নিপীড়িত মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার জন্য ব্যবস্থা নিতে মিয়ানমারকে নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত (আইসিজে)। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এটি প্রথমবারের মতো কোনো আন্তর্জাতিক রায়। দেশটি বিরুদ্ধে জেনেসাইডের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ অভিযোগ মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি’র বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয়। ২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর অকথ্য নির্যাতন, গ্রাম আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া, বহু মানুষকে হত্যা ধর্ষণের কারণে সাত লাখ ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এ কারণে আইসিজেতে অভিযোগ করা হয়। এই অভিযোগ অস্বীকার করতে গত মাসে সশরীরের হেগের আদালতে হাজির হন অং সান সু চি।
ইসলামী সহযোগী সংস্থার (ওআইসি) সদস্য রাষ্ট্র গাম্বিয়া গত নভেন্বর মাসে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এ মামলা দায়ের করেছে। এ অভিযোগে বলা হয়, শুধু আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন করে জেনোসাইডই ঘটানো হয়নি, বরং রোহিঙ্গারা এখনও নিরাপদ নয়। আদালত জেনোসাইড বা গণহত্যা হয়েছে কি না সিদ্ধান্ত নেবে। এর পাশাপাশি গাম্বিয়ার দাবি ছিল সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে এবং আরো ক্ষতি ঠেকাতে কিছু সাময়িক বিধি-নিষেধ আরোপ করার। গাম্বিয়া মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গাদের সহিংসতা থেকে সুরক্ষা এবং সেনাবাহিনীর নৃশংসতা বন্ধের নির্দেশ, জেনোসাইডের সব প্রমাণ সংরক্ষণ এবং চার মাসের মধ্যে এসব ব্যবস্থা গ্রহণের অগ্রগতির প্রতিবেদন আদালতে পেশ করার নির্দেশ দেয়ার আহ্বান জানায়। এতে আদালতের ১৭ জন বিচারক সম্মতি জানান। তাদের মধ্যে মিয়ানমারের নিয়োগকৃত বিচারক জার্মানির ক্লাস ক্রেস এবং চীনের বিচারক শিও হানকিনও রয়েছেন। বিচারকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, মিয়ানমার প্রথম চার মাসের মধ্যে তাদের প্রথম প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি ছয় মাস অন্তর এ প্রতিবেদন জমা দেবে। আইসিজে জাতিসঙ্ঘের তদন্তকারীদের প্রবেশের সুযোগ দেয়ার নির্দেশ দেননি মিয়ানমারকে। ২০১৭ সালের নিধন অভিযানের তথ্য সংগ্রহের আগে, জাতিসঙ্ঘের তথ্য অনুসন্ধানী মিশনের সদস্যদের প্রবেশ করতে দেয়নি মিয়ানমার। উপর্যুক্ত ব্যবস্থাগুলো মেনে নেয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে মিয়ানমারের। গাম্বিয়া যদি মনে করে মিয়ানমার এ আদালতের রায় মেনে চলছে না, তাহলে তারা নতুন করে দ্বারস্থ হতে পারে। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের সাহায্যও নিতে পারে।
নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে চীন ভেটো ক্ষমতার অধিকারী এবং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন বন্ধে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়নি চীনের কারণেই। আন্তর্জাতিক আদালতের সভাপতি আবদুল কাভি ইউছুফ বলেন, মামলার শুনানি অব্যাহত থাকবে। এখন গাম্বিয়াকে প্রমাণ করতে হবে, মিয়ানমারে জেনোসাইডের ঘটনা সম্ভবত ঘটেছে এবং আবারো তা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ব্যাপারে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে হলেও সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে। উক্ত আদালতের রায়ের এক দিন আগে মিয়ানমারের সুধীজনের শতাধিক গ্রুপ এক চিঠিতে আইসিজের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করেছে। অভিযোগগুলো খণ্ডন করতে অং সাং সু চি যখন হেগে যান তখন সারা বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
আইসিজেতে এই রায় সু চির ভাবমর্যাদা আরো অনেক ক্ষুণ্ন করবে। বিশ্বের বিবেকবান মানুষেরা তাকে ঘৃণা করছে। অন্য দিকে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহানূভূতি আরো বাড়বে।
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে ২৩ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজে) যে নির্দেশ দিয়েছেন, তার তাৎপর্য নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ হওয়া স্বাভাবিক। রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন মিয়ানমার চালিয়েছে সে সম্পর্কে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক আলোচনা বহু হয়েছে; কিন্তু তা মিয়ানমারকে বিরত রাখতে পারেনি। লক্ষ্য করার বিষয়, ২০১৭ সালের আগে বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের দু’বার যে বিরোধ দেখা দিয়েছিল রোহিঙ্গা ইস্যুতে, তা দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক বৈঠকে সমাধান হয়েছিল। কিন্তু নতুনরূপে দেখা দেয়া এ বিরোধ শুধু নির্যাতনের স্বরূপ নিয়ে নয়, বিরোধ মীমাংসায় দ্বিপক্ষীয় কূটনেতিক আলোচনার ব্যর্থতায় এবং মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত আন্তর্জাতিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অভাবে জটিল অবস্থায় পৌঁছেছে। দুই প্রভাবশালী রাষ্ট্র চীন ও রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে চীনের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক পৃষ্ঠপোষকতা মিয়ানমারকে চরম একগুঁয়ে করে তুলেছে। অপর দিকে ভারত তার নিজের স্বার্থে মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে এসেছে।
গত নভেন্বর মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের চিফ প্রসিকিউটরের দফতর থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রসঙ্গে আদালতের চিফ প্রসিকিউটরের দফতর বরাবর একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, যা চলমান আছে। এরপর আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সংঘটিত গণহত্যার অভিযোগে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলা। আইসিজের এ সংক্রান্ত রায় মিয়ানমারের অবশ্য পালনীয় কাজের সীমা নির্দেশ করে দিয়েছে। মিয়ানমারের নিরাপত্তার অজুহাতে সহিংস ব্যবস্থাকে গ্রহণযোগ্য বলে সাফাই গেয়েছে কেউ কেউ। ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়া শর্তহীন সমর্থন দেয়নি। এ ইস্যুতে ভোট দেয়ার সময় বিরত থেকে তারা পরোক্ষভাবে মিয়ানমারকে সহায়তা জুগিয়েছে।
গত ডিসেম্বরে বিষয়টি আদালতে উঠলে গণহত্যার অভিযোগকারী গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী আবু বক্কার মারি তামবাদু শুনানি করতে গিয়ে, কেন আদালত রোহিঙ্গা গণহত্যাকে আমলে নেবেন, এ ব্যাপারে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। অপর পক্ষে মিয়ানমারের অং সান সু চি ‘কোনো গণহত্যা হয়নি’ বলেছেন এবং যুদ্ধাপরাধের মতো অপরাধ হতে পারে যুক্তি দিয়ে এ জন্য মিয়ানমারের নিজ আইনে অপরাধীদের বিচার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ‘গণহত্যা সনদ’ অনুযায়ী, হত্যাসহ সব ধরনের নিপীড়ন থেকে নিবৃত্ত থাকা; সেনাবাহিনীসহ অন্য কেউ গণহত্যা ঘটাতে কিংবা, ষড়যন্ত্র বা উসকানি দিতে না পারে তা নিশ্চিত করা; গণহত্যার সব ধরনের সাক্ষ্য প্রমাণ রক্ষা এবং চার মাসের মধ্যে নির্দেশিত গৃহীত ব্যবস্থা আদালতকে জানানোর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমারের আচরণ কেবল অমানবিক নয়, একই সাথে সব ন্যায়নীতিবিরোধী।
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে তাদের ‘বাঙালি’ বলে আখ্যায়িত করার পক্ষে মিয়ানমারের বক্তব্যের কোনো ন্যায়ানুগ ভিত্তি নেই। অপর পক্ষে ধর্ষণ-আগুন জ্বালিয়ে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়াসহ তাদের জোর করে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়ার নীতি একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার পাশবিক নীতি। গাম্বিয়া ১৯৪৯ সালের গণহত্যা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে গণহত্যা বিষয়ে আইনে হস্তক্ষেপ চেয়েছে। মিয়ানমার ‘গাম্বিয়ার অভিযোগ দায়ের করার কোনো বৈধতা নেই’ বলে আইনি হস্তক্ষেপ চেয়েছে। তা আইসিজে গ্রহণ করেননি। গণহত্যা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী মিয়ানমার গণহত্যা প্রতিরোধে বাধ্য। এ কারণে গাম্বিয়ার অভিযোগ করার বৈধতা আদালত কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার চরম অসততার পরিচয় দিয়ে আসছে। দ্বিপক্ষীয় কূটনীতিতে সবসময় বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছে, কিন্তু কোনো কার্যকর পদক্ষেপই নেয়নি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ আশ্বাসের পর আশ্বাস পেয়ে দেশটির আন্তরিকতার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ করেনি। বরং রোহিঙ্গারা স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের নির্ধারিত তারিখে ফিরে যেতে অস্বীকার করলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাদেরই দায়ী করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের আগের দিন রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে মিয়ানমার তার এক মিশনের পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেছে, যেখানে বলা হয়েছে ‘যুদ্ধাপরাধ হয়েছে কিন্তু গণহত্যা হয়নি।’ আইসিজের নির্দেশ মিয়ানমার পালন করবে কি না, এ প্রশ্ন উঠতে পারে। যেহেতু এ রায়ে মিয়ানমারকে কোনো শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে না, তাই পালন করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে না-ও করতে পারে। আদালত যেসব নির্দেশ দিয়েছেন সেসব গণহত্যা সম্পর্কিত। এতে যেসব নির্দেশ দিয়েছেন আদালত, এতে গণহত্যার সাথে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে মিয়ানমারের। গণহত্যা হয়েছে, এটা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে আইসিজের রায়ে। গণহত্যার মতো একটি জঘন্য অপরাধের বিচার করা জরুরি।
যেসব দেশ মিয়ানমারকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন করে আসছে, তাদের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে এখন।