২৫ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ আফ্রিকান-আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েডকে মিনেসোটায় বর্বরোচিতভাবে হত্যা করেছে। এর পর থেকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে আছে গোটা দেশ। এ পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘উপায়ান্তর না দেখে’ সঙ্কট নিয়ন্ত্রণে সামরিক পুলিশ মোতায়েন করেছেন। বর্তমান পুলিশ বাহিনীর অর্থ বরাদ্দ কমানোর দাবিতেও এই বিক্ষোভ। অপর দিকে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই বরাদ্দ হ্রাসের বিপক্ষে।
৮ জুন একটি প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে, যার নেতৃত্বে ছিলেন রিপাবলিকান দলের সিনেটর মিট রমনি। এতে অংশ নিয়ে এক হাজার ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান মার্কিন প্রেসিডেন্টের দফতর ও আবাস হোয়াইট হাউজের দিকে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এটা ছিল রিপাবলিকান পার্টির পলিসির পরিপন্থী। এ দিকে, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পাঁচতারকা জেনারেল, কলিন পাওয়েল প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করে বলেছেন, তিনি সংবিধানের পথ থেকে ‘সরে গেছেন’। কারণ, তিনি এ বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে অনুমোদন দিয়েছেন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে। নিম্নপরিষদ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির নেতৃত্ব ডেমোক্র্যাটিক পার্টির এমপিরা গলাটিপে গ্রেফতার করাকে (ঈযড়শবযড়ষফ) নিষিদ্ধ করা ছাড়াও দেশের ফৌজদারি আইনে আমূল পরিবর্তন আনার প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন।
জো বাইডেন হলেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট পদে আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থী। তিনি গত ৮ জুন মিনেসোটা গিয়েছিলেন জর্জ ফ্লয়েডের পরিবার পরিজনকে সমবেদনা জানানোর উদ্দেশ্যে। ফ্লয়েডের নিজ শহর হাউসটনে (টেক্সাস) পরদিন তার ‘ফাইনাল মেমোরিয়াল’-এর আয়োজন করেছিল হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে ডেমোক্র্যাটদের কৃষ্ণাঙ্গ ‘ককাস’। অনুষ্ঠানে বাইডেনের রেকর্ডকৃত বার্তা প্রচারিত হয়েছে যাতে তিনি জর্জ ফ্লয়েডের প্রতি ‘চূড়ান্ত বিদায়’ জ্ঞাপন করেছেন। মোট কথা, ফ্লয়েড এখন যুক্তরাষ্ট্রে বৈষম্য ও নির্যাতনের প্রতীক।
জনগণ বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে আমেরিকার পুলিশি কার্যক্রমে পরিবর্তন আনা অথবা পুলিশের জন্য বরাদ্দ হ্রাসের দাবিতে। নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র বিল ডি ব্লাসিও অঙ্গীকার করেছেন, দেশের বৃহত্তম এই পুলিশ নেটওয়ার্কের বাজেট কমানো হবে এবং এ অর্থ বিনিয়োগ করা হবে যুবসামাজের জন্য ও সমাজকল্যাণমূলক তৎপরতায়। অপর দিকে, যুক্তরাষ্ট্রের আন্দোলনকারী ও আইনজীবীরা চাপ দিচ্ছেন আইনগত সংস্কারের জন্য।
এ দিকে ১২ জুন নিউ ইয়র্কের গভর্নর একগুচ্ছ আইনে সই করেছেন। সে মোতাবেক পুলিশ অফিসারদের জবাবদিহি করতে হবে আগের চেয়ে অধিক। এসব আইনে গলা চেপে ধরে গ্রেফতার করাসহ বিতর্কিত নানা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা হয়েছে। নিউ ইয়র্কের গভর্নর একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন। সে অনুসারে পুলিশের শক্তি প্রয়োগসহ বিভিন্ন কলাকৌশলের আধুনিকীকরণ এবং পুনর্বিনিয়োগের ব্যাপারে কমিউনিটির সাথে পরামর্শক্রমে আইন প্রণীত হবে। নিউ ইয়র্ক পুলিশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয়ের বিষয় এর আওতায় আসবে। অবশ্য এ সব আইনের তীব্র বিরোধিতা করেছে ল’ এনফোর্সমেন্ট ইউনিয়ন নামের জোট। তবে হাজার হাজার মানুষ জর্জ ফ্লয়েডের জন্য শোক জ্ঞাপন করছে।
মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নপরিষদের স্পিকার ও বহুলালোচিত ব্যক্তিত্ব ন্যান্সি পেলোসি পুলিশের কাঠামোগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে প্রস্তাব এনেছেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমাদের পুলিশ বাহিনীর শতকরা ৯৯ জনই মহান ব্যক্তি।’ তিনি বিতর্কিত কথাটা বলেছেন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব চিফস অব পুলিশের সভাপতি স্টিভেন্স আর ক্যাস্টেভেন্স এবং ফেডারেশন অর্ডার অব পুলিশের জাতীয় প্রধান প্যাট্রিক ইয়োএসকে। ডেমোক্র্যাটিক পার্টি পুলিশের সংস্কারের জন্য অনেকগুলো প্রস্তাব আনার পর ট্রাম্প এ কথা বললেন। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৫টি বড় শহরে পুলিশ অফিসারদের অধিকাংশই আজও শ্বেতাঙ্গ।
পুলিশের নির্মমতার প্রতিবাদে বিক্ষোভ চলছেই। মনে হয়, এর কোনো বিরাম নেই । প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, পরিকল্পিত বর্ণবাদ এবং কৃষ্ণাঙ্গ, অর্থাৎ শ্বেতভিন্ন অন্যান্য বর্ণের মানুষের ওপর অত্যাচারের মাঝে মার্কিন পুলিশের নিষ্ঠুরতার উৎস নিহিত।
যুক্তরাষ্ট্রে যখন পুলিশের নির্যাতনের প্রতিবাদ চলছে ব্যাপক বিক্ষোভ, তখন যুক্তরাষ্ট্রের ২৬টি অঙ্গরাজ্যে করোনা মহামারীতে মৃতের সংখ্যা এক লাখের অনেক উপরে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের পরিচালক ডা: অ্যান্থনি ফউচি বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারীর দুঃস্বপ্ন শেষ হয়নি।’
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক। আমেরিকার নোভা টোস্টমাস্টার ইন্টারন্যাশনালের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় বসবাসরত