চোখ ধাঁধানো চাকচিক্যময় চিত্তহরণী পৃথিবীটা আখিরাতের তুলনায় খুবই নগণ্য ও তুচ্ছ। পৃথিবীর জীবন প্রকৃতপক্ষেই একটি ক্ষণস্থায়ী জীবন। এখানকার বসন্তকাল যেমন অস্থায়ী, তেমনি শরৎকালও। এখানে চিত্তহরণের বহু উপকরণ আছে, যা মোহনীয় লোভনীয়, মানুষকে প্রবলাকারে আকর্ষণ করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা এতটাই নগণ্য যে, নিজেদের নির্বুদ্ধিতার কারণে মানুষ ওইগুলোকে বড় বড় জিনিস বলে মনে করে এবং প্রতারিত হয়ে মনে করে, ওইগুলো লাভ করতে পারাই যেন চরম সফলতা। অথচ যে বড় বড় স্বার্থ এবং আনন্দের উপকরণই এখানে লাভ করা সম্ভব তা নিতান্তই নগণ্য ও তুচ্ছ এবং কেবল কয়েক বছরের ধার করা জীবন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। চিত্তকে ঠাণ্ডা করার জন্য যারা পৃথিবীকে অবাধে ভোগ ব্যবহার করেছে, হালাল-হারামকে একাকার করে আল্লাহর হুকুম অমান্য করেছে, কুরআন বলছে তারা আখিরাতে বলবে, ‘আমরা তো পৃথিবীতে এক দিন বা তার চেয়েও কম সময় ছিলাম।’
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষের জন্য নারী, সন্তান, সোনা-রুপার স্ত‚প, সেরা ঘোড়া, গবাদিপশু ও কৃষিক্ষেতের প্রতি আসক্তিকে বড়ই সুসজ্জিত ও সুশোভিত করা হয়েছে। কিন্তু এগুলো দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের সামগ্রীমাত্র। প্রকৃতপক্ষে উত্তম আবাস তো রয়েছে আল্লাহর কাছে। (হে মুহাম্মদ!) তুমি বলো, আমি কি তোমাদের জানিয়ে দেবো, এ গুলোর চাইতে ভালো জিনিস কী? যারা তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করে তাদের জন্য তাদের রবের কাছে রয়েছে বাগান, তার নিম্নদেশে ঝরনাধারা প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা চিরন্তন জীবন লাভ করবে। পবিত্র স্ত্রীরা হবে তাদের সঙ্গিনী এবং তারা লাভ করবে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের কর্মনীতির ওপর গভীর ও প্রখর দৃষ্টি রাখেন।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৪-১৫)
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ভালোভাবে জেনে রাখো, দুনিয়ার এ জীবন একটা খেলা, হাসি তামাশা, বাহ্যিক চাকচিক্য, তোমাদের পারস্পরিক গৌরব ও অহঙ্কার এবং সন্তানসন্ততি ও অর্থ-সম্পদে পরস্পরকে অতিক্রম করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। এর উপমা হচ্ছে বৃষ্টি হয়ে গেল এবং তার ফলে উৎপন্ন উদ্ভিদরাজি দেখে কৃষক আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। তারপর সে ফসল পেকে যায় এবং তোমরা দেখতে পাও যে, তা হলদে বর্ণ ধারণ করে এবং পরে তা ভুসিতে পরিণত হয়। পক্ষান্তরে আখেরাত এমন স্থান যেখানে রয়েছে কঠিন আজাব, আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (সূরা আল হাদিদ : ২০)
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর হে নবী! দুনিয়ার জীবনের তাৎপর্য তাদের এ উপমার মাধ্যমে বুঝাও যে, আজ আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করলাম, ফলে ভূ-পৃষ্ঠের উদ্ভিদ খুব ঘন হয়ে গেল, আবার কাল এ উদ্ভিদগুলোই শুকনো ভুসিতে পরিণত হলো, যাকে বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ সব জিনিসের ওপর শক্তিশালী। এ ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার জীবনের একটি সাময়িক সৌন্দর্য শোভামাত্র। আসলে তো স্থায়িত্ব লাভকারী সৎকাজগুলোই তোমার রবের কাছে ফলাফলের দিক দিয়ে উত্তম এবং এগুলোই উত্তম আশা-আকাক্সক্ষা সফল হবার মাধ্যম।’ (সূরা কাহাফ : ৪৫-৪৬)
অর্থাৎ তিনি জীবনও দান করেন আবার মৃত্যুও। তিনি উত্থান ঘটান, আবার পতনও। তাঁর নির্দেশে বসন্তকাল আসে এবং পাতা ঝরা শীত মৌসুমও তাঁর নির্দেশেই আসে। আজ যারা সচ্ছল ও আয়েশ আরামের জীবনযাপন করে তারা যেন এ অহঙ্কারে মত্ত না হয় যে, এ অবস্থার পরিবর্তন নেই। যে আল্লাহর দয়ায় এসব লাভ করেছে তাঁরই হুকুমে এসব তার কাছ থেকে ছিনিয়েও নেয়া যেতে পারে। ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ জীবন, খেল-তামাশার পৃথিবীতে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী, সারা পৃথিবীকে শাসন করে ফিরে। শাসন করার যাবতীয় উপকরণ তার হাতে রয়েছে। তার অবস্থাও আবার এমনও হতে পারে যে, ভাগ্যের একটি বিপর্যয় ও বিড়ম্বনা এ পৃথিবীতেই ওগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
কিন্তু আখিরাতের জীবন এক বিশাল ও স্থায়ী জীবন। সেখানকার কল্যাণও বিশাল ও স্থায়ী এবং সেখানকার ক্ষতিও বিশাল ও স্থায়ী। সেখানে কেউ যদি আল্লাহর মাগফিরাত ও সন্তুষ্টি পেয়ে যায় তাহলে সে চিরদিনের জন্য এমন নিয়ামত লাভ করল যার সামনে গোটা পৃথিবীর ধন-সম্পদ এবং রাজত্বও অতিশয় নগণ্য ও হীন। আর সেখানে যে আল্লাহর আজাবে গ্রেফতার হলো, সে যদি দুনিয়াতে এমন কিছুও পেয়ে যায় যা সে নিজে বড় মনে করত তবুও সে বুঝতে পারবে যে, সে ভয়ানক ক্ষতিকর কারবার করেছে। আমরা দুনিয়ার জীবনে সফলতার যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছি মূলত সেই সংজ্ঞা ভুল ও ভয়ানক ত্রুটিপূর্ণ। প্রকৃত সফলতা হলো, আখিরাতের সফলতা। আর প্রকৃত ব্যর্থতা বা ক্ষতি হলো, আখিরাতের ব্যর্থতা ও ক্ষতি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা ব্যবসায় ও বেচাকেনার ব্যস্ততার মধ্যেও আল্লাহর স্মরণ এবং সালাত কায়েম ও জাকাত আদায় করা থেকে গাফেল হয়ে যায় না, তারা সে দিনকে ভয় করতে থাকে যে দিন হৃদয় বিপর্যয় ও দৃষ্টি পাথর হয়ে যাবার উপক্রম হবে যাতে আল্লাহ তাদের সর্বোত্তম কর্মের প্রতিদান দেন এবং তদুপরি নিজ অনুগ্রহ দান করেন। আল্লাহ যাকে চান বেহিসাব দান করেন।’ (সূরা নূর : ৩৭-৩৮)
উল্লিখিত আয়াতগুলোর আলোকে প্রকৃত সফলতা অর্জন করার জন্য আমাদেরকে এ দুনিয়ায় নিজেদের কর্মনীতি পরিবর্তন করতে হবে। এ পৃথিবীতে গাফেল ও আল্লাহর স্মরণ থেকে বিচ্যুত হওয়ার জন্য চিত্তহরণী উপকরণের কোনো অভাব নেই। নিজেকে তা থেকে রক্ষা করতে হবে। যাদের আল্লাহ যতটুকু ধন-সম্পদ দিয়েছেন তা যদি প্রয়োজনের তুলনায় কম হয় তাহলে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, তার জন্য ধৈর্যই হলো সবচেয়ে বড় ঐশ্বর্য। আর যাদের আল্লাহ বেহিসাব সম্পদ দান করেছেন বা যারা হালাল উপায়ে প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক হয়েছেন, তাদেরকে উল্লিখিত আয়াতের আলোকে দুটো কর্মনীতি অবলম্বন করতে হবে। এক, ধন-সম্পদের অহঙ্কার করা যাবে না। কৃপণতা ও অপচয় করা যাবে না। দুই. সেই ধন-সম্পদ থেকে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে হবে। সমাজে যাদের সম্পদ প্রয়োজনের তুলনায় কম তাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য সম্পদ ব্যয় করতে হবে। মনে রাখতে হবে- সম্পদের অহঙ্কার, কৃপণতা ও অপচয় শয়তান বা কাফেরদের কাজ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা তাদের রবের সাথে কুফরি করল তাদের কার্যক্রমের উপমা হচ্ছে এমন ছাইয়ের মতো, যাকে একটি ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ দিনের প্রবল বাতাস উড়িয়ে দিয়েছে। তারা নিজেদের কৃতকর্মের কোনো ফলই লাভ করতে পারবে না। এটিই চরম বিভ্রান্তি।’ (সূরা ইবরাহিম : ১৮)
যারা নিজেদের রবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, অবিশ্বস্ততা, অবাধ্যতা, স্বেচ্ছাচারমূলক আচরণ, নাফরমানি ও বিদ্রোহাত্মক কর্মপন্থা অবলম্বন করে এবং নবী সা: যে আনুগত্য ও বন্দেগির পন্থা প্রদর্শন করে গেছেন তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে তাদের সমগ্র জীবনের কর্মকাণ্ড এবং সারা জীবনের সব আমল শেষ পর্যন্ত এমনি অর্থহীন প্রমাণিত হবে যেমন একটি ছাইয়ের স্ত‚প, দীর্ঘ দিন ধরে এক জায়গায় জমা হতে হতে তা একটি বিরাট পাহাড়ে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মাত্র এক দিনের ঘূর্ণিঝড়ে তা এমনভাবে উড়ে গেল যে, তার প্রত্যেকটি কণা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
তাদের চাকচিক্যময় সভ্যতা, বিপুল ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি, বিস্ময়কর শিল্প-কল-কারখানা, মহা প্রতাপশালী রাষ্ট্র, বিশালায়তন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, চারুকলা-ভাস্কর্য-স্থাপত্যের বিশাল ভাণ্ডার, এমনি তাদের ইবাদাত-বন্দেগি বাহ্যিক সৎকার্যাবলি এবং দান ও জনকল্যাণমূলক এমন সব কাজকর্ম যেগুলোর জন্য তারা দুনিয়ায় গর্ব করে বেড়ায়, সব কিছুই শেষ পর্যন্ত ছাইয়ের স্তূপে পরিণত হবে। কিয়ামতের দিনের ঘূর্ণিঝড় এ ছাইয়ের স্তূপকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দেবে এবং আখিরাতের জীবনে আল্লাহর মিজানে রেখে সামান্যতম ওজন পাওয়ার জন্য তার একটি কণাও তাদের কাছে থাকবে না।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘দুনিয়ার জীবনের দৃষ্টান্ত হচ্ছে যেমন আকাশ থেকে আমি পানি বর্ষণ করলাম, তার ফলে জমিনের উৎপাদন, যা মানুষ ও জীব-জন্তু খায়, ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে গেল। তারপর ঠিক এমন সময় যখন জমিন তার ভরা বসন্তে পৌঁছে গেল এবং ক্ষেতগুলো শস্যশ্যামল হয়ে উঠল। আর তার মালিকরা মনে করল এবার তারা এগুলো ভোগ করতে সক্ষম হবে। এমন সময় অকস্মাৎ রাতে বা দিনে আমার হুকুম এসে গেল। আমি তাকে এমনভাবে ধ্বংস করলাম যেন কাল সেখানে কিছুই ছিল না। এভাবে আমি বিশদভাবে নির্দেশনাবলি বর্ণনা করে থাকি তাদের জন্য যারা চিন্তাভাবনা করে। আর আল্লাহ তোমাদের শান্তির ভুবনের দিকে আহ্বান জানাচ্ছেন। যাকে তিনি চান সোজা পথ দেখান।’ (সূরা ইউনুস : ২৪-২৫)
অর্থাৎ দুনিয়ায় জীবনযাপন করার এমন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে, যা আখিরাতের জীবন আমাদের দারুস সালাম বা শান্তির ভবনের অধিকারী করে। দারুস সালাম বলতে জান্নাত বুঝানো হয়েছে এবং এর মানে হচ্ছে শান্তি ও নিরাপত্তার ভবন বা গৃহ। যেখানে বিপদ, ক্ষতি, দুঃখ ও কষ্ট নেই।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা কল্যাণের পথ অবলম্বন করেছে তাদের জন্য আছে কল্যাণ এবং আরো বেশি। কলঙ্ক কালিমা বা লাঞ্ছনা তাদের চেহারাকে আবৃত করবে না। তারা জান্নাতের হকদার, সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। আর যারা খারাপ কাজ করেছে তারা তাদের কাজ অনুযায়ী প্রতিফল পাবে। লাঞ্ছনা তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলবে। আল্লাহর কাছ থেকে তাদের বাঁচাবার কেউ থাকবে না। তাদের চেহারা যেন আঁধার রাতের কালো আবরণে আচ্ছাদিত হবে। তারা দোজখের হকদার। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল।’ (সূরা ইউনুস : ২৬-২৭)
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট