রবিবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৩৬ অপরাহ্ন

এটি রোগ নয়, ভয়ানক মহামারি

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২০
  • ৩৬১ বার

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

বাংলাদেশে নারী ধর্ষণের সংখ্যা বেড়েছে। একটু বেশি বেড়েছে। ধর্ষকদের চরম শাস্তি দেওয়ার জন্য ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ, মানববন্ধন ইত্যাদি চলছে। পুলিশ যে ধর্ষকদের ধরার জন্য কম তৎপর তা-ও নয়। বিচারকরাও তাঁদের আদালতে ধর্ষণের বিচারে আগের চেয়ে অনেক কঠোর মনোভাব দেখান। সরকার কি ধর্ষণের মতো অপরাধ দমনে উদাসীন? তা-ও নয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফেনীর নুসরাত হত্যাকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করেছেন। মাদরাসার ধর্ষক প্রিন্সিপালসহ তাঁর সহযোগীদের বিচারে ফাঁসির আদেশ হয়েছে।

তবু ধর্ষণের সংখ্যা দেশে বাড়ছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে রাস্তায় অসতর্কভাবে পেয়ে এক মাদকাসক্ত সিরিয়াল রেপিস্ট ধর্ষণ করেছে। এই সাহসী ছাত্রী ধর্ষিতা হওয়ার পরও থানায় রিপোর্ট করেছেন। ধর্ষক ধরা পড়েছে। এ ঘটনায় সারা দেশ উত্তাল। তাতে কী? অপরাধীরা তাতে দমিত হয়নি। এই কাণ্ডের পরপরই ঢাকার ধামরাই উপজেলায় বাসে মমতা আখতার নামে এক ১৯ বছরের তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে রাস্তায় তাঁর লাশ ফেলে রাখা হয়। ধর্ষক বাসচালককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

একই সঙ্গে খবর পাওয়া গেছে স্কুলছাত্রীসহ পাঁচজনের ধর্ষিতা হওয়ার। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, রাজবাড়ী, বরিশালের তিন ছাত্রী, সুনামগঞ্জে এক কিশোরী এবং গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় এক গৃহবধূ এই ধর্ষণের শিকার। রূপগঞ্জের ঘটনাটি মর্মান্তিক। এক স্কুলছাত্রীকে হরণ করে দুটি বাড়িতে আটকে রেখে ১৫ জন দুর্বৃত্ত তাকে ধর্ষণ করে। তাকে রাস্তায় ফেলে যায় ধর্ষকরা।

আমি লন্ডনে বসে কলকাতা ও দিল্লির কয়েকটি সংবাদপত্র হাতে পাই। সারা ভারতসহ পশ্চিমবঙ্গে ধর্ষণ যে হারে বেড়েছে, তাতে বিস্মিত হতে হয়। দিল্লির নৈশবাসে এক শিক্ষার্থী তরুণী নার্সকে গণধর্ষণের পর হত্যায় নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সারা ভারত বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছিল। ভারত সরকার বাধ্য হয়েছিল ধর্ষণের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড প্রবর্তনে। তাতে অপরাধ দমিত হয়নি; বরং বেড়েছে মনে হয়। দিল্লিতে নির্ভয়া হত্যাকাণ্ডে বছরের পর বছর অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি অক্ষয় ঠাকুর পাল্টা মামলা-মোকদ্দমা করেও বাঁচতে পারেননি। সুপ্রিম কোর্ট তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন।

আইন এত কঠোর করা, ধর্ষকদের ফাঁসি দেওয়া—এত কিছুর পরও ভারতের ধর্ষণের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এত উন্নত পশ্চিমা দেশগুলোতেও ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, শিশুর ওপর যৌন নির্যাতন বেড়েছে ব্যাপক হারে। শিশু নির্যাতনের ব্যাপারে বহু বিখ্যাত লোক অভিযুক্ত হচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে এমপি, আদালতের বিচারপতিরা রয়েছেন। সম্প্রতি এক সিরিয়াল রেপিস্টকে ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে দুই শর বেশি পুরুষের ওপর যৌন নির্যাতন করেছে। তাকে বলা হয়েছে ব্রিটেনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট রেপিস্ট।

ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমনকি অক্সফোর্ড, কেমব্রিজেও ছাত্রীদের ওপর যৌন হয়রানি, যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। এটাকে বলা হয় ‘ডেট রেপ’। যার অর্থ ডেটিং করার নামে সহপাঠিনীকে ভুলিয়ে এনে, তার পানীয়তে মাদকদ্রব্য মিশিয়ে, তাকে অর্ধচেতন করে ধর্ষণ করা। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তো হরহামেশা এই ‘ডেট রেপিংয়ের’ অভিযোগ উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহুদিন এই ডেট রেপিংয়ের ব্যাপারে উদাসীন ছিল। এখন ছাত্রীদের সংঘবদ্ধ আন্দোলনের ফলে এবং ডেট রেপিংয়ের সংখ্যা বাড়ায় তারা কড়া হতে বাধ্য হয়েছেন।

এমন অভিযোগও শোনা যায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এক শ্রেণির শিক্ষকের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হন অনেক ছাত্রী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের ফার্স্ট ক্লাস দেওয়া হবে না, অথবা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হবে—এই ভয় অথবা কোনো প্রলোভন দেখিয়ে শিক্ষক মহোদয় তাঁর যৌন কামনা পূরণ করেন। শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী নিপীড়নের এক ঘটনায় ঢাকার ভিকারুননিসা নূন কলেজে কিছুদিন আগে তো রীতিমতো ঝড় উঠেছিল। এমন যে রবীন্দ্রনাথের তপোবনের মতো শান্তিনিকেতন (যা এখন তপোবন নেই) বিশ্ববিদ্যালয়, তাতে ছাত্রী নিগ্রহ ও নির্যাতন কর্তৃপক্ষকে ভাবিয়ে তুলেছে। পৌষ মেলা বা মাঘী মেলা হলেই কিছু ছাত্রী দুর্বৃত্তদের হাতে ধর্ষিতা হয়। এটা দেখে এবার পৌষ মেলা সেনা প্রহরায় করতে হয়েছে।

ধর্ষণ কোনো রোগ নয়, রোগের বহিঃপ্রকাশ। সমাজ যখন অবক্ষয়ের তলানিতে পৌঁছায়, তখন সমাজদেহে তার ঘায়ের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তার মধ্যে ধর্ষণ একটি। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে সামাজিক অবক্ষয় কোথায় পৌঁছেছে, এটা তার লক্ষণ। পাকিস্তানে শ্বশুর পুত্রবধূকে ধর্ষণ করেছে, সে জন্য শ্বশুরের কোনো শাস্তি হয়নি। শাস্তি হয়েছে পুত্রবধূর। গ্রামের মোল্লার ফতোয়ায় পুত্রবধূকে ১০০ ঘা বেত মেরে হত্যা করা হয়েছে।

অনেকে বলেন, সামাজিক ব্যবস্থার এই অবক্ষয় দূর করার জন্য রাজনীতিকদের তৎপর হওয়া উচিত। এর জবাব হচ্ছে, যে শর্ষের দ্বারা ভূত তাড়ানো হবে, সেই শর্ষের মধ্যে ভূত ঢুকলে তা তাড়াবে কে? বিশ্বের বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের—আমাদের জেনারেল এরশাদ থেকে ক্লিনটন, ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত যে যৌন কেলেঙ্কারি, তাতে রাজনীতিকদের ওপরেই বা ভরসা করবেন কারা? ভারতে একজন প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত যৌন কেলেঙ্কারির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। অবশ্য তিনি অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়েছেন।

বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া তাঁর ‘মৃদুভাষণ’ কলামে কয়েক বছর আগে লিখেছিলেন, ‘আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটছে; শিক্ষা, স্বাস্থ্য সর্বক্ষেত্রেই দ্রুত উন্নতি ঘটছে। কিন্তু যেভাবে সামাজিক অবক্ষয় শুরু হয়েছে, তাতে অর্থনৈতিক উন্নতি দ্বারা কী লাভ হবে, তা-ই ভেবে শঙ্কিত হচ্ছি। সামাজিক পচন অন্য সব উন্নতিকে গ্রাস করে ফেলবে।’

শাহ এএমএস কিবরিয়ার এই সতর্কবাণীটি আজকের জন্যও প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীটিকে যে ধর্ষণ করেছে, শুধু তাকে নিন্দা করে লাভ নেই। নিন্দা অবশ্যই করতে হবে, তা এই ধর্ষকদের যারা তৈরি করেছে সেই সমাজ ও সমাজকর্তাদের। রাজনৈতিক নেতাদের, সমাজ নির্মাণের দায়িত্ব যাঁরা পালন করেননি, বরং নিজেদেরও ব্যক্তিগত চরিত্রের স্খলন দ্বারা সমাজের চরিত্রেও স্খলন ঘটিয়েছেন, তাঁদের আজ চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন। বিচার হওয়া প্রয়োজন।

কিন্তু এই বিচার করবে কারা? সলিল চৌধুরী গান লিখেছিলেন—‘বিচারপতি, তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা।’ কিন্তু আজ সেই জনতা কোথায়? জনতাকে জাগাবেন যে সমাজপতি, রাজনৈতিক নেতারা, তাঁরাই তো আজ চরিত্র ভ্রষ্ট। ব্রিটেনের মন্ত্রিসভা থেকে একাধিক মন্ত্রীকে নারী কেলেঙ্কারির জন্য মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করতে হয়েছে। তা শুনে ফ্রান্সের এক প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ‘এই কেলেঙ্কারির জন্য মন্ত্রিসভা থেকে যদি মন্ত্রি তাড়াতে হয়, তাহলে আমার মন্ত্রিসভায় একজন মন্ত্রীও থাকবেন না।’

তাই আমার কথা, শুধু কঠোর আইন করে, ধর্ষকদের ফাঁসি দিয়েও এই অপরাধ দমানো যাবে না। ধর্ষণ সামাজিক অবক্ষয়ের ঘৃণ্য বহিঃপ্রকাশ। এর সংক্রমণ কুষ্ঠরোগের চেয়েও দ্রুত। এর পচন থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হলে সমাজের দূষণমুক্তি দরকার। সমাজে প্রতিরোধ চেতনা তৈরি এবং ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। নারীকে সম্মান জানাতে হবে। তাঁর ব্যক্তি অধিকারের সীমানা লঙ্ঘন করা চলবে না। এসব কথা শুধু কেতাবেই লেখা থাকলে চলবে না। এই নৈতিক শক্তির পুনর্জাগরণ ঘটাতে হবে। ছাত্র ও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হারানো নৈতিক শক্তি ফিরিয়ে আনতে হবে।

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বহু ক্ষেত্রে বহু সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু সমাজে নৈতিক মুক্তি ফিরিয়ে আনতে পারেনি। তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও যে বিরাট সামাজিক অবক্ষয়ের সূচনা হয়েছে তা বন্ধ করতে পারেনি। এটা যদি তারা না পারে, তাহলে দেশের যতই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটান, বঙ্গবন্ধুর নামে জয়ধ্বনি দেন, দেশে সামাজিক বিপর্যয় রোধ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যাবে না। আমাদের যুব প্রজন্মের মধ্যে নৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শহীদ শেখ ফজলুল হক মনি যুবলীগ গঠন করেছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে শুদ্ধি অভিযানে ধরা পড়েছে, এই যুবলীগের অবস্থান আজ কোথায়? যুবসমাজের মধ্যেই ধর্ষণের প্রবণতা বাড়ছে।

আমাদের সমাজতাত্ত্বিক ও সমাজবিজ্ঞানীদের সতর্ক হওয়া উচিত, কিভাবে এই অবক্ষয়ের প্রতিরোধ করা যায়। আমরা কোনো রোগ মহামারি আকারে দেখা দিলে তার প্রতিকারে দ্রুত সচেষ্ট হই। ধর্ষণ মহামারির চেয়েও ভয়ানক সামাজিক ব্যাধির প্রকাশ। এর প্রতিকারের জন্য আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি—উভয়েরই আজ সতর্ক ও সচেষ্ট হওয়া জরুরি দরকার।

 

লন্ডন, সোমবার, ১২ জানুয়ারি ২০২০

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com