রবিবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৪০ অপরাহ্ন

কেন বিসিএসই সবার লক্ষ্য

জোবাইদা নাসরীন
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ১৪ জুলাই, ২০২০
  • ৩১৭ বার

কয়েক দিন আগে প্রকাশিত হয়েছে ৩৮তম বিসিএসের ফল। তাতে চাকরির জন্য সুপারিশ পেয়েছেন ২ হাজার ২০৪ জন। এর পর থেকেই বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছে বিসিএস উত্তীর্ণ প্রার্থীদের সাফল্যের নানা দিক। যার কারণে মনে হতে পারে, এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কিংবা ভবিষ্যতে একজন আমলা হওয়াই আজকের তরুণ-তরুণীদের জীবনের লক্ষ্য। আবার এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই একই সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক চলছে নির্দিষ্ট কিছু পেশার প্রতি শিক্ষার্থীদের অতিমাত্রায় ঝোঁক তৈরি হওয়ার পেছনের রাজনীতি নিয়ে।

তবে এই বিষয়ে অনেকের সঙ্গে আমিও একমত শিক্ষার্থীদের কাছে বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পেশার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের চাকরি। এই আকাঙ্ক্ষা শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাচ্ছে লাইব্রেরিতে মনোযোগ দিয়ে বিসিএস গাইড মুখস্থ করার দিকে। যার কারণে, বেশ কয়েক বছর ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় পাঠাগার বেশ পূর্ণ থাকে। শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরিতে বসে থাকে, দেখতে ভালোই লাগে। কিন্তু হাতে তাদের বিসিএস গাইড। শিক্ষার্থীদের মুখেই কোনো একদিন শুনেছিলাম, বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য লাইব্রেরিতে বসার জায়গা পেতে শিক্ষার্থীদের বেশ প্রতিযোগিতা করতে হয়। এ কথা বলতে এখন আর আমাদের কোনো লুকোচুরি নেই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই এখন পড়তে, শিখতে ও জানতে আসে না। তারা শুধু চায় সনদ, যা তাদের বিসিএস পরীক্ষার আবেদনে কাজে লাগবে। আর বাকি সময় তারা বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নেয়

এই চিত্র যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই তা নয়, আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি এটি এখন বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেরই চিত্র। চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ সবার লক্ষ্যই এখন আমলা হওয়ার দিকে। কেন এই পরিবর্তন?

অথচ বছর বিশেক আগ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিসিএস এতটা তাড়া করে ফিরত না। আশি এবং নব্বইয়ের দশকেও সরকারি চাকরিজীবী পরিবারগুলোতে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনই ছিল বাস্তব। তাত্ত্বিকভাবে নয়, বরং আমার মতো সরকারি চাকরিজীবী পরিবারে বড় হওয়া অনেকেরই এই অভিজ্ঞতা রয়েছে। আগে বরং সরকারি চাকরির প্রতি মানুষের এক ধরনের উন্নাসিকতা ছিল এবং এটিকে ‘অসৃজনশীল’ জায়গা হিসেবে দেখা হতো, যেখানে নিজস্ব মতপ্রকাশের সুযোগ একেবারেই কম। আগে সরকারি চাকরির প্রতি যাদের আগ্রহের মূলে থাকত অবসরজীবনে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো না হলেও হয়তো মাসের ২০ তারিখ থেকেই বাকি ১০ দিনের উদ্বেগ পোহাতে হতো। অনেকেই হায়-হুঁতাশ করে তখন প্রাইভেট চাকরিতে চলে যাওয়ার আগ্রহ দেখাতেন।

গত দুই দশকে বিসিএস অন্য ধরনের ‘সুবাস’ নিয়ে আসছে, আর তাতেই শিক্ষার্থীরা আকৃষ্ট হচ্ছে। দুই বছর আগে বিসিএসসহ সরকার চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন শিক্ষার্থীদের অতিমাত্রার বিসিএসমুখিতাকেও সবার কাছে স্পষ্ট করে।

এখন প্রশ্ন হলো, কেন এই মনোজাগতিক পরিবর্তন? সরকারি চাকরিজীবীদের অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের দিন অনেকটাই হয়তো ঘুচেছে। এটিই তাহলে কারণ? কিন্তু গবেষণা বলে অন্য কথা। যে ছোট গবেষণাটি এই বিষয়ে আমি ব্যক্তিগত আগ্রহে করেছিলাম সেখানে ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্ষমতাচর্চার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছে। প্রশ্ন ছিল, এই ক্ষমতা ব্যবহার করে কী করবে? এই প্রশ্নের উত্তরগুলো অনেক বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ। সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে সামাজিক মর্যাদা, ‘ডাকসাইটে আমলা’ তকমা পাওয়ার ঝোঁক, গাড়ি-বাড়ি পাওয়ার নিশ্চয়তা এবং নিরাপদ জীবনের তাগাদা। খুব কমই জায়গা পেয়েছে জনগণের সেবা করার মনস্কতা, অথচ যেখানে জনগণের সেবক হওয়াটাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

এবার দ্বিতীয় প্রসঙ্গে আসি। রাষ্ট্র কীভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই এই বিসিএসমুখিতা তৈরি হওয়ার বেলায় অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, সে আলোচনাও দরকারি। প্রাথমিক পর্যায়ে সমাপনী পরীক্ষা থেকে শুরু করে ক্রমাগত বাড়তি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিষ্ঠানমুখী শিক্ষা এবং ‘জিপিএ-ফাইভে’র তকমার মধ্য দিয়ে সামাজিক মর্যাদার লোভ তৈরি হয়। এ কারণে এই সামাজিক মর্যাদা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাকে ছোট বয়সেই নিয়ে যায় কোচিং সেন্টার এবং গাইড বইয়ের দিকে। এই গাইড বই এবং কোচিং অব্যাহত থাকছে বিসিএস পরীক্ষা পর্যন্ত।

কেন মেডিকেল, কৃষি কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে যেতে চায়? প্রশ্নটি জরুরি, কারণ বিশেষায়িত শাখায় পড়ালেখার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য প্রশাসন ক্যাডারের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন। মানি যে পেশার সঙ্গে পড়াশোনার বিষয়ের মিল সব সময় হয় না এবং না-হওয়াটা আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনিচ্ছাপ্রসূত।

তবে যে বিষয়টি আমার গবেষণার উত্তরদাতারা বলেছেন তা হলো, বিসিএসের চাকরিতে টাকাপয়সা, ক্ষমতা, মর্যাদা সবই আছে। আর যেটা বলেননি কিন্তু বিভিন্নভাবে বুঝিয়েছেন, এই সরকারি চাকরিতে দুর্নীতি করলে বড়জোর বদলি করা হয়, ওএসডি করা হয়, কিন্তু চাকরি যায় না। বরং এখন আইন আরও শক্ত। সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করতে হলে অনুমতি লাগবে। তাঁদের বিরুদ্ধে কথা বললে মামলা হওয়ার ভয় থাকে। প্রশাসনের কর্তারা জানেন, দুর্নীতি করে পার হওয়া যায়। হয়তো সবাই দুর্নীতি করেন না, কিন্তু ক্ষমতাচর্চা অনেকেই করেন।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, সরকারের অতিরিক্ত আমলানির্ভরতা প্রশাসনিক ক্যাডারকে আরও ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে গেছে। এটিও হয়তো সবাইকে প্রশাসনিক ক্যাডারের প্রতি আগ্রহী করার প্রভাবক।

গণমাধ্যমকেও বিসিএস পরীক্ষার অর্জনকে অন্য আট-দশটি চাকরি পাওয়ার মতোই দেখা প্রয়োজন। তা না হলে শিক্ষার্থীদের মনে হতে থাকবে এখানে সফলতা না পেলে জীবন ব্যর্থ হবে। আর এর প্রতি অতিরিক্ত ঝোঁকের কারণেই আমরাও এখন আর জনগণের সেবক পাই না, বিশেষায়িত জ্ঞানের অধিকারী পাচ্ছি না, পাই কেবল ক্ষমতার সেবকদের। তাই পাবলিক সার্ভেন্টের অর্থ পাল্টে গেছে। এখন তাঁদের বেশির ভাগই জনগণকে সেবা দেন না, আগ্রহ অন্য জায়গায়। এভাবে চলতে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন কেবল আমলা তৈরির কারখানাতেই পরিণত হবে।

তা হলে এ দেশে আর বিজ্ঞানী, গবেষক, চিকিৎসক তৈরির মনস্কতা থাকবে না? মানুষের জন্যই যদি হয় সেবা, তবে কেন সেই সেবায় মানুষ নেই? আছে দুর্নীতি, ক্ষমতা, অর্থ আর এসবকে ঘিরে তৈরি হওয়া সামাজিক মর্যাদা অর্জনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা!

* জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com