সুমাইয়া মিহান ২৩ বছর আগে মুসলিম হন। তিনি ওয়েন্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ক্রিমিনাল জাস্টিস’-এ স্নাতক করেন। কর্মজীবনে তিনি একজন সাংবাদিক, বাজার বিশ্লেষক ও ফ্রিল্যান্সার গ্রাফিক ডিজাইনার। বর্তমানে সন্তানদের নিয়ে উত্তর ক্যারোলাইনাতে বসবাস করেন
বেশির ভাগ অমুসলিমের ধারণা, মুসলিমরা ঈসা (আ.)-কে অস্বীকার করে। ভুল-বোঝাবুঝি ও অনুমাননির্ভরতা থেকে এই ‘মিথ’ তৈরি হয়েছে। বাস্তবতা হলো, ঈসা (আ.)-এর প্রতি মুসলিমরা পরিচ্ছন্ন বিশ্বাস লালন করে। খ্রিস্টানদের মতো তাঁকে ভালোবাসে; সম্ভবত তাদের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। যদিও ঈসা (আ.)-এর পরিচয় নিয়ে উভয় সম্প্রদায়ের মত ভিন্ন। মুসলিম বিশ্বাস মতে, তিনি আল্লাহর একজন অনুগত বান্দা ও সম্মানিত নবী। মানবজাতির কাছে তিনি আল্লাহর বাণী নিয়ে এসেছিলেন। ঈসা (আ.) একজন মানুষ। তিনি আল্লাহর ছেলে নন। আল্লাহর কোনো স্ত্রী বা সন্তান নেই। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন! সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি কোনো সন্তান গ্রহণ করেননি। তাঁর সার্বভৌমত্বে কোনো অংশীদার নেই। তিনি দুর্দশাগ্রস্ত নন যে তাঁকে অভিভাবক গ্রহণ করতে হবে। সুতরাং সসম্ভ্রমে তাঁর মাহাত্ম্য ঘোষণা করুন।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ১১১)
একজন খ্রিস্টান তরুণী হিসেবে আমি ঈসা (আ.)-এর প্রতি পারিবারিক বিশ্বাস নিয়ে অনেক সংগ্রাম করেছি। শেষ পর্যন্ত পৃথিবীতে তাঁর ভূমিকা জানার চেষ্টা করি এবং সেটাই আমাকে ইসলামের পথ দেখায়।
ঘরে মায়ের সঙ্গে প্রার্থনায় বসা এবং পুরনো ছবি পরিষ্কার করার একটি দৃশ্য এখনো মনে পড়ে। আমি একটি ছবি বের করি। একজন তরুণপ্রাণ যুবকের ছবি। যাঁর মাথায় লম্বা লম্বা চুল ও চোখ দুটি নীল। আমি মায়ের কাছে তাঁর পরিচয় জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘ইনি হলেন যিশুখ্রিস্ট’। এরপর আমার প্রশ্ন ছিল, ‘তিনি যদি কয়েক শ বছর আগের মানুষ হন, তা হলে তাঁর ছবি এত জীবন্ত হয় কী করে? এটা কি বাস্তব ছবি? কেউ কি বলেছেন তিনি দেখতে কেমন ছিলেন? এমন অনেক প্রশ্ন করেছিলাম—আমার মা যার উত্তর দিতে পারেননি। তিনি আমাকে শুধু বললেন, যিশু ছিলেন স্রষ্টার পুত্র। তখন থেকেই আমার মনে প্রশ্ন জাগে স্রষ্টার কেন সন্তানের দরকার হলো? প্রশ্নটি আমার মনের গভীরে গেঁথে গেল। বহু বছর এটি আমার মনের ভেতর কাঁটা হয়ে রইল। কিন্তু আমি এর কোনো সদুত্তর পাইনি।
আমার মনে হয়, খ্রিস্ট সমাজেও ঈসা (আ.) পরিচয় ও ভূমিকার বিষয়টি মীমাংসিত নয়। তাদের এক দলের মতে তিনি ঈশ্বরের পুত্র আর অপর দলের মতে তিনি স্বয়ং ঈশ্বর। আমার পরিবারের সদস্যরাও ঈসা (আ.)-এর ব্যাপারে দ্বৈত বিশ্বাস লালন করে। তাদের বিশ্বাস আমাকে দ্বিধাগ্রস্ত করে। আমি বুঝতে পারি না, আমি কার উপাসনা করব? স্রষ্টার, না যিশুর। শেষ পর্যন্ত আমি যিশুর উপাসনার সিদ্ধান্ত নিই। কেননা আমার দাদি প্রার্থনার সময় হাত জোড় করে বলতেন, ‘যিশুর নামে’, তবে আমার প্রার্থনা বিঘ্নিত হলো। আমার ধর্মীয় জীবন এলোমেলো হয়ে গেল এবং আমি মানসিকভাবে কষ্ট পাচ্ছিলাম। প্রার্থনার বাধ্যবাধকতা ও সময়সূচি না থাকাও আমাকে ব্যথিত করছিল। প্রয়োজন বোধ করলে আপনি যখন খুশি প্রার্থনা করবেন এবং ইচ্ছা না করলে কখনোই না। প্রার্থনা করা না-করার মধ্যে কোনো তফাত নেই। তাই আমরা কেবল প্রয়োজনের সময় তার প্রার্থনা করি।
কলেজে ভর্তি হওয়ায় পড়ালেখার ক্ষেত্রে কিছুটা স্বাধীনতা পেলাম। তখন ঈসা (আ.)-এর পরিচয় অনুসন্ধানেরও সুযোগ এলো। অনেকগুলো চার্চ পরিদর্শন করলাম। ক্যাথলিক, প্রেসবিটারিয়ানসহ অন্যান্য গির্জায় গেলাম। কোনো গির্জায় গিয়ে বা কোনো বক্তব্যে আমি ঈসা (আ.)-এর ব্যাপারে তৃপ্তিকর উত্তর পেলাম না। তখন বুঝতে পারলাম, আমার উচিত স্রষ্টার অনুসন্ধান করা। আমি যিশুর উপাসনা বন্ধ করে স্রষ্টার একক উপাসনা শুরু করলাম, তাঁর কোনো শরিক বা মাধ্যম ছাড়া। অথচ তখনো আমি জানি না, এটাই ইসলামের মূলভিত্তি।
১৯৯৬ সালে যখন আমার বয়স ২২ বছর কোরআনের অনুবাদ পড়ার বহু বছর আগেই আমি একত্ববাদের শিক্ষা গ্রহণ করি এবং তা দ্বারা অনুপ্রাণিত হই। কোরআনের কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পর যখন তাতে একত্ববাদের সন্ধান পেলাম, আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর পেলাম, তখন অশ্রু ধরে রাখতে পারছিলাম না। কয়েক মাস তা অবিরাম পড়ে গেলাম। প্রতিটি শব্দ আমার উপলব্ধিকে স্পর্শ করল।
সুরা মারিয়াম তিলাওয়াত করার সময় ঈসা (আ.) সম্পর্কে যে তথ্য পেলাম তাতে আমার মন প্রশান্ত হলো। যেখানে তাঁর অলৌকিক জন্মকথা, তাঁর জীবন ও আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ হিসেবে তাঁর ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। সুরা আলে ইমরানের ৪৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ঈসা (আ.)-এর ভূমিকা ও কর্মকাণ্ডের বিবরণ দিয়েছেন। আমি উপলব্ধি করলাম ইসলামই আমার ধর্ম। আমি মহান আল্লাহ, তাঁর অবতীর্ণ সব গ্রন্থ ও সব প্রেরিত পুরুষের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম। মুসলিম হলাম। তবে হ্যাঁ, সব মুসলিমের মতো আমিও ঈসা (আ.)-কে ভালোবাসি। আমার সন্তানদের তাঁর ও তাঁর মায়ের জীবনসংগ্রামের গল্প বলি। তাঁদের সম্মান করতে শেখায় কোরআন যেমনটি শিক্ষা দিয়েছে।
অ্যাবাউট ইসলাম থেকে আতাউর রহমান খসরুর ভাষান্তর।