শিগগিরই হচ্ছে, হবে- এমন প্রতিশ্রুতিতেই দিন পার করছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য। কিন্তু ঘোষণা করছেন না বছরের পর বছর মেয়াদোত্তীর্ণ থাকা জেলা ও উপজেলা কমিটি। একটু জোরাজুরি করলেই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার দোহাই দিয়ে তারা বলেন- ‘নেত্রীর নির্দেশ পেলেই কমিটি দিয়ে দেব।’ সেই সময়ও যেন আর আসে না। ক্ষোভে-হতাশায় সম্ভাবনাময় অনেক তরুণই ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনে।
ছাত্রলীগের তৃণমূল নেতাদের ভাষ্য, জেলা ও উপজেলা কমিটি দেওয়ার বিষয়ে হাইকমান্ড থেকে কোনো বাধা নেই। যত বিপত্তি জয়-লেখকের প্যাঁচকে ঘিরে। মূলত শীর্ষ এই দুই নেতা জেলায় যার যার মতো বলয় তৈরি করতে চাইছেন। সঙ্গে রয়েছে টাকার বিনিময়ে নেতা বানিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতির অভিযোগ। যে কারণে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতাদের সুপারিশও পাত্তা দিচ্ছেন না জয়-লেখক।
গুরুত্বপূর্ণ দুই জেলার সভাপতি পদপ্রত্যাশী ছাত্রলীগ নেতা জানান, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক একসঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচিতে গেলেও বিগত শোভন-রাব্বানী কমিটির মতোই গ্রুপিং রাজনীতি অব্যাহত রেখেছেন। কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরু করে তৃণমূল- সব জায়গাতেই তারা তৈরি করছেন ‘মাইম্যান’। জেলা কমিটিতে যোগ্যতার চেয়ে পছন্দকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাই বেশিরভাগ জেলাতেই সভাপতি ও সাধরণ সম্পাদক পদে নিজেদের লোক বসাতে দুজনের মধ্যে চলছে তুমুল দ্বন্দ্ব। জয় একজনকে চাইছেন কিন্তু লেখকের পছন্দ আরেকজন। কেউ কাউকে ছাড় না দেওয়ায় কমিটি দিতেও বিলম্ব হচ্ছে।
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টচার্য অবশ্য এই অভিযোগের সত্যতা নেই দাবি করে আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমাদের মধ্যে সম্পর্কের কোনো ফারাক নেই। আমরা যে সিদ্ধান্ত নেই তা দুজনে মিলেই।’ জেলা কমিটি কবে দেওয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শিগগিরই দিয়ে দেব। এ ব্যাপারে কাজ চলছে।’ তবে এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের প্রতিক্রিয়া জানতে তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও রেসপন্স করেননি।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের দেশব্যাপী ১১১টি সাংগঠনিক জেলা রয়েছে। এর মধ্যে ১০৪টিই মেয়াদোত্তীর্ণ। দেশের অন্যতম এই প্রাচীন ছাত্র সংগঠনটির কোনো কোনো ইউনিট কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে নয় বছর আগে। এগুলোর কয়েকটিই ২০০৬-২০১১ সালের মাহমুদ হাসান রিপন ও মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন কমিটির দেওয়া কমিটি। অথচ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ছাত্রলীগের ইউনিট কমিটির মেয়াদ এক বছর। আর কেন্দ্রীয় কমিটি হয় দুই বছর মেয়াদি। এর মধ্যে অন্তত ৩৭টি জেলা শাখার মেয়াদ শেষ হয়েছে চার থেকে নয় বছর আগে। ৭২টি চলছে দুই থেকে তিন বছরের পুরনোদের নেতৃত্বে। আবার কয়েকটিতে কোনো কমিটিই নেই। সব মিলিয়ে এসব জেলার নেতাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ ও হতাশা। ছাত্রলীগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট বলে বিবেচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। সংগঠনটির ‘প্রাণ’ ১৮টি আবাসিক হল কমিটিরও মেয়াদ ফুরিয়েছে অনেক আগে। অথচ সেশনজট, ছাত্রলীগের বয়সসীমা, শিক্ষাজীবনের সমাপ্তির কারণে কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ না পেয়ে ছাত্রত্ব শেষ করছেন সংগঠনটির অনেক ত্যাগী কর্মী।
ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, জয়-লেখকের সময়ে কেবল প্রেস রিলিজ দিয়ে ঘোষণা হয় কুষ্টিয়া, নড়াইল, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুর, কক্সবাজার ও গোপালগঞ্জ জেলার কমিটি। অথচ কথা ছিল সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি দেওয়ার। এক্ষেত্রে অবশ্য করোনার দোহাই। আবার মাসে একটি সাধারণসভা হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি গত এক বছরে। দলীয় কর্মসূচিতেও থাকেন না সংগঠনটির শীর্ষনেতারা। শুধু তাই নয়; বিভিন্ন জেলা, মহানগর, বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক কাজ তত্ত্বাবধানের জন্য ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে একটি টিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংগঠনের সহসভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক, সহসম্পাদক, সম্পাদক, উপসম্পাদক ও সদস্যদের নিয়ে গঠন করা হয় এই টিম। কিন্তু ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই সম্মেলন করে ছাত্রলীগের কমিটি হলেও আজ পর্যন্ত বণ্টন হয়নি সাংগঠনিক দায়িত্ব। ফলে এক রকম বিশৃঙ্খলভাবেই চলছে বিভিন্ন কার্যক্রম, যার প্রভাব পড়ছে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত।
ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলনের পর ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই সভাপতি পদে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক পদে গোলাম রাব্বনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, স্বজনপ্রীতিসহ নানা অভিযোগে পূর্ণাঙ্গ মেয়াদে দায়িত্ব পালনের আগেই ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ওই দুই নেতা। তাদের অব্যাহতির পর সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান আল নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্য। মাস তিনেক ভারপ্রাপ্ত থাকার পর ছাত্রলীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তাদের পূর্ণ দায়িত্ব দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।