শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৩ পূর্বাহ্ন

হিদায়াতুল কুরআন

বিডি ডেইলি অনলাইন ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৩
  • ৭১ বার

তোমরা কিভাবে আল্লাহকে অস্বীকার করো? অথচ তোমরা ছিলে প্রাণহীন মৃত; তিনিই তোমাদেরকে জীবন দিয়েছেন। পুনরায় তিনি তোমাদের মৃত্যু দেবেন এবং আবার তিনিই তোমাদেরকে জীবিত করবেন। এভাবে, শেষ পর্যন্ত তাঁর কাছেই তোমাদের ফিরে যেতে হবে। (২৯) তিনিই সেই মহান সত্তা, যিনি তোমাদের জন্যই সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীর সবকিছু। তারপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন এবং সেগুলোকে বিন্যস্ত করেন সাত আসমানে। বস্তুত, তিনি সববিষয়ে সবিশেষ অবগত। (সূরা বাকারাহ : ২৮-২৯)

মর্ম ও শিক্ষা
ইতঃপূর্বে স্রষ্টা আল্লাহর একত্ববাদ, আল্লাহর কিতাব কুরআন, নবুয়ত, আখিরাতের বর্ণনা এবং তারপর ইবাদতের আহ্বান জানানোর পর এখানে বিস্ময় প্রকাশ করা হচ্ছে যে, এত কিছুর পরও কিভাবে মানুষ পরম করুণাময় ও মহাপরাক্রমশালী আল্লাহকে অস্বীকার করতে পারে এবং তার প্রতি অকৃতজ্ঞতার আচরণ করতে পারে? অথচ আল্লাহই মানুষকে জীবন দান করেছেন, তারই জন্য পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং সর্বশেষে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করে কর্মফল ভোগ করার জন্য মানুষকে পুনর্জীবিত করবেন। এ অবস্থায় আল্লাহর অবাধ্য হওয়া কিভাবে সম্ভব?

কুফরি ও অকৃতজ্ঞতা অনাকাক্সিক্ষত, অবাঞ্ছিত ও অস্বাভাবিক আচরণ : আয়াতে বলা হয়েছে, তোমরা কিভাবে আল্লাহকে অস্বীকার করো অথচ তোমরা ছিলে প্রাণহীন মৃত? (আয়াত-২৮) মানুষের তার প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালাকে অস্বীকার করা ও তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞ হওয়ায় এখানে আল্লাহ তায়ালা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ও কঠোর সমালোচনা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এ মহাকুদরতের আধার সর্বজ্ঞ ও বিচার দিনের মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহর সামনে আনুগত্যের মাথা নত করে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করাই যৌক্তিক এবং প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। অথচ অনেকেই তাঁকে অস্বীকার করে, তাঁর অবাধ্য হয়। এরূপ আচরণ সত্যিই অনাকাক্সিক্ষত ও অবাঞ্ছিত। যে আল্লাহ মানুষকে জীবন দান করেছেন, যে মানুষকে উদ্দেশ করেই পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, যাঁর কাছে সব কর্মের হিসাব দিতে হবে, সে আল্লাহর অবমাননা করা ও অবাধ্য হওয়া কিভাবে সম্ভব? তা হবে চরম বিস্ময়ের ব্যাপার। এরূপ আচরণ মানবসুলভ আচরণের পরিপন্থী। সুতরাং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে তাঁর বিধিবিধান শিরোধার্য করে নেয়াই শোভনীয় আচরণ।

মহাজগতের সবকিছুই নিপুণ সত্তা ও স্রষ্টার পরিকল্পিত সৃষ্টি : এখানে সৃষ্টিতত্ত্বের পুনরাবৃত্তি করে বলা হয়েছে, এ সৃষ্টিজগৎ এমনিতেই সৃষ্টি হয়ে যায়নি ; বরং সেগুলো এক নিপুণ সত্তা ও স্রষ্টার পরিকল্পিত সৃষ্টি। তিনি হলেন আল্লাহ, যিনি অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে মানুষ ও সবকিছুর অস্তিত্ব দান করেন, আবার তিনিই মৃত্যু দান করেন। অর্থাৎ জন্ম ও প্রতিপালনই শেষ নয়, সবকিছুরই একটি সুপরিকল্পিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। সে অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এ পৃথিবীর জীবনের মেয়াদ শেষে মৃত্যু আসে।
পুনরুত্থান, পরকাল ও আখিরাত : আয়াতে বলা হয়েছে, তিনি পুনরায় তোমাদেরকে জীবন দান করবেন তারপর তোমাদেরকে তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে। (আয়াত-২৮) এ কথার দ্বারা মূলত এখানে পুনরুত্থান ও পরকালে জবাবদিহিতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ এ দুনিয়াই শেষ নয় ; বরং দুনিয়া হলো শুরু, আর অভীষ্ট লক্ষ্য হলো আখিরাতের জীবন। আসলে দুনিয়া হলো মানুষের জন্য কর্মস্থল। কর্মফল ভোগ করার জন্য রয়েছে আখিরাত। এ প্রক্রিয়ায় নির্ধারিত আছে মৃত্যু ও পুনরুত্থান। কিয়ামতের নির্দিষ্ট দিনে সবাইকে পুনর্জীবন দেয়া হবে, সবাই পুনরুত্থিত হবে। তখন সবাই কিয়ামতের বিশাল মাঠের মহাসমাবেশে একত্রিত হবে। সেখানে সবাইকে তার জীবনের সব কর্ম সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। তখন আল্লাহর আদালতে বিচার হবে এবং সে বিচারের রায় অনুযায়ী আখিরাতের অনন্তকালের জীবন শুরু হবে।

মানুষের জন্যই পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি : দুনিয়ার সবকিছুই মানুষের জন্য তৈরি করা হয়েছে। অর্থাৎ সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে হলো মানুষ, যার কল্যাণের জন্য পৃথিবীর সবকিছুর সৃষ্টি। আপাত দৃষ্টিতে কোনো বিশেষ জিনিসের সাথে মানব-কল্যাণের সরাসরি সম্পর্ক অনুভূত না-ও হতে পারে। কিন্তু তা-ও মানুষের কল্যাণেরই জন্য। আসলে পৃথিবীর সবকিছু তথা জল-স্থল, বন-জঙ্গল, প্রাণিসম্পদ, পশুপাখি, এমনকি কীট-পতঙ্গ, সাপ-বিচ্ছু ইত্যাদি সবকিছুই পৃথিবীর পরিবেশ ও ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রয়োজন। ভারসাম্য নষ্ট হলে পরিবেশ বিনষ্ট হয়, আর এতে মানুষেরই ক্ষতি হয়, প্রাণ ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, মানুষের কল্যাণের জন্য পৃথিবীর সবকিছুর সৃষ্টি বটে, কিন্তু মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য কী? মানবসৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করা। তাঁর আদেশ নিষেধ ও বিধিবিধান পালন করাই হলো মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য। এখানে আরেকটি কথা আছে, তা হলো এই যে, যেহেতু পৃথিবীর সবকিছুর সৃষ্টি মানুষের কল্যাণের জন্য, সেহেতু মানুষের কর্তব্য হলো পৃথিবীতে সুপ্ত সম্পদের অনুসন্ধান (বীঢ়ষড়ৎধঃরড়হ) করা এবং তার মাধ্যমে মানব-কল্যাণের জন্য আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধন করা।
সৃষ্টির সেরা হলো মানুষ : আয়াতে বলা হয়েছে, তিনিই তোমাদের জন্য পৃথিবীতে সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। (আয়াত-২৯) এখান থেকে প্রমাণিত হয়, সৃষ্টিজগতের মধ্যে সবার সেরা ও মর্যাদাবান হলো মানুষ। কারণ, সৃষ্টির যত সব আয়োজন মানুষের জন্যই। জগতের সব বস্তুসম্ভারকে বশীভূত করে দেয়া হয়েছে মানুষের সুবিধা ও কল্যাণের নিমিত্তে। আকাশ, জমিন, চন্দ্র-সূর্য, সাগর, নদী-নালা, পাহাড় যা কিছু আছে সবই তো এ মানুষের সেবার জন্যই। সব সৃষ্টি মানুষের সেবক ও চাকর আর মানুষ হলো আল্লাহ তায়ালার বান্দা ও দাস।

মহাকাশ ও আল্লাহর সৃষ্টিরহস্য : শুধু এ পৃথিবীই নয় ; বরং সৌরজগৎ ও মহাকাশ আল্লাহর কুদরত ও সৃষ্টিরহস্যের ইঙ্গিত বহন করে। পৃথিবীর বাইরে পৃথিবীর চেয়েও বহুগুণ বড় গ্রহ-নক্ষত্র বা জগৎগুলো রয়েছে। রাতের আকাশে এসবের চিহ্ন দেখা যায়। মহাকাশের অজানা সব রহস্য নিয়ে মানুষের কৌতূহল, চিন্তা ও গবেষণার ইয়ত্তা নেই। এখনো বিজ্ঞান এর সঠিক কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। তবে একটি ধারণা হলো, ঊর্ধ্বজগত সাতটি স্তরে বিন্যস্ত। কুরআনেও এর পরিষ্কার অবস্থান ও রূপের বর্ণনা দেয়া হয়নি ; বরং শুধু সাতটি আকাশের কথা বলা হয়েছে। উচ্চতা, ঊর্ধ্বজগৎ বা গ্রহ-নক্ষত্রসহ অন্যান্য জগতে সুবিন্যস্ত সাতটি স্তর থাকতে পারে, যার প্রকৃত রূপ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বিজ্ঞানের সত্যিকার সিদ্ধান্তের সাথে কুরআনের কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু সৌরজগৎ সম্পর্কে বিজ্ঞানও এখন পর্যন্ত কোনো একক ও বিরোধহীন সিদ্ধান্ত পেশ করতে পারেনি। আসলে মানব-কল্যাণ ও ইসলামী জীবনাদর্শ অনুসরণ করে শান্তি ও সাফল্য লাভের জন্য এসবের জ্ঞান অপরিহার্যও নয়।

আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময় : বলা হয়েছে, আল্লাহ সব বিষয়ে সবিশেষ অবগত। এর তাৎপর্য অনেক। প্রথমত, দুনিয়ার সব সৃষ্টি মানব-কল্যাণের জন্য। যেখানে যেভাবে যা প্রয়োজন, তা-ই তিনি সৃষ্টি করেছেন। মানব-কল্যাণ ও পরিবেশ রক্ষায় কোথায় কী প্রয়োজন, তা মানুষের বোধগম্য না হলেও প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তা যথার্থই জানেন। সুতরাং সৃষ্টিকে ধ্বংস করে পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করার পরিবর্তে পরিবেশ রক্ষায় যতœবান হওয়াই মঙ্গলজনক। দ্বিতীয়ত, প্রজ্ঞাময় আল্লাহ জানেন মানুষের জন্য কোনটি কল্যাণকর। সুতরাং, তাঁর দেয়া জীবন-বিধান শিরোধার্য করে নেয়া উচিত। জ্ঞান ও আলোর উৎস তিনি, সুতরাং আল্লাহ কর্তৃক নাজিলকৃত কুরআন বাদ দিয়ে প্রকৃত জ্ঞান ও আলোর সন্ধান পাওয়া অসম্ভব। তৃতীয়ত, আল্লাহ সর্বজ্ঞ, যিনি আমাদের সব কর্মকাণ্ড দেখেন ও জানেন। তাঁর অগোচরে কিছুই করা সম্ভব নয়। তিনি আমাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কর্মেরও হিসাব নেবেন। সুতরাং সে দিকে খেয়াল রেখেই জীবন চালানো উচিত।

লেখক :

  • ড. আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেক

শিক্ষাবিদ ও বহু গ্রন্থ রচিয়তা

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com