দেশে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে প্রতারণা। এমন কোনো খাত নেই যেখানে প্রতারণার জাল ছড়ানো নেই। প্রতারণায় প্রধান টার্গেট করা হচ্ছে শিক্ষিত বেকার যুবক চাকরিপ্রত্যাশীদের। শহরের দেয়ালে, ইলেকট্রিক পিলার, যাত্রীবাহী বাসে আকর্ষণীয় বেতনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির নামে প্রতারণার লিফলেট সাঁটানো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও এমনই এক জায়গা। বুক ভরা আশা নিয়ে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যায় আর ফিরে আসে নিঃস্ব হয়ে। দুষ্টচক্র এভাবে চাকরির প্রলোভন দিয়ে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা। প্রতারক চক্রের মহাজনরা আছে প্রভাবশালীদের মধ্যে, অথচ তারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বড় বড় রাঘব বোয়ালের ইন্ধনে ঘরে-বাইরে চলছে প্রতারণার মহোৎসব।
পুলিশ, র্যাব ও পিবিআইয়ের একাধিক রিপোর্টে জানা গেছে, নানা কায়দায় প্রতারণার ফাঁদ পাতে চক্রের সদস্যরা। সাধারণত সহজ-সরল মানুষ ও শিক্ষিত বেকাররাই তাদের মূল টার্গেট। কম খরচে বিদেশ পাঠানো, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনে চাকরি, বিকাশ কিংবা মোবাইল ফোনে বড় পুরস্কার জেতার অফার, জাদুর বাক্সে টাকাকে ডলারে রূপান্তর, কম দামে ভালো জিনিস বিক্রি, অনলাইনে বিনিয়োগ করে দ্রুত অধিক মুনাফা অর্জন ও ভাগ্য পরিবর্তনের নামে নানান বিচিত্র ও অভিনব কৌশলে প্রতারণা করে এরা।
নিজের বয়ানে এক প্রতারিত যুবকের অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি। ২০০৯ সালে প্রথম ঢাকা আসি। শুনেছি ‘ঢাকার আকাশে টাকা ওড়ে’। অভাবের সংসার। মা-স্ত্রী-সন্তানদের ভরণপোষণ, দায়দেনা থেকে মুক্তির জন্যই চাকরির খোঁজে জীবনের প্রথম ঢাকায় আসা। পরিচিত কারো ঠিকানা জানা নেই। শুনেছি গ্রামের চাচাতো ভাইরা মিরপুরে থাকেন। সায়েদাবাদ থেকে মিরপুর অনেক দূর। রাত তখন ৮টা, চলে গেলাম মিরপুর-১১ নম্বরে। নতুন মানুষ, অপরিচিত জায়গা, তার ওপর রাত। আশপাশে অনেক চা-দোকান খোলা, মানুষের আনাগোনাও প্রচুর। একজন চা-দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই এখানে কোথাও খাবার হোটেল আছে? দোকানদার হাত ইশারায় একটি হোটেল দেখিয়ে দিলেন। খাওয়ার পর্ব শেষে ঘুমের পালা। কারণ শরীর অনেক ক্লান্ত। আবার চায়ের দোকানে ফিরে দোকানদারকে বললাম, থাকার জায়গা আছে? আমি ঢাকা শহরে নতুন কিছুই চিনি না, সহযোগিতা প্রয়োজন। দোকানদার একটি টিনশেড বাসার মালিক; তার ওখানে রুম খালি আছে। কোনো কিছু না বলে উঠে গেলাম তার বাসায়।
সকালে ফ্রেশ হয়ে নাশতা সেরে বের হলাম চাকরির খোঁজে। কিছু দূর সামনে যাওয়ার পর একটি চাকরির বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল। বিজ্ঞাপনের নিচে বড় করে ফোন নম্বর দেয়া আছে। ফোন দিলাম; রিং একবার হতে না হতেই রিসিভ করে এক মহিলা কথা বললেন। অফিসের ঠিকানা জিজ্ঞেস করলাম, বললেন মতিঝিল ৪০৩/এ পঞ্চম তলা পেট্রল পাম্পের পেছনে। রওনা দিলাম মতিঝিলের উদ্দেশে। ঠিকানা খুঁজে পেলাম। একজন নেমে এসে আমাকে উপরে নিয়ে গেল। অফিস মোটামুটি পরিপাটি চার-পাঁচটি টেবিলে সাত থেকে আটজন কর্মকর্তা। অফিসের নাম ‘সিনহা গ্রুপ’। আমাকে বসের রুমে নিয়ে গেল। বসের রুমে যাওয়ার জন্য আমাকে তিন তিনটি দরজা অতিক্রম করতে হয়েছে। মনে অনেক ভয় ছিল, জীবনের প্রথম চাকরির ইন্টারভিউয়ের মুখোমুখি। কাগজপত্র বসের কাছে দিলাম। কাগজ দেখেই বললেন, ওকে আপনি চার নম্বর টেবিলে গিয়ে বসুন, আমি বলে দিচ্ছি, আপনার নিয়োগপত্র তৈরি করার জন্য। কোনো প্রশ্ন করা ছাড়াই আমার চাকরি হয়ে গেল। বেতন ১১ হাজার টাকা। মনটা বেশ আনন্দিত, চার নম্বর টেবিলে বসা মতিন সাহেব বললেন, আপনি তোফাজ্জল? জি, আমি তোফাজ্জল। আপনার নিয়োগ চূড়ান্ত। আপনি তিন নম্বর টেবিলে গিয়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা জমা দিয়ে নিয়োগপত্র বুঝে নিন, আর আপনার ফ্যাক্টরি কোথায় উনি ঠিকানা বলে দেবেন। নিমিষেই টাকা জমা দিলাম। হাতে একটি খাকি খাম ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আপনার অফিস গুলশানে।
চাকরি নামের সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে লাগলাম। গুলশান বনানীর নাম কত শুনেছি! আজ বাস্তবে সেই গুলশান-১। চাকরি করব, বাড়িতে টাকা পাঠাব, অভাব-অনটন দূর হবে। কিন্তু ঠিকানাটা যাকে দেখাই কেউ বলতে পারে না। এই নম্বরের বিল্ডিং গুলশানে নেই। তড়িঘড়ি করে মতিঝিল অফিসে ফোন দিলাম, ফোন বন্ধ। আর বুঝতে বাকি নেই- আমি প্রতারণার শিকার। বিকেল ঘনিয়ে আসছে, আসরের আজান শুনে মসজিদ খুঁজে বের করলাম। নামাজ শেষে সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচারের ভার ছেড়ে দিলাম। মসজিদ থেকে বাইরে বের হতে না হতেই এক ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার বাড়ি কি নোয়াখালী? অবাক হয়ে বললাম, জি নোয়াখালী, কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনতে পারলাম না। অজুখানায় আপনার দু’চারটি কথা শুনেই বুঝলাম। পরে কথায় কথায় ঘটে যাওয়া সব কিছু লোকটির সাথে শেয়ার করলাম। ভদ্রলোক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এদের গোড়া অনেক শক্ত, রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় এ সব চক্র গড়ে ওঠে। প্রশাসনিকভাবেও সহায়তা পায়।
মতিঝিল ও মিরপুর এলাকায় প্রতারকচক্র অনেক সক্রিয়। তারা কখনো ওসি, কখনো সেনাকর্মকর্তা, কখনো বড় কোনো কোম্পানির কর্মকর্তা সেজে প্রায় হাজার হাজার বেকার চাকরিপ্রত্যাশীর কাছ থেকে চাকরি দেয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বাদ পড়েননি সাবেক হাজারো র্যাব, পুলিশ ও সেনাকর্মকর্তা। রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সেলফি তুলে সেই সেলফি কাজে লাগিয়ে প্রতারক চক্র প্রতারণা করে অসহায় লোকজনের সাথে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এপিএস পরিচয় দিয়েও করে থাকে প্রতারণা। স¤প্রতি বিভিন্ন জায়গা থেকে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী এ প্রতারক চক্রকে গ্রেফতার করে।
কথাসাহিত্যক হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনও প্রতারক চক্রের হাত থেকে রেহাই পাননি। তার কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে রবিউল ইসলাম নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে ডিবি। জহির উদ্দিন নামে একজন ব্যবসায়ী জানান, ডিএসওর নম্বর থেকে তার কাছে ফোন করে বলে, বিকাশ হেড অফিস থেকে তাকে কল করা হবে সে যেন তাদের চাওয়া তথ্য দিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর এক ব্যক্তি তাকে ফোন দিয়ে বলেন, তিনি বিকাশের হেড অফিস থেকে বলছেন। ওই ব্যক্তি ভিকটিমের বিকাশ এজেন্ট অ্যাকাউন্টটি আপডেটের কথা বলে কৌশলে ভিকটিমের কাছ থেকে ওটিপি কোড সংগ্রহ করে। পরে ভিকটিমের বিকাশ এজেন্ট নম্বর থেকে এক লাখ ৭০০ টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়। পরে ওই ব্যবসায়ী সিআইডির কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করলে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পায়।
অনলাইনে প্রতারিত হওয়া ৭০ শতাংশ মানুষই মামলা করতে চায় না। অনেকে সামাজিক অবস্থানের কথা চিন্তা করে এসব প্রতারণার ঘটনা চেপে যান। ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিও নানা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অহরহ। এক শ্রেণীর উশৃঙ্খল সুন্দরী মেয়ে টেলিফোনে অনৈতিক সুবিধা দেয়ার কথা বলে বা প্রেমের ফাঁদ পেতে যুবকদের তাদের বাড়িতে নিয়ে আটকে রেখে চাঁদাবাজি করছে। ফোনে বা ব্যক্তিগতভাবে এসব নারীর সাথে পরিচয় হলে ওই নারীর অনুরোধে বা প্রতারণায় তার বাড়িতে গেলে তাকে আটকে রেখে তার সাথে নগ্ন ছবি তোলে। এরপর তা প্রকাশের ভয় দেখিয়ে টাকা দাবি করা হয়। এসব কাজে বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য এ মেয়েরা অর্থও বিনিয়োগ করে।
নানা ধরনের প্রতারণার ফাঁদ পেতে চার দিকে ওৎ পেতে রয়েছে নানা প্রতারক চক্র। কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। মামলার পর গ্রেফতার হলেও দ্রুত জামিনে বেরিয়ে এসে আবারো বেপরোয়া হয়ে উঠছে এ চক্রের সদস্যরা। শুধু রাজধানীতে পাঁচ হাজার প্রতারক চক্র সক্রিয় রয়েছে। অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, আইন প্রয়োগ বা অপরাধীদের গ্রেফতার করে এদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। প্রতারণা থেকে রক্ষা পেতে সাধারণ মানুষের সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।