‘লা হাওলা’ পড়া। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘হাঁচি এলে মহানবী (সা.) তাঁর মুখে হাত বা কাপড় রাখতেন এবং হাঁচির শব্দ নিচু করতেন।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৫০২৯)