রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:০২ পূর্বাহ্ন

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিকাশধারা

এ বি এম ফজলুল করীম
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ৮ আগস্ট, ২০২২
  • ১১৯ বার

(শেষ পর্ব)
স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পর শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন করে নতুন আঙ্গিকে তৈরি করতে সাতটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় ১৯৭২ সালে ২৬ জুলাই বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. কুদরাত-ই-খুদাকে প্রধান করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের তৎকালীন সীমিত সম্পদ, রাষ্ট্রীয় নীতি ও জন মানুষের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে কমিশন ১৯৭৪ সালে প্রতিবেদন বাস্তবায়নে পেশ করে। এ প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৭ সালে কাজী জাফর আহম্মেদ শিক্ষা কমিশন এবং ১৯৭৯ সালের অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষানীতি প্রণয়নে কাজ করে। ১৯৮২ সালে গঠিত মজিদ খান শিক্ষা কমিশন ১৯৮৩ সালে প্রতিবেদন পেশ করে। কিন্তু এই প্রতিবেদনের কোনো সুপারিশ জনগণের প্রতিবাদে বাস্তবায়ন হতে পারেনি। দুটোর কোনোটি জনাকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে পারেনি, বরং বৈষম্য সৃষ্টির নানা উপাদান ছিল।

১৯৮৮ সালের মফিজ উদ্দিন আহমদ কমিশন প্রতিবেদনের সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি। দীর্ঘ দিন পর ১৯৯৭ সালে অধ্যাপক এম শামসুল হককে প্রধান করে যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি করা হয়, সেই কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৯৯৯ সালের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি (খসড়া) তৈরি করা হয়। ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো শিক্ষানীতি সংসদে গৃহীত হয়। ওই শিক্ষানীতিও বাস্তাবায়িত হয়নি।

অতঃপর ২০০২ সালে প্রফেসর ড. এম এ বারীর নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু সেই শিক্ষানীতিও বাস্তবায়ন হয়নি। অবোধগম্য কারণে পরবর্তী বছর অর্থাৎ ২০০৩ সালে অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞাকে প্রধান করে নতুন আরেকটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। এ কমিশনের সুপারিশগুলোও বাস্তবায়ন করা হয়নি। সর্বশেষ ২০০৯ সালে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে প্রধান করে জাতীয় শিক্ষা কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭৪ সালের শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন ও ২০০০ সালের শিক্ষানীতি ভিত্তি ধরে নতুন একটি শিক্ষানীতি তৈরির কথা এ কমিটিকে বলা হয়।

সরকারের চাওয়া অনুসারে কমিটি যে প্রতিবেদনটি পেশ করে, সেটি কিছুটা সংশোধিত হয়ে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে শিক্ষানীতি হিসেবে গৃহীত হয়। ২০১০ সালের এ জাতীয় শিক্ষানীতি বাংলাদেশের দ্বিতীয় ও বর্তমান শিক্ষানীতি, যা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে কার্যকর রয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সরকার যেকোনো সময়ে প্রয়োজন অনুসারে শিক্ষা কমিশন বা কমিটি গঠন করতে পারে। কমিশন বা কমিটি প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেয়ার পর যখন সেটি রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত হয়, তখন সেটিকে নীতি বলা যাবে; এর আগে তা শুধু কমিশন বা কমিটির প্রতিবেদন হিসেবে চিহ্নিত হবে।

২০১০ সালের শিক্ষা কমিশন মূলত কৌশলে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাকে ধীরে ধীরে ম্লান করার দিকে এগোচ্ছে। এ শিক্ষানীতির বেশকিছু সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও ২০১০ সালে গৃহীত শিক্ষানীতির কৌশলগুলো সরকার বাস্তবায়ন করবে বলে আশা করা হয়েছিল; কিন্তু পর্যাপ্ত সময় পাওয়ার পরও কেন সেসব কৌশল বাস্তবায়ন করা হয়নি, তা বোধগম্য নয়। শিক্ষানীতি গৃহীত হওয়ার পর ২০১১ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন ও মনিটরিংয়ে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এসব কমিটির অধীনে অনেকগুলো উপকমিটি গঠন করা হলেও কেন শেষ পর্যন্ত সেগুলো কার্যকর হলো না, তাও অজানা। ২০১৮ সালের মধ্যে ধাপে ধাপে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও বহু সুপারিশ ২০২১ সালে বাস্তবায়ন হয়নি। শিক্ষানীতি অনুসারে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীত হওয়ার কথা- সেটির অগ্রগতি নেই। শিক্ষানীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ রাখার ক্ষেত্রে উন্নতি দৃশ্যমান নয়। শিক্ষা কার্যক্রম সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে শিক্ষা আইন তৈরির কথা বলা হয়েছিল।

শিক্ষানীতি তৈরির পরপর শিক্ষা আইন নিয়ে কাজ শুরু হয়। খসড়া শিক্ষা আইন তৈরি হলেও এখন পর্যন্ত গৃহীত ও বাস্তবায়ন হয়নি। দেখা যাচ্ছে, যে রকম গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষানীতি তৈরি করা হয়েছিল, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন যারা ক্ষমতায় এসেছেন, পূর্ববর্তী সরকারের শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন বা শিক্ষানীতি কারণে বা অকারণে বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু যাদের নেতৃত্বে ২০১০ সালে শিক্ষানীতি তৈরি করা হলো, তখন থেকে এখন পর্যন্ত তারাই দেশ পরিচালনায় যুক্ত থাকলেও কেন নিজেদের তৈরি শিক্ষানীতির পুরোপুরি বাস্তবায়নে প্রত্যাশিত উদ্যোগ নেননি-সেটি একটি বড় প্রশ্ন। তা ছাড়া ২০১০ সালের শিক্ষানীতি ব্রিটিশ আমলের শিক্ষানীতি ও ড. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের আদলে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। ঐতিহ্যবাদী শিক্ষাবিদরা মনে করেন, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক চরিত্রের অধিকারী মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন আলোকিত মানুষ তৈরির সম্ভাবনা নেই।

বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী এ শিক্ষানীতি সংস্কারের কথা বলেছেন। শিক্ষানীতি সংস্কারের ঘোষণা এক অর্থে অপ্রত্যাশিত। কেননা শিক্ষানীতির বড় বড় বিষয় যেখানে এখনো বাস্তবায়ন হয়নি, সেখানে সংস্কারের অর্থ হচ্ছে শিক্ষানীতিটি বর্তমান সময়ের উপযোগী না ভাবা। যদি তাই হয়, সে ক্ষেত্রে শিক্ষানীতি সংস্কার না করে বরং পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে নতুনভাবে শিক্ষানীতি তৈরি করা শ্রেয়। এ দিকে শিক্ষানীতি সংস্কারের বা নতুন শিক্ষানীতি প্রবর্তনের আগে ঘোষিত হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা। এভাবে কেন কাজটি করা হলো তা-ও স্পষ্ট নয়। সরকার যদি অদূর ভবিষ্যতে নতুন শিক্ষানীতি তৈরি করে, তাহলে পরিবর্তিত শিক্ষানীতির আলোকে আবার নতুনভাবে শিক্ষাক্রম তৈরি করতে হবে। না হলে ঘোষিত এ শিক্ষাক্রমের রূপরেখা আদৌ নতুন শিক্ষানীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে কি না সেটি বড় সংশয়!

শিক্ষার উন্নতিকল্পে বর্তমান শিক্ষানীতিতে অনেক ভালো ভালো নীতি ও কৌশল গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। বর্তমান নিবন্ধের শুরুতে শিক্ষানীতিকে কেবল কিছু ভালো নীতি, কৌশল, সুপারিশ ও কথামালার সংকলন হিসেবে না দেখার কথা বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, শিক্ষানীতিকে দেখতে হবে শিক্ষার ইতিহাস, রূপান্তর ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের আবহে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করার পরও একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে নির্ধারিত শিক্ষানীতি অনুসারে চলতে পারে না, সেখানে আলাদাভাবে শুধু শিক্ষানীতি নয়, গভীরভাবে ভাবা প্রয়োজন শিক্ষার প্রতিটি উপাদান নিয়ে।

ইসলামী শিক্ষা বাদ দেয়া প্রসঙ্গ : পত্র পত্রিকার সংবাদের মাধ্যমে জানা যায়, নতুন শিক্ষানীতিতে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ধর্মশিক্ষা বাদ দেয়া হয়েছে, যা ঐচ্ছিকও রাখা হয়নি, অথচ আগে আবশ্যিক ছিল।
কোমলমতি শিশুদের ইসলামবিমুখ বানানোর আয়োজন চূড়ান্ত হয়েছে বলে অনেক শিক্ষাবিদ মনে করেন। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০-৩০ বছর পর এক ঐতিহ্যবিমুখ ধর্মীয় আবেগ অনুভূতিহহীন ভোগী প্রজন্ম গড়ে উঠবে। বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্যবই থেকে ইসলামী মূল্যবোধ সংশ্লিষ্ট সব গল্প-কবিতা বাদ দেয়া হয়েছে।

পাঠ্যপুস্তক বাংলা বই থেকে যা বাদ দেয়া হয়েছে : ক্লাস-২ : ‘সবাই মিলে করি কাজ’- শিরানোমে মুসলমানদের শেষ নবীর সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত। ক্লাস-৩ : ‘খলিফা হজরত আবু বকর’ শিরানোমে একটি সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত। ক্লাস-৪ : খলিফা হজরত ওমর এর সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত।

ক্লাস-৫ : ‘বিদায় হজ’ নামক শেষ নবীর সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত বাদ গিয়ে সংযুক্ত করেছে বই নামের একটি কবিতা, যা আল কুরআনের চেতনার সাথে খাপখায় না। ক্লাস-৫ : বাদ দেয়া হয়েছে কাজী কাদের নেওয়াজের লিখিত ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ নামক কবিতা। যাতে শিক্ষকের প্রতি বাদশাহ আলমগীরের মহত্ত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। এ কবিতায় শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে আদব কেমন হওয়া উচিত তা বর্ণনা করা হয়েছিল। ক্লাস-৫ : শহীদ তিতুমীর নামক একটি জীবনচরিত। এ প্রবন্ধটিতে শহীদ তিতুমীরের ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘটনা উল্লেখ ছিল।

ক্লাস-৬ : ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখিত ‘সততার পুরস্কার’ নামক একটি ধর্মীয় শিক্ষণীয় ঘটনা। ক্লাস-৬ : মুসলিম দেশ ভ্রমণ কাহিনী- ‘নীলনদ আর পিরামিডের দেশ’। ক্লাস-৬ : মুসলিম সাহিত্যিক কায়কোবাদের লেখা ‘প্রার্থনা’ নামক কবিতাটি। ক্লাস-৭ : বাদ দেয়া হয়েছে ‘মরু ভাস্কর’ নামক শেষ নবীর সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত। ক্লাস-৮ : বাদ দেয়া হয়েছে ‘বাবরের মহত্ত্ব’ নামক কবিতাটি। ক্লাস ৯-১০ : সর্ব প্রথম বাদ দেয়া হয়েছে মধ্যযুগের বাংলা কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের লেখা ‘বন্দনা’ নামক ধর্মভিত্তিক কবিতাটি। ক্লাস ৯-১০ : এরপর বাদ দেয়া হয়েছে মধ্যযুগের মুসলিম কবি আলাওল-এর ধর্মভিত্তিক ‘হামদ’ নামক কবিতাটি। ক্লাস ৯-১০ : বাদ দেয়া হয়েছে মধ্যযুগের মুসলিম কবি আব্দুল হাকিমের লেখা ‘বঙ্গবাণী’ কবিতাটি। ক্লাস ৯-১০ : গোলাম মোস্তফার লেখা ‘জীবন বিনিময়’ কবিতাটি। কবিতাটি মুঘল বাদশাহ বাবর ও তার পুত্র হুমায়ূনকে নিয়ে লেখা। ক্লাস ৯-১০ : কাজী নজরুল ইসলামের লেখা বিখ্যাত ‘উমর ফারুক’ কবিতা।

উপরে উল্লেখিত তথ্য-উপাত্ত থেকে আমরা এ কথা বলতে পারি যে, বর্তমানে প্রণীত শিক্ষানীতি ৯২ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত জনমানসের সাথে মানানসই নয়। তাই সঙ্গত কারণে এই শিক্ষানীতি পুনঃমূল্যায়ন করে ইসলামী ধর্মীয় আবেগ অনুভূতি ধারণ করে এমন শিক্ষানীতি প্রণোয়ন করতে হবে। তা না হলে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই শিক্ষানীতির বিরোধিতায় মাঠে নামতে বাধ্য হবে।
লেখক : সাবেক কলেজশিক্ষক ও সাবেক সিনেট সদস্য,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com