ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আসামে যে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলছে, তার ফলে ফাটল দেখা দিয়েছে সেখানকার ধর্মীয় আর ভাষিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে। তৈরি হয়েছে, আসামের ভাষায়, ‘তিনকোনিয়া বিভাজন’।
অসমীয়ারা মনে করছেন, এই আইনের ফলে বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক হিন্দু ভারতে চলে এসে নাগরিকত্ব পেলে বিপন্ন হবে অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতি।
আবার বাংলাভাষী মুসলমানরা মনে করছেন, এই আইনের মাধ্যমে বাংলাভাষী হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেয়া হলেও তাদের রাষ্ট্রহীন করে দেয়া হতে পারে।
আর যারা সব থেকে লাভবান হবেন বলে মনে করছেন অন্য যে গোষ্ঠী, সেই বাঙালি হিন্দুদের আদৌ কতটা লাভ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে আইনজ্ঞদেরও।
আর এই পারস্পরিক অবিশ্বাসের আবহে হিন্দু বাঙালীদের এলাকায় দোকান-বাড়ি আক্রমণ করার কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাও ঘটছে।
নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের প্রতিবাদে গৌহাটি শহরের রাস্তায় ক’দিন আগে হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভ গত সপ্তাহেই সহিংস চেহারা নিয়েছিল। রাজধানী এখন শান্ত হলেও ক্ষোভ ছড়িয়েছে গ্রামে গ্রামে।
বরপেটা জেলার এরকমই একটা প্রতিবাদ সভায় হাজির হয়েছিলেন সরভোগের বাসিন্দা স্বপ্না দেবীদাস। তার ভাই ১৯৮৩ সালে আসাম আন্দোলনের নিহত হয়েছিলেন।
স্বপ্না দেবীদাস বিবিসিকে বলেন, নাগরিকত্ব আইন চালু হলে তার ভাইয়ের মতো আরো যারা আসাম আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের জীবনত্যাগ বৃথা হয়ে যাবে।
স্বপ্না দেবীদাসের কথায়, “৮১৬ জন নিহত হয়েছিলেন আসাম আন্দোলনে, তাদের জীবনদান ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালু হয়। বহু বাংলাদেশী অবৈধভাবে আসামে এসেছে ইতিমধ্যেই। এই আইন চালু হলে বাংলাদেশ থেকে চলে আসা আরো বহু মানুষ নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আমিও ভাইয়ের মতোই প্রাণ দিতে তৈরি – কিন্তু নিজের ভাষা সংস্কৃতির ওপরে কোনওরকম আক্রমণ মানব না।”
ওই প্রতিবাদীদের মধ্যেই কেউ কেউ বলছিলেন যে বাংলাদেশ থেকে আরও এক দেড় কোটি হিন্দু আসামে চলে আসতে পারেন, যাতে নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি বিপন্ন হওয়ার যে আশঙ্কা করছেন অসমীয়ারা।
বিজেপির আসাম রাজ্য সভাপতি রঞ্জিত দাশের অবশ্য হিসাব, বড়জোড় সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ মানুষ – যারা ২০১৪ সালের আগে বেশ অনেক দিন আসামে বসবাস করেছেন, তারাই এই আইনে নাগরিকত্বের আবেদন করার সুযোগ পাবেন।
“আমরা একটা হিসাব করে দেখেছি যে বড়জোড় সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ মানুষ এই আইনে নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারেন। জেলাওয়ারি একটা হিসাবও আছে আমাদের। তবে যেটা প্রচার হচ্ছে যে বাংলাদেশ থেকে এক কোটি ২০ লক্ষ মানুষ চলে আসবেন ইত্যাদি – সেটা একটা গুজব। বাংলাদেশ থেকে যদি নতুন করে ২০ জনও আসেন, তাহলেও আমরা বিজেপির সব সদস্য পদত্যাগ করতে তৈরি আছি – এটা আমরা প্রকাশ্যেই বলেছি,” বলছিলেন দাশ।
মুসলমানদের ভয়
অন্যদিকে, বাংলাভাষী মুসলমানদের আশঙ্কা যে হিন্দু বাঙালিদের নাগরিকত্বের সুযোগ করে দেওয়া হবে এই আইনে, আর আসামের বাঙালি মুসলমানদের রাষ্টহীন করে দেয়ার একটা চক্রান্ত এই আইন।
বাকসা জেলার শনবাড়ির বাসিন্দা মুহম্মদ আবদুল লতিফের কথায়, “”নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে এনআরসি থেকে বাদ পড়া হিন্দু বাঙালীরা নাগরিকত্ব পাবে। কিন্তু আমাদের মধ্যে যারা এন আর সি থেকে বাদ পড়েছে, তারা তো নতুন আইনের সুযোগ পাব না! অর্থাৎ আমাদের রাষ্ট্রহীন করে দেয়ার একটা চক্রান্ত ছাড়া কিছুই না এটা।”
বোকো জেলার একটি গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করেন কনক চক্রবর্তী। তিনি বলছিলেন, কোন গোষ্ঠীর মানুষ কতটা নাগরিকত্ব পাবেন, আদৌ পাবেন কিনা – সেটা অস্পষ্ট হলেও এই আইন আসামের নানা ধর্মীয় আর ভাষিক গোষ্ঠীর মধ্যে একটা বিভাজন তৈরি করে দিয়েছে।
“অসমীয়ারা মনে করছে বাঙালিরা নাগরিকত্ব পেলে তাদের ভাষা সংস্কৃতি নষ্ট হবে। মুসলমানরা ভাবছে হিন্দুরা নাগরিকত্ব পেয়ে গেলে তাদের কী হবে। এই চিন্তাধারাটা একটা সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আর তার থেকে একমাত্র সুবিধা পাচ্ছে রাজনৈতিক পার্টিগুলো। তাদেরই একমাত্র লাভ হবে ভোটের সময়ে,” বলছিলেন চক্রবর্তী।
আক্রোশের শিকার হচ্ছেন হিন্দু বাঙালিরা
নাগরিকত্ব আইনকে কেন্দ্র করে যে আসামের মানুষের মধ্যে একটা বিভাজন তৈরি করে দিতে পেরেছে রাজ্যের ক্ষমতাসীন সরকার, সেটা মনে করেন নাগরিকত্ব ইস্যু নিয়ে দীর্ঘদিন সামাজিক কাজে জড়িত গৌহাটি হাইকোর্টের সিনিয়ার আইনজীবী হাফিজ রশিদ আহমেদ চৌধুরীও।
তিনি বলছিলেন, “হিন্দু – মুসলমানে বিভাজন বা অসমীয়া-বাঙালি বিভাজন করে দিতে সফল হয়েছে সরকার। আইনটা যদি দেখা যায়, তাতে বাঙালি মানুষরাও বিশেষ কিছু পাবেন, না অসমীয়া মানুষের কোনো বিরাট ক্ষতি হবে। কিন্তু দুটি বিপরীতমুখী ভাবনার লড়াই লাগিয়ে দিয়েছে।”
আর এই বিভাজনের ফলে আক্রোশ গিয়ে পড়ছে হিন্দু বাঙালিদের ওপরে। যদিও তারাও নিশ্চিত নন যে নতুন আইনে তাদের কতটা লাভ হবে।
তবুও আসামের গোয়ালপাড়া, তিনসুকিয়া আর বাক্সা জেলায় হিন্দু বাঙালিদের দোকান – বাড়িতে হামলার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।
গোরেশ্বর এলাকার একটি গ্রামে পরপর ভাঙ্গচুর করা হয়েছে হিন্দু বাঙালি এবং স্থানীয় বোড়োদের দোকান বা বাড়িতে।
ওই গ্রামের বাসিন্দা বিশ্বজিত দাস বলেন, “এটুকু বলতে পারি, যারা গত বৃহস্পতিবার ভাঙ্গচুর চালিয়েছে আমাদের দোকান বা আরো অনেক দোকানে বাড়িতে, তারা নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলনকারী। তারা মনে করেছে আমরা বাঙালিরা র বোড়োরা নাগরিকত্ব আইনের সুবিধা পাব, তাই তারা স্লোগান দিচ্ছিল বাঙালিদের দোকান ভেঙ্গে দাও, জ্বালিয়ে দাও।”
নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলন কী তাহলে গোষ্ঠীগত বিভাজন আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে?
অসমীয়া ভাষার লেখিকা ও নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার অনুরাধা শর্মা পূজারী বললেন, সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার ভয় ঢুকেছে অসমীয়াদের মধ্যে।
“আমরা যে প্রতিবাদ করছি তা কখনই বাঙালি বা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নয়। আমাদের একটাই কথা – আসাম চুক্তি অনুযায়ী ২৫ মার্চের পরে আসা কোনো ধর্মের – কোনো ভাষাভাষী কোনো বিদেশিকে আসাম গ্রহণ করতে অপারগ। আসামে সবসময়ে সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে থেকেছেন, সেজন্যই আসামভূমিকে শঙ্কর-আজানের দেশ বলা হয়। অসমীয়া হিন্দুদের মহাপুরুষ শঙ্করদেব আর মুসলমানদের আজান একই সঙ্গে উচ্চারিত হয়। সেখানে কোনো ভেদাভেদ হয় না। কিন্তু আমাদের ভাষা যদি সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে, তাহলে অসমীয়ারা তো প্রতিবাদ করবেই।”
পূজারী মনে করেন নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে হিন্দু ভোট ব্যাংক শক্ত করার চেষ্টা করছে বিজেপি।
“আপার আসামে চা বাগানগুলোতে বা বরাক উপত্যকায় তাদের শক্তপোক্ত ভোটব্যাংক আছেই। তাদের চিন্তা ছিল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা নিয়ে – সেখানেও যদি অসমীয়া – বাঙালি হিন্দু আর বাঙালি মুসলমানের মধ্যে বিভাজন ঘটিয়ে দেয়া যায়, তাহলে ক্ষমতাসীন দলই লাভবান হবে।”
সূত্র : বিবিসি