ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস, মসজিদে আকসা এবং সমগ্র ফিলিস্তিনের মর্যাদা ও মাহাত্ম্য যে অনেক উচ্চ তা মুসলমানদের প্রতিটি দল স্বীকার করে।
আল কুদসের ইতিহাস : কুদস অর্থ পবিত্র। ‘আল কুদস’ ফিলিস্তিনের জেরুসালেমে পবিত্র ভূমিতে অবস্থিত পবিত্র মসজিদ, যা মসজিদুল আকসা বা ‘বায়তুল মুকাদ্দাস’ নামে পরিচিত। হজরত ইবরাহিম আ: কর্তৃক কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর তাঁর ছেলে হজরত ইসহাক আ:-এর সন্তান হজরত ইয়াকুব আ: ফিলিস্তিনের জেরুসালেম নামক স্থানে ‘আল আকসা’ মসজিদটি নির্মাণ করেন। এরপর তাঁর ছেলে হজরত ইউসুফ আ:-এর বংশধর হজরত দাউদ আ:-এর সন্তান হজরত সুলায়মান আ: তা পুনর্নির্মাণ করেন।
ইসলামের প্রথম কিবলা : আদিতে ‘কাবা’ কিবলা থাকলেও মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস স্থাপনের পর এটি কিবলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আমাদের প্রিয়নবী সা: ওহি লাভ ও নবুওয়াত প্রকাশের সময় বায়তুল মুকাদ্দাসই কিবলা ছিল। যার দিকে মুখ করে রাসূলুল্লাহ সা: ও সাহাবিরা ১০ বছর নামাজ আদায় করেছেন। মদিনায় হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর এই কিবলা পরিবর্তন হয়ে পুনরায় কাবা কিবলা হিসেবে নির্ধারিত হয়। মদিনা থেকে মক্কা দক্ষিণ দিকে এবং বায়তুল মুকাদ্দাস উত্তর দিকে। নবীজী সা: সাহাবায়ে কিরামসহ জামাতে জোহরের নামাজ আদায়রত অবস্থায় কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশ আসে (সূরা-২ বাকারা, আয়াত : ১৪২-১৫১)।
আল-কুদসের ফজিলত : আল-কুরআনের পাঁচ স্থানে মহান আল্লাহ ফিলিস্তিনকে বরকতময়, পুণ্যময় ভূখণ্ড বলেছেন। ‘পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে নিয়ে গিয়েছেন আল মাসজিদুল হারাম থেকে আল মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বরকত দিয়েছি, যেন আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (সূরা বনি ইসরাইল : ০১)।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর আমি তাঁকে ও লুতকে উদ্ধার করে সে দেশে নিয়ে গেলাম, যেখানে আমি বিশ্ববাসীর জন্য বরকত রেখেছি’ (সূরা আম্বিয়া, আয়াত-৭১)। ‘আর যে জাতিকে দুর্বল মনে করা হতো আমি তাদের জমিনের পূর্ব ও তার পশ্চিমের উত্তরাধিকারী বানালাম, যেখানে আমি বরকত দিয়েছি এবং বনী ইসরাঈলের উপর তোমার রবের উত্তম বাণী পরিপূর্ণ হলো। কারণ তারা ধৈর্য ধারণ করেছে। আর ধ্বংস করে দিলাম যা কিছু তৈরি করেছিল ফিরআউন ও তার কওম এবং তারা যা নির্মাণ করেছিল’ (সূরা আরাফ-১৩৭)। ‘আর আমি সুলায়মানের জন্য অনুগত করে দিয়েছিলাম প্রবল হাওয়াকে, যা তার নির্দেশে প্রবাহিত হতো সেই দেশের দিকে, যেখানে আমি বরকত রেখেছি। আর আমি প্রত্যেক বিষয় সম্পর্কেই অবগত ছিলাম’ (সূরা আম্বিয়া, আয়াত-৮১)।
আর তাদের ও যেসব জনপদের মধ্যে আমি বরকত দিয়েছিলাম সেগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে আমি অনেক দৃশ্যমান জনপদ স্থাপন করেছিলাম এবং তাতে ভ্রমণ করার ব্যবস্থা নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম। (তাদেরকে বলা হয়েছিল) ‘তোমরা এসব জনপদে রাত-দিন (যখন ইচ্ছা) নিরাপদে ভ্রমণ করো’ ( সূরা সাবা : ১৮)।
সূরা সাবার এই আয়াতের তাফসিরে আল্লামা মাহমুদ আলুসি তাফসিরে রুহুল মাআনিতে উল্লেখ করেছেন, ‘এই জনপদ’ বলে আয়াতে যেই অঞ্চলের কথা এসেছে সেখানে এই জনপদ বলতে শামকে বোঝানো হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস বলেন, এ জনপদ হলো, বায়তুল মুকাদ্দাস (রুহুল মাআনি, ২২/১২৯)।
হাদিসে আছে : ‘কাবা শরিফ তথা মসজিদুল হারামে নামাজে এক লক্ষ গুণ সওয়াব, মদিনা শরিফে মসজিদে নববীতে নামাজে ৫০ হাজার গুণ সওয়াব, বায়তুল মুকাদ্দাসে নামাজে ২৫ হাজার গুণ সওয়াব’ (বুখারি, মুসলিম)। সহিহ বুখারি ও মুসলিমে হজরত আবু সাইদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো (জায়গা ইবাদাতের) উদ্দেশ্যে ভ্রমণে বের হওয়া যাবে না- মসজিদুল হারাম, মসজিদুল আকসা এবং আমার এই মসজিদ (হাদিস-৭০৭)।
মিরাজের ইতিহাস : বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের কাছে সবসময় সম্মানিত। রাসূলুল্লাহ সা: মিরাজ রজনীতে মসজিদুল হারাম তথা কাবা শরিফ থেকে মসজিদুল আকসা তথা বায়তুল মুকাদ্দাস প্রথম সফর করেন, যা ইসরা নামে পরিচিত (সূরা-১৭ বনি ইসরাইল, আয়াত-১)। প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সা: মিরাজ গমনের সময় এই মসজিদে নামাজ আদায় করেন। খেলাফতের আমলে আল-কুদস : ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর রা: -এর খিলাফতকালে ৬৩৮ সালে বায়তুল মুকাদ্দাস, জেরুসালেমসহ পুরো ফিলিস্তিন সম্পূর্ণরূপে মুসলমানদের অধিকারে আসে। ৬৩৭ সালের জেরুসালেম অবরোধ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ও রাশিদুন খিলাফতের মধ্যকার একটি সংঘর্ষ। রাশিদুন সেনাবাহিনী আবু উবাইদাহ রা:-এর নেতৃত্বে ৬৩৬ সালের নভেম্বরে জেরুসালেম অবরোধ করলে এই ঘটনা সংঘটিত হয়। ছয় মাস পর খ্রিষ্টান পোপ পেট্রিয়ার্ক সফ্রোনিয়াস তৎকালীন খলিফা উমর রা:-এর ব্যক্তিগত উপস্থিতির শর্তে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হন। ৬৩৭ সালের এপ্রিলে খলিফা উমর রা: জেরুসালেমে আসেন এবং এ সময় শহর মুসলিমদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। মুসলিমদের পক্ষে খলিফা উমর এতে স্বাক্ষর করেন এবং খালিদ বিন ওয়ালিদ রা:, আমর ইবনুল আস রা:, আবদুর রহমান বিন আউফ রা: ও মুয়াবিয়া রা: মুসলিম পক্ষে চুক্তির সাক্ষী হন। ৬৩৭ সালের এপ্রিলের শেষের দিকে জেরুসালেম কাগজেকলমে খলিফার কাছে আত্মসমর্পণ করে। ৫০০ বছরের নিপীড়নমূলক রোমান শাসনের পর এই প্রথম ইহুদিরা জেরুসালেম বসবাস ও উপাসনা করার জন্য পুনরায় অনুমতি পায়।
ক্রুসেডের আমলে আল-কুদস ও বতর্মান: ক্রুসেড বলতে পবিত্র ভূমি অর্থাৎ জেরুসালেম এবং কন্সটান্টিনোপলের অধিকার নেয়ার জন্য ইউরোপের খ্রিষ্টানদের সম্মিলিত শক্তি মুসলমানদের বিরুদ্ধে ১০৯৫-১২৯১ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকবার যে যুদ্ধ অভিযান পরিচালনা করে সেগুলোকে বোঝায়। ১০৯৬ সালে খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা সিরিয়া ও ফিলিস্তিন জবরদখল করে নেয়। ১১৮৭ সালে মুসলিম বীর সিপাহসালার সুলতান সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী রহ: পুনরায় জেরুসালেম শহর মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন।
এরপর থেকে খ্রিষ্টান ও ইহুদি চক্র ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এ অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ইহুদিরা তৎকালীন তুরস্কের শাসক সুলতান আবদুল হামিদের কাছে ফিলিস্তিনে বসতির অনুমতি চায়; দূরদর্শী সুলতান তাদের এ দুরভিসন্ধিমূলক প্রস্তাবে রাজি হননি। বর্তমানেও বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে ইসরাইলরা আল-কুদস নিজেদের দখলে নিতে চায়। কিন্তু তথাকার মুসলমানরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে আল্লাহ্ তায়ালার ওপর ভরসা রেখে এখনো লড়াই করছে, ফিলিস্তিনের হারিয়ে যাওয়া গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য।
আল কুদ্স বা ফিলিস্তিন অসংখ্য নবী-রাসূলের স্মৃতিবিজড়িত, এর আশপাশে অনেক নবী-রাসূলের সমাধি রয়েছে। এটি দীর্ঘকালের ওহি অবতরণের স্থল, ইসলামের কেন্দ্র এবং ইসলামী সংস্কৃতির চারণভূমি ও ইসলাম প্রচারের লালনক্ষেত্র। এই পবিত্র ভূমির ভালোবাসা প্রত্যেক মোমিনের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত। আর আল্লাহর ইচ্ছায় তা সারা জীবন বজায় থাকবে।
শিক্ষার্থী : ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা