শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১৪ অপরাহ্ন

শর্তের বেড়াজালে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ

মো: হারুন-অর-রশিদ
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২২
  • ৯৪ বার

গণতন্ত্র একটি উন্মুক্ত চর্চা। এর মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে প্রস্ফুটিত হয়। শৃঙ্খল দিয়ে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে না। রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি মননের উন্নয়ন সাধনের জন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকল্প নেই। গণতন্ত্র মানেই হলো, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ না হয় এমন সব কার্যকলাপ ব্যতীত রাষ্ট্রের নাগরিকরা নির্ভয়ে নিজেদের বক্তব্য ও কার্যকলাপ করতে পারবেন। রাষ্ট্রের সব নাগরিক উন্মুক্ত রাজনৈতিক চর্চা করতে পারবেন। সভা-সমাবেশে সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী কোনো প্রকার বাধার সৃষ্টি করতে পারবে না। পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশের সংবিধানেও জনগণের এই অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। যেমন- আমাদের দেশের সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ সংবিধানে থাকলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন নেই; বরং শর্তের বেড়াজালে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশের অধিকারকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী বিরোধী রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের ওপর নিপীড়কের ভূমিকা পালন চলছে। এটি সংবিধান ও নাগরিক অধিকারের বিপরীত চর্চা।

একটি নৈশভোটের আয়োজন করে বৃহত্তম জনসমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দলকে সংসদের বাইরে রেখে ‘ইয়েস হুজুর’ মার্কা বিরোধী দলকে সংসদে রেখে এই দেশের সংসদকে উত্তর কোরিয়ার সংসদের মতো রাবার স্ট্যাম্প সংসদ বানানো হয়েছে। উত্তর কোরিয়ায় যেমন সরকারি তালিকার বাইরে নির্বাচনে অন্য কোনো প্রার্থী বেছে নেয়ার সুযোগ থাকে না, তেমনি বাংলাদেশে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নামকাওয়াস্তে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করে, সরকারি তালিকার বাইরে কেউ নির্বাচিত হতে পারেনি। আজকে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী অনেকটা উত্তর কোরিয়ার শাসকের মতো একচ্ছত্র, একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা ভোগ করছে। উত্তর কোরিয়ার মতোই আমাদের দেশের শাসক পরিবার ও ক্ষমতাসীন নেতার প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য দেখানো প্রত্যেক নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক করতে চাচ্ছে। এর বিপরীত হলে আইসিটি অ্যাক্ট হাতে হাতকড়া পরাতে বিন্দুমাত্র সময় নিচ্ছে না সরকার। সেটি আমরা অবলোকন করছি।

সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি পোষা প্রাণীর মতোই আচরণ করছে। রওশন এরশাদ সরকারের চরম আনুগত্যে দীক্ষিত হয়েছেন। তার এই চরম দীক্ষিত হওয়াটাকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও তার পন্থীরা মনে করছে, সরকারের কাছে নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন করার শামিল। তাই তারা মাঠে-ময়দানে সরকারের চরম দুর্নীতি ও অপশাসনের বিরুদ্ধে জোর কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করেছিল। কিন্তু সরকার সেটিকে ভালোভাবে নেয়নি যার কারণে জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত এক নেতাকে দিয়ে আদালতে মামলা করিয়ে জিএম কাদেরের দলীয় কার্যক্রম স্থগিত রাখার কৌশল নেয়। কোনো রাজনৈতিক নেতার রাজনৈতিক কার্যকলাপ আদালতের মাধ্যমে বন্ধ করার নজির মনে হয় পৃথিবীতে এটিই অদ্বিতীয়। এখানে সরকারের ভূমিকা যে খুব বেশি তা প্রমাণিত হয়েছে যখন আমরা দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী একই সাথে রওশন এরশাদ, সাদ এরশাদ ও জিএম কাদেরকে নিয়ে বসেছেন। এভাবে কোনো বিশেষ সুবিধা দান বা কূটকৌশলের জালে আটকে একটি রাজনৈতিক দলকে একান্ত সরকারি দলের পোষা প্রাণীর মতো সংসদে বিরোধী দল বানিয়ে রাখাটা নিশ্চয়ই গণতন্ত্রের জন্য শুভকর কিছু নয়।
আমাদের সংসদের বিরোধী দল আর উত্তর কোরিয়ার সংসদের বিরোধী দলের ভূমিকা একই রকমের মনে হচ্ছে। উত্তর কোরিয়ার সংসদেও তিনটি বিরোধী দল আছে। কিম জং উনের নেতৃত্বাধীন ওয়ার্কার্স পার্টির রয়েছে সবচেয়ে বেশি আসন। অন্যদিকে, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পার্টি আর চন্ডোইস্ট চঙ্গু পার্টির সামান্য কিছু আসন রয়েছে। তবে এই তিনটি দলের মধ্যে বিশেষ কোনো তফাত নেই। তারা সবাই মিলে তৈরি করেছে এক জোট যেটি মূলত দেশ পরিচালনা করে। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি, জাসদ-ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টি-রাশেদ খান মেননদের জনসমর্থনহীন রাজনৈতিক কিছু দল নিয়ে সংসদ গঠন করে সবাই মিলেই জোট গঠন করে রাষ্ট্রকে ‘চুষে খাচ্ছে’ বলে জনগণের ধারণা।

যে দেশের সরকার স্বৈরশাসনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় সেই দেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলের অবস্থা যা হওয়ার তাই হচ্ছে। বিরোধী দল সমাবেশ করার জন্য চাইল নয়াপল্টন, সরকার দিলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সাথে ২৬টি শর্ত যেই শর্তগুলো কোনো অবস্থাতেই গণতান্ত্রিক সভা-সমাবেশের জন্য প্রযোজ্য নয়।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দেয়ার পেছনে সরকার যুক্তি হিসেবে বলেছে- এটি একটি ঐতিহাসিক স্থান। কারণ এখানে শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছেন এবং ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী এখানেই আত্মসমর্পণ করেছে। ঘটনা দু’টিই সত্য। তবে এর মধ্যে ‘কিন্তু’ আছে। ৭ মার্চের ভাষণ যখন দিলেন, তখন এই দেশ ছিল পাকিস্তান। ওই সময় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছিল একটি উন্মুক্ত ময়দান। আর এখন এর ভেতরে এত স্থাপনা তৈরি হয়েছে যে, এখন এটি সমাবেশ করার উপযুক্ত নয়। ৭ মার্চের ভাষণের সময় পাকিস্তান সরকার জনগণকে সমাবেশে আসতে বাধা দিয়েছে এমন তথ্য কোনো বই-পুস্তকে আছে বলে কারো জানা নেই।

অন্য দিকে, ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বিজয় সূচিত হয়েছে; ওই সময় পাকিস্তানি বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। সেখানে যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের কোনো প্রতিনিধি বা মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী বা কোনো সেক্টর কমান্ডার বা কোনো বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা সেখানে উপস্থিত ছিলেন না বলে অভিযোগ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী থাকলেও এই ঘটনায় দেশের মানুষের বিজয় গৌরবকে অনেকটা ম্লান করার ঐতিহাসিক সাক্ষীও এই উদ্যান। তাছাড়া এর ভেতরে প্রবেশের পথকে এতটাই সঙ্কীর্ণ করা হয়েছে যেমন করে এই দেশের গণতন্ত্রকে সঙ্কীর্ণ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপিকে এমন একটি বদ্ধ জায়গায় সমাবেশ করার অনুমতি দিয়ে বিএনপির গণতান্ত্রিক পথ চলাটাকে রুদ্ধ করতে চেয়েছিল বলে মনে হয়।

অন্য দিকে, বিএনপি ৭ মার্চের উন্মুক্ত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মতোই একটি উন্মুক্ত জায়গায় সমাবেশ করতে চেয়েছিল যেখানে ৭ মার্চের মতো উন্মুক্ত হয়ে জনগণ সমাবেশে অংশগ্রহণ করতে পারবে। সরকার বিএনপির এই চাওয়াকে বানচাল করতে গিয়ে এক নারকীয় ঘটনার জন্ম দিয়েছে।

১০ ডিসেম্বর সমাবেশের তারিখ ছিল। দলীয় নেতাকর্মীরা সমাবেশকে সামনে রেখে দলীয় কার্যালয়ে জমায়েত হয়েছিল। এটি একটি দলের গণতান্ত্রিক চর্চার অংশ। কিন্তু সরকার রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী দিয়ে এক অরাজক পরিবেশের সৃষ্টি করল। নির্বিচারে গুলি করে একজনকে হত্যা করল, অসংখ্য নেতাকর্মীকে গুলি করে আহত করেছে এবং প্রায় ৫০০ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠিয়ে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে কারাগারে আটকে রেখেছে। শুধু তাই নয়, রাতের আঁধারে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে গ্রেফতার করে তাদেরও কারাগারে আটকে রেখেছে। শুধু তাই নয়, দলীয় কার্যালয়ে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে।

সাংবাদিকরা দেখেছেন, সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে- পুলিশ সাদা ব্যাগে করে বোমা নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। বিএনপি অফিসে বোমা পাওয়া গেছে বলে পুলিশ বোমার নাটক সাজিয়েছে। এটি একটি সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আচরণ হতে পারে না। অথচ যে অজুহাতে বিএনপিকে নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে দিলো না, পুলিশ চার দিন রাস্তা আটকে রেখে নিজেরাই জনভোগান্তির সৃষ্টি করেছে। দেশের জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে লাখ লাখ লোকের উপস্থিতিতে বিএনপির ১০টি সমাবেশের একটি সমাবেশেও কোনো বিশৃঙ্খলা ছিল না। এখানে উপলব্ধির বিষয় হচ্ছে- বিএনপির সমাবেশগুলোতে লাখ লাখ লোকের উপস্থিতি সরকারের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে যার কারণে তারা রাজনৈতিক মোকাবেলার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়ে বিরোধী দল দমনের পথকে বেছে নিয়েছে।

আজকে শুধু বিরোধী রাজনৈতিক দলের লোকজনই নয়; সাধারণ মানুষও রাজপথে নেমে পড়েছে। অবাধ দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের বেসামাল ঊর্ধ্বগতি ও অপশাসনের কারণে অর্থনীতিতে যে ভঙ্গুরতা দেখা দিয়েছে জনসমাবেশগুলোতে জনগণের উপস্থিতিতে এসবের প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। দিশেহারা জনগণ পরিবর্তন চায়। তাই ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে, সেখানে তাদের স্বাধীন মতের প্রতিফলন দেখতে চায়। তবে, সরকার তার অধীনস্থ নির্বাচন করার অভিপ্রায় থেকে না নড়ার জেদে আগামী নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে সাধারণ জনগণের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ-পর্যবেক্ষকরা সন্দিহান। তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়ে হতাশাগ্রস্ত।

ডলার-সঙ্কট ও মুদ্রাস্ফীতিগ্রস্ত অর্থনীতির ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের বোঝা। মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ বিপজ্জনক সময়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সরকার এই সত্যটিকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। শুধু তাই নয়; ২০১৮ সালের মতো বেসামরিক প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নির্বাচন কমিশন মিলে আরেকটি ফেইক নির্বাচন করার চেষ্টা করছে। আজকে যে জিনিসটি সত্য হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে তা হলো- নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে ২০১৮ সালের পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাবে না। বাস্তবতার আলোকে, রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির একমাত্র বিকল্প।

গণতন্ত্রকে বিকশিত করার জন্য জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা কেবল জনগণের হাতেই নিহিত থাকে। জনগণকে পাশ কাটিয়ে, ধোঁকা দিয়ে, মুক্তকণ্ঠকে চেপে ধরে, জেল-জুলুম, নিপীড়ন-নির্যাতন করে স্বৈরতন্ত্রের খুঁটি মজবুত করলেও গণতন্ত্রের খুঁটিকে তছনছ করে দেয়। ধ্বংস করে দেয় সাম্য, স্বাধীনতা ও সাংবিধানিক অধিকারের ভিত্তিকে। অথচ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল স্লোগানই হলো- নাগরিক স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করা। এটিই ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা। কিন্তু আজ এই দেশের নাগরিক সেই প্রেরণা থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে।

harun_980@yahoo.com

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com