মাত্র কয়েক শতাব্দী আগেও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চাবিকাঠি মুসলমানদের হাতেই ছিল। মুসলিম মনীষীরা একদিকে কুরআন-হাদিসের যুগোপযোগী ব্যাখ্যা প্রদান করতেন, অপরদিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নব নব দিক উšে§াচন করতেন। বিশ্বের যেখানেই অজ্ঞতার অন্ধকার ছিল সেখানেই জ্ঞানের মশাল জ্বালাতেন এসব মনীষী। ফলে ইউরোপ থেকে শুরু করে বিশ্বের সর্বত্র মুসলিমদের প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। কালের পরিক্রমায় মুসলমানরা আজ জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়েছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে এলেম বা জ্ঞানের বিভাজন সৃষ্টি করা। অর্থাৎ জ্ঞানকে দ্বীনি ও দুনিয়াবি প্রকরণে বিভক্ত করে ফেলা হয়েছে। ফলে মুসলমানদের মাঝে জ্ঞানের দুটি বিপরীতমুখী ধারার উদ্ভব হয়েছে। একটি গ্র“প ঐশী জ্ঞান বলতে কুরআন-সুন্নাহর গতানুগতিক কিছু ব্যাখ্যাকেই ধরে নিয়েছে। অপর গ্র“প পদার্থ, রসায়ন, গণিত, ভূগোল ও আধুনিক বিজ্ঞানের পাঠকে ধর্ম থেকে খারিজ দুনিয়াবি বিষয় মনে করছে। এর ফলে উভয় ধরনের জ্ঞানকে কেন্দ্র করে একটি সুস্পষ্ট বিরোধ তৈরি হয়েছে। অথচ ইসলাম কখনোই জ্ঞানের এমন বিভাজনকে সমর্থন করে না। মূলত কুরআনুল কারিম সব ধরনের জ্ঞানেরই মূল ভিত্তি। কুরআন তার পাঠককে যেভাবে নামাজ কায়েমের আদেশ দেয় ঠিক একইভাবে মহান আল্লাহতায়ালার এ সৃষ্টি জগতের প্রতিটি বস্তু নিয়ে গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করে। যার কারণে আমরা দেখতে পাই, ইবনে জারির তাবারি, ইবনেসিনা, খাওয়ারিজমিসহ অনেক মুসলিম দার্শনিক ছিলেন যারা কুরআন ও হাদিসে যেমন পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন, তেমনি ভূগোল চিকিৎসা ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়ও সমান পারদর্শী ছিলেন। আমাদের তৈরি করা জ্ঞানের বিভাজনের ফলেই বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে বড় বড় বিজ্ঞানী তৈরি হচ্ছে না। কিছু সংখ্যক তৈরি হলেও কুরআন-হাদিসের জ্ঞানের অভাবে তারা স্বকীয়তা হারাচ্ছেন। ইনস্টিটিউট অফ ইসলামিক থটের পরিচালক, তুরস্কের প্রতিথযশা ইসলামি চিন্তাবিদ মুফাক্কির ও উসুলবিদ প্রফেসর মেহমেদ গরমেজ জ্ঞানের এমন বিভাজনকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘ইসলামি সভ্যতার সবচেয়ে ভঙ্গুর পয়েন্ট হলো ইলম বা জ্ঞানকে দ্বীনি এবং দুনিয়াবি হিসাবে বিভাজন করা। এটি হচ্ছে একটা সেক্যুলার বিভাজন। মহান রাব্বুল আলামিনের আয়াতগুলো ব্যাখ্যাকারী তাফসিরগুলো যেমন ইলম, তেমনি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের এ পৃথিবীকে ব্যাখ্যাকারী যত রকম জ্ঞান রয়েছে সেগুলোও ইলম’। কুরআনুল কারিমের প্রথম বাণী হচ্ছে, ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক-পড় তোমার রবের নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। এখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে পড়ার নির্দেশ দিয়ে মানব সৃষ্টিতত্ত্ব তুলে ধরেছেন। তারপর সৃষ্টিতত্ত্বের গবেষণার প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, খালাকাল ইনসানা মিন আলাক-মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট বাঁধা রক্ত থেকে। তারপর বলেছেন, ‘ইকরা ওয়া রাব্বুকাল আকরাম। আল্লাজি আল্লামা বিল কলাম-পড় তোমার রব বড়ই মহিমান্বিত যিনি কলম দিয়ে শিখিয়েছেন। আল্লামাল ইনসানা মালাম ইয়ালাম-মানুষকে শিখিয়েছেন এমন জ্ঞান তা সে জানত না। মূলত সূরা আলাকের এ কয়েকটি আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা মানুষকে গভীর গবেষণার দিকে আহ্বান করেছেন। বিশেষত মহান সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করার আহ্বান জানিয়েছেন যা জীব বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জ্ঞানের উৎস হিসাবে কুরআনুল কারিম আমাদের ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধান সম্পর্কে জানা ও পালনে যেমন উৎসাহিত করে তেমনিভাবে মহান আল্লাহর সৃষ্টিতত্ত্ব, জীবের বিকাশ ধারা, অণ- পরমাণুর গঠন, নভোমণ্ডল ভূমণ্ডলের সৃষ্টি রহস্য নিয়ে গভীর গবেষণার আহ্বান জানায়। যার মাধ্যমে আমরা মহান আল্লাহর গভীর পরিচয় পাই এবং উলুহিয়াত ও রুবুবিয়াত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে পারি। পবিত্র কুরআনুল কারিমের কোথাও জ্ঞানকে বিভাজন করা হয়নি। বরং আহকাম সংক্রান্ত ও সৃষ্টি রহস্য সংক্রান্ত উভয় ধরনের জ্ঞানকেই সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এলেম বলতে শুধু তাফসির, হাদিস ও কালাম শাস্ত্রের জ্ঞানকেই বোঝায় না; বরং সৃষ্টিতত্ত্বকে বোঝার জন্য মতো রকমের জ্ঞান রয়েছে সেসব বিষয়াবলিও এলেমের অন্তর্ভুক্ত।
কুরআনুল কারিমের কয়েকটি আয়াতের দিকে তাকালে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তার আরও এক নিদর্শন হচ্ছে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে’ (সূরা রুম : ২২)। আরও এসেছে, ‘নিঃসন্দেহে আসমানগুলো ও জমিনের সৃষ্টি এবং দিবা-রাত্রির আবর্তনের মাঝে জ্ঞানী লোকদের জন্য রয়েছে অনেক নিদর্শন। যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষয়ে এবং বলে, হে আমাদের রব আপনি এসব অনর্থক সৃষ্টি করেননি; আপনি পবিত্রতম। অতএব, আমাদের জাহান্নাম থেকে রক্ষা করুন (সূরা আলে ইমরান : ১৯০-১৯১)। এভাবে কুরআনের আরও অসংখ্য আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করার আহ্বান জানিয়েছেন। মূলত মহান আল্লাহর সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করলে মহাবিশ্বের যে একজন স্রষ্টা রয়েছেন তা সহজেই উপলব্ধি হবে এবং বিশ্বাসের সীমানা আরও সুদৃঢ় হবে।
কুরআনুল কারিমের অসংখ্য আয়াতে বিজ্ঞানের বিভিন্ন মৌলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে যা একজন বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিকে মৌলিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে গবেষণার কাজে সহায়তা করতে পারে।
মুসলমানদের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে এবং বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে আবারও বিজ্ঞানচর্চায় জোর দিতে হবে। জ্ঞানচর্চার গতানুগতিক ও সীমাবদ্ধ ধারণা থেকে মুক্ত হয়ে গবেষণায় মনোনিবেশ করতে হবে।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট