করোনাভাইরাস যা এককথায় বলা যায় মহাপ্রলয়। সময়টা কঠিন। সব কিছু বন্ধ। মার্কেট, শপিংমল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উদ্যান, সৈকত, স্টেডিয়াম- সব বন্ধ। বিশ্ব এখন উদ্বিগ্ন। করোনাভাইরাস বিশ্বে বিস্তার ঘটিয়ে কেড়ে নিচ্ছে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ।
করোনা ভাইরাস এসেছে আমাদের কিছু কথা মনে করিয়ে দিতে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে বড় বড় রূপান্তরে মানুষেরা নিজে ক্রমাগত শক্তিশালী হয়েছে। বিনিময়ে কোটি কোটি ভিন্ন প্রজাতি ধ্বংস করছে। যেমন, মানুষ যখন গুহাবাসী, তখন পশু-পাখি-মাছ শিকার এবং বন্য শস্য-ফলমূল সংগ্রহ করে জীবন ধারণ করত। মানুষ ছিল প্রকৃতির অংশ। সেই মানুষ প্রায় ১২ হাজার বছর আগে পরিকল্পিত চাষাবাদ শুরু করে মানব সভ্যতার ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা করল, বিনিময়ে বিলীন হয়ে গেল কোটি কোটি প্রজাতি। তারপর থেকে বর্তমান এই সময়ে পৃথিবীতে সাড়ে সাত শ’ কোটি মানুষ, যারা গোটা প্রজাতির মাত্র ০.১ ভাগ তারাই ধ্বংসের কারণ হয়েছে পৃথিবীর ৮৩ ভাগ বন্য প্রাণী ও ৫০ ভাগ উদ্ভিদের। একই সময়ে বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে মানব প্রজাতির ও গৃহপালিত পশুর সংখ্যা। বিজ্ঞানীরা বলছেন- আধুনিক কৃষি এবং মানব সভ্যতার উন্নতির জন্য ব্যাপক বন উজাড় ও বন্য আবাসের ধ্বংস এবং পানি, বায়ু ও পরিবেশ বিষাক্ত করার ফলে পৃথিবী তার চার শ’ বছরের ইতিহাসে জীবন্ত প্রজাতির গণবিলুপ্তির পর্যায় পার করছে। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক প্রাণী গত পঞ্চাশ বছরে হারিয়ে গেছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
জাতিসঙ্ঘ অধীন জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষার আন্তঃসরকার বিজ্ঞান নীতির আশঙ্ক যে, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে দশ লাখের মতো প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। রিপোর্টে বলা হয়েছে জীববৈচিত্র্যের এই ধ্বংস পৃথিবী নামের গ্রহের জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখ্য কারণ হিসেবে আধুনিক কৃষিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের সাথে রোগ সংক্রমণের কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে যে, দ্রুত সংক্রমণ ঘটায়- এমনসব রোগজীবাণু জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের সাথে পাল্লা দিয়ে বংশ বিস্তার করছে।
করোনাভাইরাস ছিল চীনের উহানে। গত ৩০ জানুয়ারি উহানে একটি সিফুড মার্কেট- যেখানে বাদুড়, পেঙ্গোলিন (বনরুই্), সিভেট (গন্ধগোকুল) ও অন্যান্য বন্য প্রাণী খাদ্য হিসেবে বিক্রি হয়, সেখান থেকে ভাইরাসজনিত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ৯ জন চীনা নাগরিকের থেকে নেয়া নমুনায় ভাইরাসটির দেখা মেলে। এই ভাইরাসের জেনোমের সাথে বাদুড়ের দেহের ভাইরাস যা ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাস হিসেবে মানুষের দেহে সংক্রমণ ঘটিয়েছিল তার জেনোমের মিল পাওয়া যায়। বাদুড় বা অন্য কোনো প্রাণী থেকে মানব দেহে সংক্রমণের পর এই ভাইরাস অতি দ্রুত মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়তে পারে। গবেষণাপত্রে জানা যায় কিভাবে কোষের সাথে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের সংযোগের মাধ্যমে আমাদের কাছে নতুন এই করোনা ভাইরাস দেহে প্রবেশ করতে পারে।”
পৃথিবীতে প্রায় চৌদ্দ হাজার প্রজাতির বাদুড় আছে। পৃথিবীতে তাদের আগমন ঘটে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি বছর আগে। বাদুড় ও অন্যান্য প্রাণীদেহে প্রায় ছয় লাখের ওপর করোনা ভাইরাসে সমগোত্রীয় অজানা ভাইরাস বসবাস করে। যে ভাইরাস ছিল বাদুড়ের দেহে, মিলে মিশে; একে অন্যের ক্ষতি করেনি কয়েক কোটি বছর ধরে, সেই ভাইরাস কেন বাদুড়ের দেহ ছেড়ে মানুষ বা মানুষের গৃহপালিত পশু, হাঁস-মুরগি, মাছের দেহে প্রবেশ করল? শুধু কোভিড ১৯ করোনা ভাইরাস নয়, মানুষের দেহের দুই তৃতীয়াংশ সংক্রামক ব্যাধি যাদের মধ্যে করোনা ছাড়াও রয়েছে সার্স, মার্স, ইবোলা, এইডস, জিকা, এইচ১এন১, রেবিস ইত্যাদি রোগের কারণ যে বিভিন্ন ভাইরাস তারা এসেছে বন্য প্রাণী থেকে অথবা তাদের মাধ্যমে আক্রান্ত অন্য প্রাণী থেকে।”
এর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যাবে প্রায় ১২ হাজার বছর ধরে প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণে লিপ্ত আছে মানুষ এবং আমাদের সভ্যতা। মানুষের এমন বিরুদ্ধাচরণ বৃদ্ধি পেয়েছে মানব সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে। যাদের মধ্যে রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, প্রাণ প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষ বা যে কোন প্রজাতির জেনেটিক বৈশিষ্ট্য পাল্টে দেয়া, ন্যানো প্রযুক্তি ইত্যাদি। নতুন উদ্ভাবিত এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে অচিন্তনীয় গতিতে মানব সভ্যতা অগ্রসর হচ্ছে। এই সময়ে প্রকৃতি ও তার প্রাণ বৈচিত্র্য সবচেয়ে দ্রুতগতিতে ধ্বংস হচ্ছে।
এই আমরাই কিভাবে ভাইরাসকে বাধ্য করেছি আমাদের কিংবা আমাদের গৃহপালিত প্রাণীর দেহে প্রবেশ করে আমাদের কঠিন রোগে আক্রান্ত করতে সে সম্পর্কে কিছু উদাহরণ দেব। ব্রাজিলের উত্তর অ্যামাজন রেইন ফরেস্টের বিশাল যে বনভূমি ছিল বাদুড় ও অন্যান্য বন্য পশুর আবাসস্থল, তা উজাড় করে গড়ে তোলা হয়েছে গরুর খামার। বর্তমানে এই অ্যামাজনের গরু পাল বিচরণ করছে। যে অ্যামাজনকে বলা হতো পৃথিবীর ফুসফুস, কারণ বাতাসের কার্বনডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে বাতাসে ছেড়ে দিত অক্সিজেন এই বনের ঘন উদ্ভিদরাজি, আগামী ১৫ বছরের মধ্যে সেই অ্যামাজন গড় কার্বন শোষণের বদলে কার্বন নির্গমনকারী হিসেবে বিবেচিত হবে। ভেবে দেখছেন প্রকৃতি ও সারা বিশ্বের জন্য তা হবে কত মারাত্মক।
বাংলাদেশের মধুপুর এবং গাজীপুরের গজারি বন উজার হয়েছে। সেখানে জায়গা নিয়েছে পোল্ট্রি, মাছের প্রকল্প এবং টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস শিল্প। এই অঞ্চলের বনভূমি ছিল বন্য গাছ-গাছালি, পশু প্রাণী, বাদুড়, পাখি, অণুজীব ও ভাইরাসের আবাসস্থল। এর বাতাস ছিল নির্মল, নদী-খাল-ঝরনা ও জলাভুমির পানি ছিল বিশুদ্ধ। বন উজাড় ও প্রকৃতি ধ্বংসের জন্য বনভূমিতে বসবাসকারী মানুষজনেরা নয়, মুখ্যত দায়ী সরকারি বনবিভাগ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণি- যারা রাষ্ট্র, রাজনীতি ও অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। মধুপুর এবং গাজীপুরের বড় অংশ এখন আর বন্য পশু-পাখি ও অণুজীবের আবাসস্থল নয়, সেখানে বাতাসে ময়লা আবর্জনার পচা দুর্গন্ধ আর মুরগির বিষ্ঠার গন্ধ। মাছের খামারে মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য পানিতে দেয়া হয় কৃত্রিম খাবার, যাতে রয়েছে শরীরের দ্রুত বর্ধনের জন্য হরমোন, রোগ-বালাই থেকে রক্ষার জন্য নানা ওষুধ ও উচ্চ শক্তির এন্টিবায়োটিক। যা পানিকে করে তুলেছে দুর্গন্ধময়। কালচারের মাছ ছাড়া এই পানিতে অন্য কোনো প্রজাতি বাঁচতে পারে না। এই অঞ্চলে নদী-খাল-জলাভূমির পানি আলকাতরার মতো। টেক্সটাইল ও গার্মেন্টসের বিষাক্ত কেমিক্যাল এই পানিকে অনুপযুক্ত করেছে শুধু বন্য পশু-পাখি-অণুজীবের জন্য নয়, এখানে বসবাসরত সাধারণ গরিব মানুষের জন্যও।
পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও আবাসস্থলের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে আমরা মানুষ ধ্বংস করেছি এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তীর্ণ বনভূমি। এক সময়ে এই বনভূমিতে বিচরণ করত বন্য মোরগ, বরাহ, গয়াল, বাদুড়। ভাইরাস তাদের কোনো ক্ষতি করেনি। যখন বন উজাড় হলো, বাস্তুচ্যুত হলো বন্য পশু-পাখি-অণুজীব, তখন বাদুড় ও অন্যান্য বন্য পশু-পাখির দেহে সহঅবস্থান করত করোনা ভাইরাসের মতো যে অসংখ্য ভাইরাস, তারা কিভাবে বাঁচবে, নিজেদের বংশবিস্তার করবে? লক্ষ কোটি বছর ধরে যে নিরাপদ আবাসে তারা বেঁচে ছিল, তা এখন অরক্ষিত। বাদুড়, বনরুই – এসব মানুষের খাদ্য তালিকায় এসেছে। বন থেকে ধরে এনে বাজারে ছোট খাঁচায় বন্দী করা হয়েছে। মানুষের খাবারের টেবিলে চলে যাবে তারা। কী করণীয় ছিল ভাইরাসের, এখন তারা মানুষের দেহে আশ্রয় খুঁজছে, সংক্রমিত করেছে খামারের শূয়োর, মুরগি ও মাছ। বন্য পশু-প্রাণীর কোষে ভাইরাস শুধু সহ-অবস্থান করত, নিজেদের জীবন বাঁচাতে। আশ্রয়দাতাকে মেরে ফেলতে না। ওই সব পশু-প্রাণির রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা তা নিশ্চিত করতো। কিন্তু মানুষ বা খামারের পশু-পাখি-মাছ – এদের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা এই ভাইরাসের মতো নতুন ভাইরাসকে মোকাবেলার জন্য গড়ে ওঠেনি। তাই কিছু দিন পর পর নতুন নতুন ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষ ও খামারে পালিত প্রাণী দলে দলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে নিতান্ত অসহায়ভাবে।
করোনা শক্তিধরদের নত হতে বাধ্য করেছে। পৃথিবীকে সাময়িকভাবে হলেও থামিয়ে রাখার যে কাজ অন্য কেউ কখনো পারেনি, তা সম্ভব করেছে করোনা।
মার্কিন ভাষাবিদ ও দার্শনিক নোয়াম চমস্কি বলেন, “করোনাভাইরাসের ভালো দিকটি হচ্ছে মানুষ হয়তো ভাবতে শুরু করবে কেমন পৃথিবী আমাদের চাই। “
করোনা ভাইরাসের আগমনের আগে পরে এক মাসের ব্যবধানে স্যাটেলাইট থেকে তোলা চীন দেশের পাশাপাশি দুটি ছবি দেখে ভালো লাগবে। একটি ছবিতে দেখাচ্ছে করোনার আগে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডে চীনের দূষিত ভূমণ্ডল। এর এক মাসের ব্যবধানে আরেক ছবিতে দূষণ-মুক্ত চীনের চিত্র। প্রধান পরিবেশগত সূচকসমূহ যা গত অর্ধ শতাব্দী ধরে ক্রমাগত খারাপের দিকে গেছে, তা বর্তমান লকডাউনের এই সময়ে হয় উন্নতি করছে। কার্বন নিঃসরণের জন্য প্রধানত দায়ী চীনে ফেব্রুয়ারির প্রথম থেকে মধ্য মার্চ পর্যন্ত সময়ে তা কমে গেছে প্রায় ১৮ ভাগ। ধারণা করা হচ্ছে ইউরোপে ও আমেরিকাতেও উলে¬খযোগ্য পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ কমে গেছে। পৃথিবীতে শব্দ দূষণ কমে গেছে, বায়ু নির্মল। তাই পাখির কল-কাকলীতে চারদিক মুখরিত। গাছে গাছে ফুলের সমারহ দেখা দিয়েছে।
মানুষ সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজাতি। সেজন্যেই পৃথিবী ও তার প্রকৃতি জগতকে মানুষ শাসন করছে। কিন্তু একবার ভেবে দেখেন, এই পৃথিবী থেকে মানুষের বিলুপ্তি ঘটলে প্রকৃতি জগতের কী কোন ক্ষতি হবে? না, কিছুই হবে না। বরং মানুষের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে প্রকৃতি স্বউদ্যোগে তার ক্ষতগুলো নিরাময় করে তুলবে বর্তমানে যা হচ্ছে। প্রকৃতিকে নিজের অবস্থানে ফিরতে খুব বেশি সময় লাগে না। সেজন্যেই বলছি এবারে দানব হোমো স্যাপিয়েন্সরা যেন অতীতের মতো আবারো পৃথিবী শাসনের সুযোগ না পায় সে ব্যাপারে আমাদের অতি দ্রুত কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। সময় মানব জাতির হাতে কম। পৃথিবীর সকল দেশের মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু মৌলিক সিদ্ধান্তে মানতে হবে। যা মেনে চললে প্রকৃতিজগত ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবে। করোনাসহ সকল প্রজাতি মিলেমিশে গড়ে উঠবে সমতার পৃথিবী। প্রকৃতির জয়ী হওয়ার ভাবদর্শনে বিশ্বাসী হয়ে যদি মানুষ লড়াইটি চালায়, তাহলেই মাত্র সুন্দর সবুজ আগামীর পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
লেখক : পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়