গেল সপ্তাহে গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুটি খবর ছিল বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো। প্রথমটি হলো, এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের সুপারিশ অনুমোদন করেছে জাতিসংঘ। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিবেচনায় এটি ৫০ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটি মর্যাদাকর সিদ্ধান্ত এবং দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির একটি স্বীকৃতি। জাতিসংঘের এই অনুমোদন বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে সন্দেহ নেই; কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে বাড়াবে চ্যালেঞ্জও। চ্যালেঞ্জগুলো মেকাবিলা করতে না পারলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। দ্বিতীয় খবরটি নিরাশার, যা কিনা প্রথমটির সঙ্গে সম্পর্কিত। সংবাদসূত্র বলছে, ২০৩০ সালে দেশে গ্যাস সরবরাহের ঘাটতি দাঁড়াবে দৈনিক ৫৫৮ ঘনফুট। এটি শঙ্কার খবর। সরকার ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে রূপান্তরের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সে ক্ষেত্রে এটি একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এখানে স্বল্প পরিসরে গেল সপ্তাহের এ খবর দুটি নিয়ে কিছুটা আলোচনা করতে চাই।
মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা-এ তিনটি সূচক বিবেচনা করে একটি দেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীলে উন্নীত করা হয়। বাংলাদেশ এই তিনটি সূচকেই উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার মান অর্জন করেছে, তাই এ স্বীকৃতি। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার কথা ছিল ২০২৪ সালে। কিন্তু এ জন্য যে প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন, তা সম্পন্ন করতে বাংলাদেশ আরও সময় চেয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৬ সাল থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশ হওয়া কার্যকর হবে। নির্দিষ্ট প্রস্তুতি সম্পন্ন করার জন্য দেশের হাতে সময় আছে আরও ৫ বছর। ৫ বছরের মধ্যে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সব প্রস্তুতি শেষ করতে হবে। তা না হলে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ এই উত্তরণ পিছিয়ে দিতে পারে। এর আগে ২০০৯ সালে মালদ্বীপকে এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু সুনামির কারণে তা ৯ বছর পিছিয়ে যায়। আবার ২০১৮ সালে নেপালকেও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ উত্তরণের অনুমোদন দেয়। কিন্তু বিধ্বংসী ভূমিকম্পের কারণে তা ৩ বছর পিছিয়ে এবার সুপারিশ করা হয়েছে। তাই উল্লিখিত সূচক তিনটির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা খুব জরুরি।
এলডিসি থেকে উত্তরণে আমাদের প্রথম চ্যালেঞ্জটি আসবে রপ্তানি খাতে। রপ্তানিতে করের ক্ষেত্রে জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অফ প্রেফারেন্স) সুবিধার কথা আমরা জানি। কোনো দেশে রপ্তানি পণ্য প্রবেশের ক্ষেত্রে নির্ধারিত হারে করারোপ করা হয়। এই করের হার উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের বেলায় অনেক বেশি। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় এতদিন আমরা জিএসপি সুবিধা পেয়ে এসেছি। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে এখন তা আর থাকবে না। যদিও ইউরোপের বাজারে ২০২৬ সাল পর্যন্ত জিএসপি সুবিধা পাওয়া যাবে, কিন্তু তারপর আর নয়। সে ক্ষেত্রে গবেষকরা ধারণা করছেন, এলডিসি সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে বছরে ৫৩৭ কোটি ডলার বা আজকের বাজার মূল্যে প্রায় ৪৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার রপ্তানি কমে যেতে পারে। কেবল পোশাক খাতেই কমতে পারে ৫০০ কোটি ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ৪২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যদি রপ্তানি পণ্যের ওপর করহার বাড়ে, তাহলে পণ্যটির দাম বেড়ে যাবে। সেই বাড়তি দামে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে হলে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে। অতিরিক্ত দামের মোকাবিলা করার একটি পথ হলো উৎপাদন খরচ কমানো। সেটা করতে হলে চাই দক্ষতা বৃদ্ধি; আর দক্ষতা বা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য চাই শিক্ষা ও প্রযুক্তি। এ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার আরেকটি উপায় হলো, যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য সম্পর্ক আছে, সেসব দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি করা। এর সঙ্গে বন্দর ব্যবস্থাপনাসহ সব ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধা ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তাছাড়া রপ্তানিকারকদের নতুন নতুন বাজারের সন্ধান করতে হবে। তবে অর্থনীতিবিদরা বাণিজ্য সুবিধা দূরীভূত হওয়াকে হতাশাব্যঞ্জক মনে করছেন না। তারা মনে করেন, বাংলাদেশের হাতে এখনো ৫ বছর সময় আছে। এ সময়ের মধ্যে উপায় বের করা সম্ভব।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি হলো অনুদান ও বৈদেশিক ঋণ। বৈদেশিক অনুদান কমে যাবে। আমাদের দেশের এনজিওগুলো দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে কাজ করে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বৈদেশিক অনুদানের ওপর নির্ভরশীল। সে ক্ষেত্রে এনজিওগুলো একটি বড় ধাক্কা খেতে পারে। তাতে করে দারিদ্র্য বিমোচনের কাজ ব্যাহত হবে। অন্যদিকে আমাদের সরকারের সেরকম সক্ষমতা নেই যে এনজিওগুলোকে আর্থিক সহায়তা করতে পারবে। এর বিপরীতে দারিদ্র্য বিমোচনে কতটা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যাবে, তা ভাবার বিষয়। তবে আমাদের বার্ষিক বাজেটে বৈদেশিক অনুদানের পরিমাণ ২ শতাংশের বেশি নয়। তাই তা বন্ধ হয়ে গেলেও সামাল দেওয়া কঠিন হবে না। এর জন্য প্রয়োজন হবে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ানো। রেমিট্যান্স বাড়াতে হলে অধিকসংখ্যক দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির উদ্যোগ নিতে হবে। এই দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দরকার হবে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরকারকে বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে।
উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশের সুবিধা হলো, এ ক্ষেত্রে কম সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া যায়। কিন্তু অসুবিধা হলো, সবাই ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আস্থা রাখতে পারে না। আর উন্নয়নশীল দেশের সুবিধা হলো, সবাই ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আস্থা রাখতে পারে, তবে অসুবিধা হলো, এ ক্ষেত্রে সুদের হার বেশি। আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, আমরা কম সুদে ঋণ পেলেও তার অপচয় হয়েছে। দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে আমরা স্বল্প সুদের সুফল ভোগ করতে পারিনি। যদি এই নেতিবাচক দিকগুলো বন্ধ করা যায়, তাহলে একটু বেশি সুদে ঋণ নিলেও তা বড় ধরনের কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না। এর জন্য চাই সরকারের সদিচ্ছা ও ঋণের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা। বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মিশ্র প্রভাব পড়তে পারে। এ কথা ঠিক, কোনো দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি স্বীকৃতি পেলে সে দেশের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ে। ফলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আকৃষ্ট হয়। বিপরীতভাবে, রপ্তানিপণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয় মূলত জিএসপি সুবিধা ভোগ করার মানসে। সেই সুবিধা থাকবে না বলে আগ্রহ কমেও যেতে পারে। তবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে এর মাত্রা কমতে পারে।
একটি বড় ধাক্কা আসতে পারে আমাদের ওষুধ শিল্পে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আশির দশক থেকে আমাদের ওষুধ শিল্পের বিকাশ শুরু হলেও আজ তা একটি উল্লেখযোগ্য অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের ওষুধের গুণগত মান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আমাদের বর্তমানে মোট ওষুধের চাহিদার ৯৭ শতাংশই মেটানো হয় দেশে প্রস্তুত ওষুধ দিয়ে। কিন্তু এই ওষুধগুলোর মেধাস্বত্ব বা রয়্যালটি বিদেশিদের হাতে। স্বল্পোন্নত দেশ থাকাকালে ওষুধগুলোর মেধাস্বত্ব ফি দিতে হতো না। উন্নয়শীল দেশের মর্যাদা পেলে তা দিতে হবে। ফলে এ শিল্পকে একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হবে। তবে এর জন্য তারা ২০৩০ সাল নাগাদ সময় পাবে। এর মধ্যে সব প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
এলডিসি থেকে উত্তরণের এই আশাব্যঞ্জক খবরটির পাশাপাশি একটি নিরাশার খবর হলো, আমাদের জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত গ্যাসের সংকট দিনকে দিন তীব্রতর হচ্ছে। একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতিকে সচল রাখতে উৎপাদন ব্যবস্থা সচল রাখার বিকল্প নেই। আমাদের মোট ব্যবহার্য জ্বালানির প্রায় ৫০ শতাংশই হলো প্রাকৃতিক গ্যাস। এই জ্বালানির সরবরাহে সংকট সৃষ্টি হলে শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হবে, যা প্রকারান্তরে দেশের সার্বিক অর্থনীতিকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেবে। এমন আশঙ্কা করছে খোদ খাতটির নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সংস্থাটির মতে, ২০৩০ সাল নাগাদ গ্যাসের মজুদ সর্বনিু পর্যায়ে নেমে আসবে। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ছিল ৪৩০ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে অভ্যন্তরীণভাবে এবং আমদানি করা এলএনজির সমন্বয়ে সরবরাহ ছিল ৩০১ কোটি ঘনফুট। যদি আমদানি করা এলএনজিকে এই হিসাবে না আনি, তবে দেশীয়ভাবে ঘাটতির পরিমাণ ১৮৮ কোটি ঘনফুট। আর আমদানিকে আমলে নিলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৩০ কোটি ঘনফুট। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ২০২৫ সাল নাগাদ এই ঘাটতি দৈনিক ৩৯০ ঘনফুট হবে এবং এভাবে ঘাটতি চলতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৫৫৮ কোটি ঘনফুটে।
জ্বালানি বিভাগের তথ্যমতে, আমাদের এ পর্যন্ত মোট গ্যাস মজুদের পরিমাণ ২৮ দশমিক ৩০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট (টিসিএফ)। এর মধ্যে আমরা উত্তোলন করেছি ১৮ দশমিক ৭০ টিসিএফ গ্যাস। তাহলে মজুত রয়েছে মাত্র ৯ দশমিক ৬০ টিসিএফ গ্যাস। গত অর্থবছরে উত্তোলন করা হয়েছে প্রায় ১ টিসিএফ গ্যাস। তাছাড়া আমাদের রয়েছে দুটি এফএসআরইউ (ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট)। এ ইউনিট দ্বারা জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়ে থাকে। গ্যাসের এ সংকট নিরসনে সরকার এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি করছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, জ্বালানির ওপর অতিমাত্রায় আমদানিনির্ভরতা অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি বয়ে আনবে। তাদের মতে, আমদানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণভাবে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ গতিশীল করতে হবে। সরকার আমদানিতে যতটা উৎসাহী, গ্যাস অনুসন্ধানের কাজে ততটা নয়। দেশে বর্তমানে তিনটি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি এবং উৎপাদন-বণ্টন চুক্তির আওতায় দুটি বিদেশি কোম্পানি গ্যাস উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত আছে। আমরা মনে করি, একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে উৎপাদন ব্যবস্থাকে নিশ্চিত করতে বাংলাদেশে স্থল ও সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন। পরিশেষে, এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য মাতৃভূমিকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়