‘আমরা জন্মেছিলাম পৃথিবীর এক আশ্চর্যময় রূপায়ণের কালে। প্রথম মহাযুদ্ধ, স্বাধীনতা আন্দোলন, মুসলিম রেনেসাঁর পুনরুত্থান, রাশিয়ার বিপ্লব, বিজ্ঞানজগতের নতুন নতুন আবিষ্কার, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নবরূপ সূচনা—এসবের শুরু থেকে যে প্রভাবের মধ্যে শৈশব কেটেছে তারই আদর্শ আমাদের মধ্যে ছাপ রেখেছে সুগভীর করে। স্বাধীনতা চাই, শান্তি চাই, সাম্য চাই—এই বাণী তখনকার আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হতো।’ জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামাল ‘একালে আমাদের কাল’ গ্রন্থে এই কথাগুলো লিখেছিলেন তাঁর জীবন সম্পর্কে। তাঁর জীবনব্যাপী কর্ম ছিল স্বাধীনতা, সাম্য ও শান্তির অন্বেষণে নিবেদিত। তাঁর কর্মজীবনের ব্যাপ্তি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি শতকজুড়ে, অর্থাৎ ব্রিটিশ আমল, দেশভাগ-পরবর্তীকাল এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ। মানবতার নিরন্তর সাধনায় তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল বিশাল ও সুগভীর। তিনি তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে কত ধরনের সংগঠনে সক্রিয় ছিলেন, তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। সামাজিক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক, নারী ও শিশু সংগঠনসহ আরো নানা ধরনের কর্মকাণ্ডে তিনি যুক্ত ছিলেন।
রোকেয়া তাঁকে বলেছিলেন, ‘তুই তো ফুল কবি। তা ফুল কবি হয়েও সমাজের কাজ করতে হবে।’ সুফিয়া কামাল নিজেও বলেছেন, রোকেয়ার দারুণ প্রভাব আমার জীবনে। তিনি ছিলেন রোকেয়ার মানসকন্যা, তাঁরই ভাবাদর্শে গড়া।
রোকেয়া সাখাওয়াতের আদর্শে অনুপ্রাণিত সুফিয়া কামাল নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন আজীবন। আত্মশক্তি বিকাশ ব্যতীত নারী অধিকার অর্জিত হবে না, এ কথা তিনি বিশ্বাস করতেন। সমাজে নারীর অধস্তনতা দূর করে তার শক্তিকে জাগিয়ে তোলার কাজ করেছেন সুফিয়া কামাল। তিনি নারীর অধিকারকে বিচ্ছিন্ন বা একক হিসেবে কখনো দেখেননি। নারীর অধিকারহীনতার ক্ষেত্রটি শুধু পুরুষের আধিপত্যের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেননি। নারীর অধস্তনতার পেছনে রয়েছে নারীর প্রতি সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি। সেই কারণে তিনি নারী আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন। গড়ে তুলেছেন নারী সংগঠন। তিনি মনে করতেন, নারী আন্দোলনের মূলনীতি হচ্ছে মানবমুক্তি। তাই তিনি বলেছেন, নারীমুক্তিই মানবমুক্তি।
তিনি ছিলেন সব সময়ের জন্য আধুনিক। সেই তরুণীকাল থেকে তিনি সমাজের কাজ শুরু করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই কাজ করে গেছেন। এর মধ্যে সমাজের নানা পরিবর্তন হয়েছে, জীবনের চাহিদার পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনময় নতুনকে গ্রহণ করার মতো অগ্রসর চেতনার অধিকারী ছিলেন তিনি।
আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা প্রত্যক্ষ করছি নারীর প্রতি সেই রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে নারীর সক্রিয় দৃশ্যমান উপস্থিতির পরও নারীকে মানুষ হিসেবে দেখা হয় না। সেই কারণে নারী যতই যোগ্য হয়ে সক্রিয় হোক, নারীকে সহিংসতার শিকার হতে হচ্ছে শুধু নারী হওয়ার কারণে।
বর্তমান সময়ে আমরা লক্ষ করি কভিড-১৯ সংক্রমণে সমগ্র বিশ্ব যখন মহামারির মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে, নারীর প্রতি সহিংসতা তখনো থেমে নেই। বরং সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, জাতীয় ও বৈশ্বিক তথ্য তা-ই বলছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মধ্যে যে সাংঘর্ষিক অবস্থান সেটি দূর না হলে নারী-পুরুষ সমতার প্রশ্নটি সোনার পাথরবাটি হয়ে থাকবে। আজ প্রাথমিক শিক্ষায় বালক-বালিকা অংশগ্রহণ সমপর্যায়ে। কিন্তু বাল্যবিয়ের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে বাল্যবিয়ের আইনের বিশেষ ধারার কারণে। রাজনীতিতে অর্থাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অধিক হারে অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা যখন স্বীকৃতি পাচ্ছে তখন ২৫ বছরের জন্য সংরক্ষিত নারী আসন বহাল রাখা ও পরোক্ষ ভোটে মনোনীত হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে। RPO-তে ৩৩ শতাংশ নারীর যুক্ততা বাতিল করে রাজনৈতিক দলের ওপর তা ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও নির্মূলের জন্য নারীর প্রতি সংবেদনশীল বিভিন্ন আইন প্রণীত হচ্ছে; কিন্তু আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না। নারীসমাজ এই আইনের ইতিবাচক সুফল ভোগ করতে পারছে না। ধর্ষণের মতো নির্মম নির্যাতনের মাত্র ৪ শতাংশ ঘটনার বিচার হচ্ছে। ব্যক্তিজীবনের অধিকারের ক্ষেত্রে নারী এখনো বৈষম্যের শিকার।
বর্তমানের এই কভিড-১৯-এর সংক্রমণে নারীর অবস্থা আরো নাজুক হয়ে পড়ছে। আমাদের নারীদের একটি বড় অংশ অর্থনীতির অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে কাজ করে। তা ছাড়া রয়েছে পোশাকশিল্পের শ্রমিক, অভিবাসী নারী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, যাদের অনেকেই এখন কর্মহীন হয়ে পড়বে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীলতা নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে, যার প্রকাশ সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ করা যাচ্ছে, পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মনে হয়, এই সময় সুফিয়া কামাল থাকলে কী করতেন? যেকোনো সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংকটে তাঁর আহ্বান ছিল, সমাজকে জাগ্রত হতে হবে। তিনি বলতেন, আমার দর্শন আমার বিবেক। তাঁর মানবতাবাদী সাহসী বিবেকবান ভূমিকা সমাজকে পথ দেখাত, আজও দেখাবে। তাই তিনি সমাজের বাতিঘর—জননী সাহসিকা।
লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ