সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২২ পূর্বাহ্ন

ওমিক্রন কিভাবে অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দেয়

ডা: মো: তৌহিদ হোসাইন
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
  • ১৩৫ বার

কিভাবে অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দেয় তা নির্ভর করে কতগুলো ফ্যাক্টরের ওপর। কত শক্তভাবে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের এস-১ সাব-ইউনিটের সাথে মানব কোষের এসিই-২ রিসেপ্টরের সাথে বাইন্ড হয় এবং এস-২ সাব-ইউনিট, যা কোষের মেমব্রেনের সাথে ফিউজ হয়ে সেলের ভেতর ঢুকে তার ফিউশন শক্তির ওপর ভাইরাসের কোন লোকেশনে কয়টি এবং কী ধরনের মিউটেশন হয়েছে তার ওপর।

ভাইরাসের সংবেদনশীল অংশগুলো যাদের উন্মুক্ত উপস্থিতির কারণে মানুষের ইমিউন সিস্টেম অ্যান্টিবডি তৈরি করে।

ইতঃপূর্বেকার ভ্যারিয়েন্টের মিউটেশনের ধরন
ওমিক্রন বর্তমান বিশ্বের গেম চেঞ্জিং ভাইরাস। ওমিক্রন নির্ণয়ে বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় তিনটি টার্গেট জিনের একটি অর্থাৎ এস জিনটি পাওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং বলা যায় এই এস জিন না পাওয়াটাই বরং ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট ডিটেকশনের মার্কার হয়ে উঠেছে। ওমিক্রন কিভাবে তার এত সংক্রমণশীলতা বাড়িয়েছে?

ভাইরাস তার সংক্রমণশীলতা বাড়ায় দু’ভাবে। ওমিক্রনের স্পাইক প্রোটিনের সাথে এসিই-২ এর আসক্তি বাড়িয়ে এবং ভাইরাসের ফিউশনের মাধ্যমে সেলে অ্যান্ট্রি বাড়িয়ে। দ্বিতীয়ত, এর মানুষের ইমিউন সিস্টেমকে অর্থাৎ টি-সেল এবং বি-সেলকে ফাঁকি দিয়ে।

সারকুলেটং অ্যান্টিবডি অর্থাৎ যে অ্যান্টিবডি ভাইরাসকে মেরে ফেলার জন্য রক্তে ঘুরে বেড়ায় সেসব অ্যান্টিবডি মানুষের রক্তে টিকা প্রদান বা ন্যাচারাল ইনফেকশনের মাধ্যমে তৈরি হয়। এদের কিভাবে ভাইরাস ফাঁকি দেয় তা বুঝতে হলে ভাইরাসের গঠন ভালোমতো বুঝে নিতে হবে।

আমরা জানি, করোনাভাইরাস হলো একটি প্রোটিন পার্টিকেল। আর প্রোটিন মানেই অন্য প্রাণীর শরীরে ঢুকলে কমবেশি ইমিউনোজিক। আমাদের শরীরে ন্যাচারাল অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার নিয়ম হলো, ভাইরাসের যে অংশ সবচেয়ে বেশি ইমিউনোজেনিক, সে অংশের বিরুদ্ধেই ইমিউন সিস্টেম দ্বারা সবচেয়ে কার্যকর অ্যান্টিবডি তৈরি করা। করোনাভাইরাসের আরএনএ, নিওক্লিওক্যাপসিড প্রোটিন, স্পাইক প্রোটিন এবং নন-স্ট্রাকচারালসহ আরো যে ২৮টি প্রোটিন আছে তার সবই কমবেশি ইমিউনোজেনিক। তাই বলে সব অংশের ইমিউনোজেনিসিটি সমান নয়।

করোনাভাইরাসের অন্তত তিনটি বেশি সংবেদনশীল অংশ আছে। কেন্দ্রে থাকা আরএনএ, নিওক্লিওক্যাপসিড প্রোটিন ও স্পাইক প্রোটিন। এ তিনটির মধ্যে আবার স্পাইক প্রোটিন সবচেয়ে ইমিউনোজেনিক। শুধু তা-ই নয়, অ্যান্টি-নিউক্লিওক্যাপসিড অ্যান্টিবডির শক্তি স্থায়িত্ব অ্যান্টি-স্পাইক প্রোটিন অ্যান্টিবডির চেয়ে বেশ কম। স্পাইক প্রোটিনের মধ্যে রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইন (আরবিডি) অংশ সবচেয়ে বেশি ইমিউনোজেনিক। আরবিডি অংশের মধ্যে আবার এস-১ সাবিউনিট সবচেয়ে বেশি ইমিউনোজেনিক। যত বেশি ইমিউনোজেনিক তত শক্তিশালী অ্যান্টিবডি রেসপন্স। এখন প্রশ্ন হতে পারে কেন স্পাইক প্রোটিনের আরবিডি অংশ এত ইমিউনোজেনিক। এর উত্তর হলো, স্পাইক প্রোটিনের সাইড চেইন সাধারণত প্লাইকোসিলেটেড, যা মূলত সুগার দিয়ে গ্লাইসিন শিল্ড তৈরি করে প্রোটিন অংশকে চাদরের মতো ঢেকে রাখে। গ্লাইসিন শিল্ড দিয়ে ইমিউনোজেনিক গুণসম্পন্ন প্রোটিন অংশকে ঢেকে রাখায় স্পাইক প্রোটিনের অন্যান্য অংশের ইমিউনো-জেনিসিটি কম। কিন্তু স্পাইক প্রোটিনের আরবিডি অংশের গ্লাইসেন বা সুগার দিয়ে ঢেকে রাখার মতো সুগার কম। ফলে স্পাইক প্রোটিনের এই আরবিডি অংশের প্রোটিন অনেকটাই বাইরে উন্মুক্ত থাকে, ফলে এর ইমিউনো-জেনিসিটি অনেক বেশি। আর ইমিউনো-জেনিসিটি বেশি থাকায় এর বিরুদ্ধে শক্তিশালী ন্যাচারাল অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। ঠিক এ কারণেই বিজ্ঞানীরা যখন আর্টিফিসিয়ালি স্টিমুলেশন দিয়ে ভ্যাকসিনে প্রয়োগ করে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে চায়, তখন তাদেরও লক্ষ্যমাত্রা থাকে যেন স্পাইক প্রোটিনের আরবিডি অংশের বিপরীতে বেশি অ্যান্টিবডি তৈরি হয়।

গবেষণায়ও যেমনটি দেখা গেছে ন্যাচারাল ইনফেকশনের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরির ক্ষেত্রে শতকরা ৯০ ভাগ সেরাম নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরি হয় স্পাইক প্রোটিনের রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইনকেই টার্গেট করে।

আরবিডি ডোমেইনে এস১ এবং এস২ সাবিউনিট থাকে। এ দুটোর মধ্যে এস১ সাবিউনিট বেশি ইমিউনোজেনিক কারণ এস২ সাবিউনিট অংশ সুগার শিল্ড দিয়ে ঢাকা থাকে। করোনাভাইরাস তার টিকে থাকার লড়াইয়ে মিউটেশনের মাধ্যমে স্পাইক প্রোটিনে এমন কিছু পরিবর্তন আনে, যাতে শরীরে টহলরত অ্যান্টিবডিগুলো যাদের কাজই হলো ভাইরাস মেরে ফেলা, তারা তাদের চরম শত্রু ভাইরাসকেই চিনতে পারে না। একেই বলে অ্যান্টিবডি ফাঁকি দেয়া।

প্রকৃতপক্ষে স্পাইক প্রোটিন হলো প্রকৃতির ২০টি অ্যামাইনো এসিড দিয়ে পুঁথির মালার মতো করে সাজানো একটি চেইন। কোন অ্যামাইনো এসিড কোথায় বসবে তা জেনেটিকালি পূর্বনির্ধারিত। জেনেটিক কোডে পরিবর্তনের ফলে ১২৭৩ পয়েন্টের যেকোনো অ্যামাইনো এসিডের একটি, অন্য একটি অ্যামাইনো এসিড দিয়ে পরিবর্তিত কিংবা সংযোজন-বিয়োজন হলেই মিউটেশন।

করোনায় মূল মিউটেশন হয় নিউক্লিওটাইড চেইনে। এ চেইনের নির্দেশনা অনুযায়ী এর অন্যান্য অংশ যেমন নিউক্লিওক্যাপসিড প্রোটিন ও স্পাইক প্রোটিন, মেমব্রেন প্রোটিন প্রভৃতিতে মিউটেশন তথা অ্যামাইনো এসিডের প্রতিস্থাপন, সংযোজন বা বিয়োজন হয়। প্রজাতির মধ্যকার মিউটেশন এমন একটি শক্তিশালী পরিবর্তন, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ৮০ কোটি বছর পর্যন্ত এর প্রভাব ধরে রাখতে পারে।

ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের আরবিডি অংশের সাথে মানব কোষের সেল সারফেসে থাকা এসিই-২ এর বাইন্ডিং হলে এটি শক্তভাবেও হতে পারে আবার ঢিলেঢালাভাবেও হতে পারে। শক্তভাবে হওয়া মানে মানব কোষের এসিই-২ এর প্রতি স্পাইক প্রোটিনের রিসেপ্টর বান্ডিং ডোমেইনের (আরবিডি) আসক্তি বেড়ে যাওয়া। ঢিলেঢালাভাবে সংযুক্ত হওয়া মানে ভাইরাসের প্রতি মানব কোষের আসক্তি কমে যাওয়া। আসক্তি কমে যাওয়া মানে কোষে ভাইরাস কম ঢুকতে পারা। আর কম ঢুকতে পারার অর্থ ভাইরাসের র‌্যাপলিকেশন কম হওয়া, র‌্যাপলিকেশন কম হওয়া মানে কম রোগ সৃষ্টি করা। ভাইরাসটি মানব কোষের ভেতরে ঢুকে সব মেশিনারি নিজের দখলে নিয়ে ভাইরাসের আরএনএতে থাকা জেনেটিক কোডের নির্দেশনার আওতায় নিয়ে আসে। এ নির্দেশনায় মানুষের কোষের সাইটোপ্লাজমে থাকা ভাইরাসের জেনেটিক কোড মানুষের ডিএনএকে নির্দেশ করে প্রচুর পরিমাণে ভাইরাসের নিজের মতো করে প্রোটিন তৈরি করতে। মেসেঞ্জার আরএনএ কোষের সাইটোপ্লাজমে এসে রাইবোজমের সহযোগিতায় ভাইরাসের বংশবৃদ্ধির প্রয়োজনীয় প্রোটিন তথা অসংখ্য বাচ্চা ভাইরাস তৈরি করে এবং একসময় মানব কোষ ভাইরাস দ্বারা পূর্ণ হয়ে যায়। তার পর এসব ভাইরাস বের হয়ে পাশে থাকা আরেকটি সুস্থ কোষকে আক্রান্ত করে। এভাবে মানুষের যেসব কোষের সারফেসে এসিই-২ রিসেপ্টর থাকে তার সবগুলোকেই আক্রান্ত করতে পারে।

মিউটেশন বেশি হলেই পরিণতি খারাপ হবে এমন কোনো কথা নেই। ভাইরাসের কোনো জায়গায় কতটা মিউটেশন হয়েছে, তা জিন সিকুইন্সিং করে ল্যাবোরেটরিতে বের করা যায়। কোন জায়গায় মিউটেশনে কতটুকু ক্ষতি বা ভালো হবে তা আগে থাকতেই বলা যায় না। তবে শুধু এতটুকু বলা যায় ভাইরাসের কোন অংশে মিউটেশনে কোন ধরনের কাজের ইম্প্যাক্ট পড়বে। কারণ একই স্পাইক প্রোটিনে একধরনের মিউটেশন এসিই-২ এর প্রতি আসক্তি বাড়ায়, আরেক ধরনের মিউটেশন আসক্তি কমাতেও পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে, চীনের ওয়াহানে আবিষ্কৃত অরিজিনাল করোনাভাইরাসের চেয়ে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের স্পাইক প্রোটিনের মানব কোষের এসিই-২ রিসেপ্টরের প্রতি আসক্তি ২.৫ গুণ বেশি। এ আসক্তি বেড়ে যাওয়া মানেই হলো সংক্রমণশীলতা বেড়ে যাওয়া।

বিটা ভ্যারিয়েন্টের আসক্তি অনেকটা ওমিক্রনের মতোই। তবে আল্ফা ভ্যারিয়েন্টের স্পাইক প্রোটিনের এসিই-২ আসক্তি অরিজিনাল সারসকভ-২ এর চেয়ে ৬ গুণ বেশি। আবার ওমিক্রনের স্পাইক প্রোটিনের আরবিডি অংশে এন৫০১ওয়াই মিউটেশন থাকায় এফিনিটি ৬ গুণ বেশি। অথচ ফাইনালি এফিনিটি দেখাচ্ছে ২.৫ গুণ বেশি। এর কারণ হলো ওমিক্রনের স্পাইক প্রোটিনের কে৪১৭এন, কিউ৯৩আর এবং জি৯৬এস পজিশনের মিউটেশনগুলো এফিনিটি না বাড়িয়ে বরং কমিয়ে দেয়। ফলে আল্টিমেটলি এফিনিটি ৬ গুণ না বেড়ে বরং ২.৫ গুণ হয়ে যায়। ওমিক্রনের স্পাইক প্রোটিনের আসক্তি বেড়ে যাওয়াটাই বেশি সংক্রামক হওয়ার একমাত্র কারণ নয়। এর আরো বহু কারণ যার অনেকই এখনো অজানা। সুতরাং বলা যায় মিউটেশন বেশি হলেই যেসব সময় এফিনিটি বেড়ে যাবে বা খারাপ হবে তা কিন্তু নয়।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে মানুষের শরীর কোষের এসিই-২ এর সাথে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের বাইন্ডিং এফিনিটিই যদি এর সংক্রামক হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হয়, তা হলে অন্য প্রাণিকোষের এসিই-২ এর সাথে সারসকভ-২ এর সাথে বাইন্ড করে কেন অন্য প্রাণীদের আক্রান্ত করে না। এর কারণ আর কিছুই না বরং অন্য প্রাণীর এসিই-২ এর অ্যামাইনো এসিডের সামান্য গঠনগত রদবদল, যা মানুষের এসিই-২ এর সাথে কিছুটা ভিন্নতা দেখায়।

একজন ব্যক্তি আক্রান্ত হওয়ার পর তখনই সে সুস্থ হয় যখন তার শরীরে করোনার বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত স্পেসিফিক অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এই অ্যান্টিবডি সর্বদা রক্তে প্রবহমান ও টহলরত অবস্থায় থাকে। যখনই ওই একই ভাইরাস আবার আক্রান্ত করতে চায়, তখনই রক্তে চলাচলকারী অ্যান্টিবডি ভাইরাসকে চিনে ফেলে এবং তাকে মেরে ফেলে। কিন্তু ওমিক্রন নামক এই নতুন ভ্যারিয়েন্টটি কে রক্তে চলমান অ্যান্টিবডি চিনতে পারে না। অর্থাৎ ভাইরাস ভ্যারিয়েন্টটি অ্যান্টিবডি থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখে। এ আড়ালটুকু করতেই অন্তত ডজনখানেক বা তার চেয়েও বেশি মিউটেশন হতে হয় স্পাইক প্রোটিনে।

চার শ্রেণীর অ্যান্টিবডি স্পাইক প্রোটিনের আরবিডি অংশে কাজ করে। আরবিডি অংশের-বাইন্ডিং নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডিকে চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন গবেষকরা, যা সংক্রমণশীলতায় ভূমিকা রাখে।

ক্লাস-১ : এসিই-২ ব্লকিং অ্যান্টিবডি যা স্পাইক প্রোটিনকে খোলা কনফরমেশনে আবদ্ধ করে;
ক্লাস-২ : এসিই-ব্লকিং অ্যান্টিবডি যা আরবিডি অংশের বাইন্ডিং নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডিকে খোলা কনফরমেশন এবং ক্লোজড কনফরমেশন উভয় ক্ষেত্রেই আবদ্ধ করে;
ক্লাস-৩ : যেসব অ্যান্টিবডি এসিই-২ কে ব্লক করে না এবং আরবিডিকে ওপেন কনফরমেশন এবং ক্লোজড কনফরমেশন উভয় ক্ষেত্রেই আবদ্ধ করে না;
ক্লাস-৪ : অ্যান্টিবডিগুলোকে নিরপেক্ষ করে, যা এসিই-২ সাইটের বাইরে এবং শুধু উন্মুক্ত কনফরমেশনে আবদ্ধ হয়।

এখানে দেখা যাচ্ছে ক্লাস-১ ও ক্লাস-২ অ্যান্টিবডি আরবিডি অংশের এসিই-২ রিসেপ্টরের সাথে বাইন্ড করে কাজ করে। আর ক্লাস-৩ ও ক্লাস-৪ শ্রেণীর অ্যান্টিবডি স্পাইক প্রোটিনের আরবিডি অংশের অন্য সাইটে কাজ করে। বিটা ও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট কেবল ক্লাস-১ ও ক্লাস-২ শ্রেণীর অ্যান্টিবডি যারা এসিই-২ সাথে বাইন্ড করে কাজ করে তাদেরকে প্রতিরোধ করতে পারে। কিন্তু ক্লাস-৩ ও ক্লাস-৪ টাইপের অ্যান্টিবডির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না। অথচ ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের মিউটেশনগুলো এমনই যা খুব ভালো মতোই এই চার শ্রেণীর অ্যান্টিবডিকে রুখে দিতে পারে।

ওমিক্রন ন্যাচারাল ইনফেকশনের কারণে তৈরি অ্যান্টিবডি কার্যকরভাবেই রুখে দিতে পারে।

ওমিক্রনের স্পাইক প্রোটিনের ৫০১ নম্বর পজিশনে এন৫০১ওয়াই মিউটেশন থাকায় এসিএ-২ এর প্রতি আসক্তি ৬ গুণ বেড়ে যায়। এসব কারণে মডার্না, ফাইজার ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা দিয়ে পুরোপুরি দুই ডোজ ভ্যাকসিনেটেড করার পর ওমিক্রনের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা যথাক্রমে ৩৩ গুণ, ৪৪ গুণ ও ৩৬ গুণ কমে যায়। তৃতীয় ডোজ দেয়ার দুই সপ্তাহ পরই ওমিক্রনের বিরুদ্ধে কার্যকারিতা ৯০ শতাংশ এবং ৩ মাস পর শূন্যের কোঠায় নেমে আসে।

এ পর্যন্ত অনুমোদন পাওয়া আটটি মনোক্লনাল অ্যান্টিবডি যেমন, সিলজেভিমেব, টিক্সাজেভিমেব, সট্রোভিমেব ইত্যাদি ওমিক্রনের বিরুদ্ধে অনেকটাই অকার্যকর।

এখন একটি প্রশ্ন খুব জোরেশোরে সামনে আসছে যে, অন্য অনেক রোগের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন দেয়ার পর কিংবা ন্যাচারাল ইনফেকশনের কারণে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে লাইফ লং ইমিউনিটি দিয়ে থাকে। অথচ করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডির স্থায়িত্ব মাত্র ছয়-আট মাস। এটির কারণ হলো করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট ফরমেশনের ক্ষমতা। এ ব্যাপারে একটা সাধারণ নিয়ম হলো, যে ভাইরাসের যত বেশি মিউটেশন হবে, তার তত বেশি ভ্যারিয়েন্ট ফরমেশনের চান্স থাকে। যত ভ্যারিয়েন্ট ফরমেশনের চান্স থাকবে, তত ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা এবং স্থায়িত্ব কমে যাবে। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের অনেক বেশি মিউটেশন ক্ষমতা থাকায়ই সাব-ভ্যারিয়েন্ট গঠনের আধিক্য বেশি। শুধু তা-ই নয়, এই একই কারণে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ও স্থায়িত্ব দুটোই কম।

আমাদের স্মরণে রাখা ভালো যে, যে ভ্যারিয়েন্ট যত বেশি সংক্রামক হয়, তার নিজেকে অ্যান্টিবডি থেকে আড়াল করার ক্ষমতাও তত বৃদ্ধি পায়।

আবার এটাও স্মরণে রাখা ভালো যে, সংক্রমণশীলতা ও অ্যান্টিবডি ফাঁকি দেয়ার ক্ষমতা বেশি হলে তা সাধারণত মারাত্মক হয় না। মারাত্মক হলে তা সংক্রমণশীল হয় না।

ওমিক্রনের ইনফেকটিভিটি অনেক বেশি হওয়ায় বিশ্ববাসী এত উদ্বিগ্ন। কিন্তু এর কারণে মৃত্যুহার অনেক অনেক কম; অথচ এর আগের করোনার সারস-কভ এবং মারস-কভের মর্টালিটি যথাক্রমে ১০ শতাংশ ও ৩০ শতাংশ থাকলেও ওগুলো নিয়ে বিশ্ব মোটেই উদ্বিগ্ন নয়; কারণ ওই সব করোনার প্যান্ডেমিসিটি ছিল অনেক কম। মানব জাতির ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দেয়ার মতো এমন একটি ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট এলো প্রচণ্ড ঝড়ের গতিতে অথচ থেমে গেল ঘূর্ণিঝড়ের উপক‚লে আছড়ে পড়ে ঝড় থেমে গিয়ে বৃষ্টিবর্ষণ করার মতো করে। ওমিক্রন আমাদের অনেককেই আক্রান্ত করল, তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হলো না বটে; কিন্তু সবার শরীরেই অ্যান্টিবডি তৈরি করে দিয়ে গেল মানে বিশ্ববাসীকে ভালোমতোই ভ্যাকসিনেট করে গেল। তাই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট হলো ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’, ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’। আল্ফা, বিটা, গামা ও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ধরন থেকেই লক্ষণীয় যে, ভাইরাসটি আস্তে আস্তে বেশি বেশি করে অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দেয়ার ক্ষমতা বাড়াচ্ছে। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে এসে তার চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে। ওমিক্রনের বর্তমান তাণ্ডব করোনা প্যান্ডেমিসিটির ‘শেষের শুরু মাত্র’।

ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টই আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিলো, বড় শত্রু ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টকে সরিয়ে দিলো, শত্রু বেশে ঘরে ঢুকে বন্ধু বেশে বের হয়ে গেল। সবশেষে একটি সতর্কবাণীও দিয়ে গেল এই ওমিক্রন যে ‘বিশ্ববাসী সজাগ থাক, আবার যেকোনো সময় যেকোনো ভ্যারিয়েন্ট বেশে মানব সমাজে ঢুকে যেতে পারি। সেই সময়কার আমাকে মোকাবেলার প্রস্তুতিটুকুন নিতে যেন ভুল না হয়, সাব-ভ্যারিয়েন্ট গঠন করে সেই কথাও জানান দিয়ে গেলাম’।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান,
ডিপার্টমেন্ট অব হিস্টোপ্যাথলজি,
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি, শের-ই-বাংলা নগর, ঢাকা।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com