এ কথা বাস্তব যে, আমাদের নতুন প্রজন্ম বিশ্বাস করে বিজ্ঞানের উন্নতি ও অগ্রগতিতে মুসলমানদের কোনো অবদান নেই। তবে তাদের এ বিশ্বাস সঠিক নয়; মূলত বিজ্ঞানের আজ যে উত্থান ও উন্নয়নের পেছনে মৌলিক ভূমিকা পূর্ববর্তী মুসলিম মনীষীদের।
বিজ্ঞানকে উন্নতির শিখরে পৌঁছানোর গোড়ার কারিগর তারা। কিন্তু বিজ্ঞানে আজ মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য দখল নেই। এ ময়দানে যখন তারা পিছিয়ে পড়ে তখন এর নেতৃত্বে আসে পশ্চিমারা এবং তাদের হাত ধরেই বিজ্ঞানের আজকের এ অবস্থান।
তবে ইতিহাস এখনো এ কথা ভুলে যায়নি যে, যে সময় মুসলিম আন্দালুসের (স্পেন) অলিগলি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার আলোয় রঙিন ছিল তখন পশ্চিমে বিরাজ করছিল অসভ্যতা ও মূর্খতার গাঢ় অন্ধকার।
মুসলামানদের এ উন্নতির নেপথ্যে ছিল তাদের ধর্ম ইসলাম, যে ধর্ম তার অনুসারীদের এ কথা জানায় যে, আসমান ও জমিনে যা কিছু বিদ্যমান, তার সবই মানুষের সেবার জন্য মহান আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন।
এদিকে ইঙ্গিত করেই পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা কি দেখ না আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে, তার সবই আল্লাহ তোমাদের সেবায় নিয়োজিত করে দিয়েছেন এবং তোমাদের প্রতি তার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নেয়ামতগুলো পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন?…(সূরা লুকমান, আয়াত : ২০)।’
একই সঙ্গে ইসলাম মুসলমানদের সব সৃষ্টির যথাযথ ব্যবহারেরও নির্দেশনা দিয়েছে। সুতরাং এ জাতি যদি সৃষ্টিতে গবেষণা করে তাহলে তাদের বিজ্ঞানে অগ্রবর্তী হওয়া খুবই স্বাভাবিক। যেমনটি অগ্রবর্তী হয়েছিলেন মধ্যযুগের মুসলিম বিজ্ঞানীরা।
বেশিরভাগ পশ্চিমারা বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদানের কথা কৌশলে চেপে রাখলেও তাদের উদারপন্থি একাধিক গবেষক এটার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছেন যে, পশ্চিমারা বিজ্ঞানের পুনরুজ্জীবন দানে আরব মুসলিমদের কাছে ঋণী।
কেননা, বিজ্ঞান ও গবেষণা জ্ঞান মুসলমানদের আবিষ্কার। তারাই এর মধ্যে প্রথম প্রবেশ করে এবং পরে তা ইউরোপ ও গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়।
ফিলিপ হিট্টি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব দি আরবস’-এ লিখেছেন, ‘মধ্য যুগে কোনো জাতিই সর্বক্ষেত্রে এতটা উন্নতি করতে পারেনি, আরব ও আরবি ভাষাভাষীরা যতটা করেছে’। আরবি ভাষা ও ইসলামবিষয়ক পশ্চিমা গবেষক মন্টগোমারি ওয়াট লিখেছেন, ‘আব্বাসি শাসনামলে বাগদাদে বিশ্বের সর্বপ্রথম মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। কায়রোতে একটি হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়, যেখানে একসঙ্গে অন্তত ৮ হাজার রোগী স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারত। এখানে ছিল নারী-পুরুষের পৃথক পৃথক ওয়ার্ড।
একইভাবে ভিন্ন ভিন্ন রোগীকে আলাদা আলাদা বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হতো। তা ছাড়া, এখানে পাঠাগার ও সেমিনার কক্ষও ছিল। এসব সুবিধা সে সময়ে পশ্চিমা বিশ্বে ছিল কল্পনাতীত।’
রবার্ট ব্রিফোট লিখেন, ‘বিজ্ঞানে আমরা আরব মুসলিমদের কাছে শুধু এ জন্য ঋণী নয় যে, তারা আমাদের বিপ্লবী ধারণা ও সৃজনশীলতা উপহার দিয়েছে; বরং বিজ্ঞানের উত্থানে আরব কালচার ও সংস্কৃতিও বেশ প্রভাব রেখেছে। এক কথায়, বিজ্ঞানের অস্তিত্বই আরবদের থেকে।..এটাও স্বতঃসিদ্ধ যে, আধুনিক শিল্প-সভ্যতার সূচনাতেও এ আরবদেরই অবদান।’
ইতিহাসের নিরপেক্ষ অধ্যয়ন এ কথাই বলে যে, আরব মুসলিমরা আন্দালুসে এমন এমন অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল যেখানে ইউরোপের যুবরাজরাও জ্ঞানার্জনের জন্য আসতে বাধ্য হতো। পরে তারা দেশে ফিরে সেখানেও একই ধারার শিক্ষাব্যবস্থার সূচনা করতে সচেষ্ট হয়। একইভাবে স্পেনে বিদ্যমান অসংখ্য কিতাবাদি ও বইপত্র থেকেও ইউরোপ ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়। এ সবকিছুই পরে ইউরোপে বিজ্ঞানের পুনরুজ্জীবনে সহায়ক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
ইউরোপে ইসলামি সংস্কৃতি পৌঁছার বড় একটি মাধ্যম ছিল ইতালীয় উপদ্বীপের দক্ষিণে, ভূমধ্যসাগরের মাঝ বরাবর অবস্থিত সিসিলি দ্বীপ, এখানে মুসলমানরা অন্তত ১৩০ বছর শাসন করেছে। সে সময়ে এটিকে ইউরোপে ইসলামি সংস্কৃতি বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ একটি কেন্দ্র বিবেচনা করা হত। একই সঙ্গে ক্রুসেড এবং বাইতুল মাকদিস দর্শন ইউরোপীয়দের আরবদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ করে দেয়। এ সময়ও তারা আরবদের থেকে সভ্যতা শেখে।
ফরাসি চিকিৎসক ও ঐতিহাসিক গুস্তাভ লে বোন (১৮৪১-১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দ) তার গ্রন্থ আরব সভ্যতায় লিখেছেন, ‘পশ্চিমাদের ওপর আরবদের যে বিশাল অবদান আমরা তা ততক্ষণ পর্যন্ত অনুধাবন করতে পারব না, যতক্ষণ আমরা ইউরোপের সেই অতীতের সঙ্গে পরিচিত না হব, যখন তারা আক্ষরিক অর্থে অজ্ঞতার কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল।
মধ্যযুগে ইউরোপীয় এ অজ্ঞতার দীর্ঘ এক ইতিহাস রয়েছে। যখন সেখানের কিছু সচেতন ও বুদ্ধিমান লোক আরবদের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করল, তখন দেখল-মরুর লোকদের থেকে তারা বেশ পশ্চাৎপদ এবং প্রায় সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে রয়েছে। ফলে তারা তাদের ইউরোপ থেকে অজ্ঞতার অন্ধকার নির্মূলের ইচ্ছা করল। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোর উৎস তো আরবদের কাছে।
তাই বাধ্য হয়ে আরব মুসলিমদের দরজায়-ই কড়া নাড়ল তারা। আরবদের থেকে সাধ্যমতো জ্ঞান অর্জন করল। আসলে সেকালে জ্ঞান-বিজ্ঞানের রাজভাণ্ডারের অধিপতি তো ছিল আরবরাই।
মুসলিম স্পেনের বিশিষ্ট শল্যবিদ আবুল কাসেম জাহরাবির ‘আততাসরিফ’ গ্রন্থটি ১৪৯৭ সালে ল্যাটিন ভাষায় প্রকাশিত হয়। পরে ইউরোপের প্রায় সব ভাষায় এটির অনুবাদও হয়। আততাসরিফ গ্রন্থটি অন্তত ৫০০ বছর শল্যচিকিৎসায় পশ্চিমাদের কাছে উৎসগ্রন্থ হিসাবে সমানভাবে সমাদৃত ছিল।
এমনকি এ গ্রন্থের ব্যাপারে এ কথাও প্রচলিত ছিল যে, এটি ইউরোপে শল্যচিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারের ভিত্তি স্থাপনে অন্যতম প্রধান সহায়ক হিসাবে ভূমিকা রেখেছে। সে সময়কার চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের জন্য ত্রিশ খণ্ডের এ বিশ্বকোষটি ছিল অক্সিজেনস্বরূপ। সার্জারি থেকে শুরু করে মেডিসিন, ফার্মাকোলজি, অপথ্যালমোলজি, অর্থোপেডিকস, প্যাথলজি, দন্তবিজ্ঞান, পুষ্টিবিজ্ঞান, শিশু চিকিৎসা সবই অন্তর্ভুক্ত ছিল আততাসরিফের ভেতর।
আরেক ফরাসি দার্শনিক রেনো গেনট-যিনি পরে ইসলাম গ্রহণ করে আব্দুল ওয়াহেদ নাম ধারণ করেন, তিনি বলেন, ‘মুসলিমদের সাংস্কৃতিক প্রভাব ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, আততাসরিফ ও অন্যান্য আরব গবেষকদের বইপত্রে ব্যবহৃত শব্দগুলো এমন আরবি ভাষা ছিল, যার মাধ্যমে ইউরোপে আরবীয় চিন্তাধারা স্থানান্তরিত হয়।
এ সময় ইসলামি দর্শন ও আদর্শের স্থানান্তরে আমরা চিকিৎসা শাস্ত্রের পাশাপাশি অনেক কিছুই অর্জন করতে সক্ষম হই।’ আরবদের বইপত্র ইংরেজি ভাষার ওপর এত ব্যাপক প্রভাব ফেলে যে, কিছু শব্দ বিশ্লেষণ করলে আমরা ইংরেজির ওপর আরবির সে প্রভাব স্পষ্ট দেখতে পাই। যেমন : ‘আমিরুল বাহার’ থেকে admiral-এর উৎপত্তি, ‘কিমিআ’ থেকে chemistry, ‘আলজাবার’ থেকে algebra, ‘কিনদি’ থেকে candy, ‘কহওয়া’ থেকে coffee, ‘ইয়াসমিন’ থেকে jasmine, ‘লেমু থেকে lemon, ‘মাখাজিন’ থেকে magayine, ‘সুক্কার’ থেকে sugar, ‘শরাব’ থেকে syrup-এজাতীয় আরও বহু শব্দ আরবির পরিবর্তিত রূপ। উপরোক্ত আলোচনাটি প্রকৃত ইতিহাসের সামান্যতম একটি অংশ। আমরা যদি হতাশাগ্রস্ত না হয়ে এ আলোচনা থেকে আমাদের হৃদয়ে কিছুটা আশার আলো সঞ্চারণ করতে পারি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায়োগিক চর্চায় ফের মনোযোগী হতে পারি, তাহলে আমাদের সেই সোনালি অতীত আবার ফিরিয়ে আনতে পারব ইনশাআল্লাহ! আল্লাহ কবুল করেন। আমিন
তথ্যসূত্র : দুনিয়া ডটকম