ইরানে বাধ্যতামূলক হিজাব পরার বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে। এর পরিণতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা নিয়ে বৈশ্বিক গণমাধ্যমে চলছে নানা বিশ্লেষণ। তবে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক মিডিয়াই বলেনি যে, এই আন্দোলনে ইরানের সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। তবে এবারের আন্দোলন ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কেত, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
ইরানের হিজাব ইস্যু শুরু হবার পর তা প্রাথমিকভাবে নৈতিক পুলিশের বাড়াবাড়ির ইস্যুতে বিক্ষুব্ধ তরুণ-তরুণীদের একটি বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ বলে মনে হয়েছিল; কিন্তু দ্রুত গতিতে এই আন্দোলন দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর ও শিক্ষাঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ে। তবে বিক্ষোভে যেসব ইসলামী বিধিবিধান দেশটিতে চালু রয়েছে তার সবকিছুর বিরুদ্ধেই কথা বলা হয়। এতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, দেশটিতে ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর যে ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়েছে সেই পুরো ব্যবস্থারই বিদায় চাইছে বিক্ষোভকারীরা।
বিক্ষোভ শুরু হবার পর প্রথম কয়েক দিন চুপচাপ থেকে দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি বলেন, এটি ইরানে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য আমেরিকা ও ইসরাইলের ষড়যন্ত্র। এতে স্পষ্ট হয় যে, ইরানি প্রশাসন কঠোর হাতে বিক্ষোভ দমন করবে। আর এর আগে নির্বাচনে কারচুপিসহ অন্য কয়েকটি ইস্যু নিয়ে যেসব আন্দোলন হয়েছিল সেগুলোর মতোই হিজাব আন্দোলনও ব্যর্থ হবে।
মাঠের বাস্তবতা
এটি ঠিক যে, হিজাব ছুড়ে ফেলে ক্ষোভ দেখানোর যে ঘটনা দেশটির বিভিন্ন শহরে দেখা যাচ্ছে সেটি একটি বাস্তবতা। আবার এটিই বাস্তব ঘটনা যে, দেশটিতে হিজাবসহ ইসলামী অনুশাসনের পক্ষে নারী-পুরুষের যে বিক্ষোভ সেটি প্রতিপক্ষ শক্তির চেয়ে অনেক বড়। ইরানের ইতিহাস ও ঐতিহ্য হাজার হাজার বছর আগের। ইসলামের আবির্ভাবের সময় বিশ্বের দুই পরাশক্তির একটি ছিল ইরান। সেটি তখন পারস্য সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল। পরে ইরানে ইসলামের প্রচার-প্রসার ঘটে। একসময় দেশটিতে সুন্নি ধারার মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। এখন ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ শিয়া।
ধর্মীয় পরিচয়ের দিক থেকে ইরানে ৯৯ শতাংশ মুসলিম হলেও বিশ্বাস ও আচরণের বিবেচনায় বিচিত্র ধরনের মানুষের সমাহার রয়েছে। ১৯৭৮ সালে রেজা শাহ পাহলভি রাজবংশের শাসনের অবসানের পর প্রচুরসংখ্যক ইরানি দেশ ছেড়ে বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হয়। ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্র কানাডার মতো পাশ্চাত্যের দেশগুলো ছাড়াও মালয়েশিয়ার মতো এশীয় দেশেও প্রচুর ইরানি আছেন, যারা দেশটির বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা সমর্থন করেন না।
১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে যখন ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হয়, তখন রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সবাই সে বিপ্লবে শামিল হন। ধর্মীয় নেতৃত্ব প্রধান যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্বাচিত ও মনোনীতদের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে তার বিরোধিতা শুরু থেকেই মুজাহিদিন ই খালকসহ বিভিন্ন বাম ধারার সংগঠন করেছে। তারা প্রথম দিকে বিভিন্ন অন্তর্ঘাতী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশটির ধর্মীয় নেতৃত্বকে পঙ্গু করে দিতে চেয়েছে। পরে ইরাকের মাধ্যমে দশক কালের এক যুদ্ধে জড়িয়ে ইরানের অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রিক কাঠামোকে চাপে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। এর মধ্যেও ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ব্যত্যয়হীনভাবে ২০২২ সাল পর্যন্ত চলে এসেছে।
এ সময়ের মধ্যে দেশটির রাষ্ট্রিক কাঠামোতে নির্বাচনের যে ব্যবস্থা রয়েছে তা নিরবচ্ছিন্নভাবে সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনের ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক ও আন্দোলনও হয়েছে; কিন্তু সিস্টেম ভেঙে পড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। এটি ইরানের বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার যে গভীর ও সুদৃঢ় ভিত্তি রয়েছে তার প্রমাণ।
প্রত্যক্ষ পরোক্ষ নির্বাচনের সমন্বয়
ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থা কতটা গণতন্ত্র ও জনগণের শতভাগ ইচ্ছার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তবে এই ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক ও পুরোপুরি ধর্মতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র বলারও সুযোগ নেই। কারণ ইরানের রাজনৈতিক কাঠামোতে প্রতিটা স্তরে নির্বাচনের ব্যবস্থা রয়েছে। সেই সাথে জবাবদিহিতার কিছু বিশ্বাসযোগ্য উপাদানও রয়েছে তাতে।
আমরা ইরানের বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান, নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের দ্বারা পরোক্ষভাবে নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান ও অনির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় দেখতে পাই। ইরানের বর্তমান ব্যবস্থায় জনগণ সরাসরি ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট ও ২৯০ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত করেন চার বছরের জন্য। এর পাশাপাশি আট বছরের জন্য নির্বাচিত করেন বিশেষজ্ঞ পরিষদের ৮০ সদস্যকে। নির্বাচিত সংসদ অভিভাবক পরিষদের অর্ধেক সদস্য নির্বাচিত করে এবং প্রেসিডেন্ট যে ক্যাবিনেট গঠন করেন তার অনুমোদন দান করে। নির্বাচিত বিশেষজ্ঞ পরিষদ সর্বোচ্চ নেতাকে নির্বাচিত বা অপসারণ করে। অভিভাবক পরিষদের ১২ সদস্যের অর্ধেকের মনোনয়ন দান করেন সর্বোচ্চ নেতা। একই সাথে তিনি সংসদের আন্তঃবিরোধ নিষ্পত্তির জন্য এক্সপিডিয়েন্সি কাউন্সিল, সশস্ত্র বাহিনী ও বিচার বিভাগের প্রধানকে মনোনয়ন দেন। আবার সংসদের নির্বাচিত ও সর্বোচ্চ নেতার মনোনীত সদস্য সমন্বয়ে যে অভিভাবক পরিষদ রয়েছে তারা সংসদ, প্রেসিডেন্ট ও বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্য হবার যোগ্যতা যাচাই বাছাই করেন।
ইরানের এই ব্যবস্থার সাথে গণতান্ত্রিক ও অগণতান্ত্রিক অন্য কোনো দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার কোনো মিল নেই। এটিকে সংক্ষিপ্তভাবে থিওলজিক্যাল ডেমোক্রেট রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে ধর্মতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তার ভিত্তি রয়েছে ইরানের শিয়া ধর্মীয় ব্যবস্থায়। এ ব্যবস্থা ইরানি সমাজের অনেক গভীরে প্রোথিত।
ফলে এ ব্যবস্থার শিকড় যেভাবে ইরানের রাষ্ট্র ও সমাজের গভীরে প্রোথিত তা উপড়ে ফেলা সম্ভব হবে না নানা কারণে। এ ব্যবস্থার ভিত্তি ইরানের সামাজিক ধর্মীয় এমনকি অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাব্যবস্থা জুড়েই রয়েছে। যার ফলে বারবার সরকার বা শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম হবার পরও চূড়ান্ত কোনো ফল তাতে আসে না। আর জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করার জন্য দেশটির অর্থনৈতিক দুরবস্থা যাতে চলতে থাকে সে লক্ষ্যে বিপ্লবের পর থেকেই যুদ্ধ ও অবরোধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এর ফলে জনগণের যে ভোগান্তি হচ্ছে তার জন্য সরকার বা ক্ষমতাসীন ব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়েছে; কিন্তু ইরানি জনগণের একটি বড় অংশ স্বাধীনভাবে ইরানের পথ চলার জন্য কিছু দুর্ভোগ মেনে নিতে যে প্রস্তুত সেটি বোঝা যায় বিপ্লবের সাড়ে চার দশক পরও এর পক্ষে জনগণের ব্যাপক সমর্থনের মধ্য দিয়ে।
বিক্ষোভ ও গভীর ক্ষমতা বলয়
ইরানিদের একটি বড় অংশ পাশ্চাত্যসহ বাইরের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হবার কারণে সেসব অঞ্চলের সংস্কৃতি ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার প্রভাব তাদের মননে প্রোথিত হয়। তাদের মাধ্যমে এর বিস্তার ঘটে ইরানি সমাজের একটি অংশে। ফলে প্রতিবারই যখন ইরানের রাজনৈতিক সামাজিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে তখনই বাইরের প্রভাব লক্ষ করা গেছে বিশেষভাবে। এর বাইরে ইরানের সব অঞ্চলের জনগণের নৃতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্য ও ধর্মবিশ্বাস মূলধারার অনুরূপ নয়। বিশেষত বেলুচিস্তান পশ্চিম আজারবাইজান ও কুর্দ অঞ্চলের জনগণের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সাথে অন্য অঞ্চলের কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বিপ্লবের প্রতি এবং রাষ্ট্রিক ব্যবস্থার প্রতি অনুগত। এই আনুগত্যের বিষয়টির প্রমাণ রাজনৈতিক সঙ্কটের সময় রাস্তায় নেমেই যে বিপ্লবপন্থীরা দিচ্ছে এমনই নয়। সে সাথে ইরানের নির্বাচনগুলোতে জনগণের যে অংশগ্রহণ তা মুক্ত ইউরোপের যেকোনো দেশের চেয়ে কম নয়। যদিও ইউরোপের মতো ইরানি ব্যবস্থায় নির্বাচনের অংশগ্রহণ একবারেই উন্মুক্ত নয়। ইরানি বিপ্লবের আদর্শের প্রতি অনুগত না হলে অভিভাবক পরিষদ জনপ্রতিনিধি হতে তাদের প্রার্থিতা অনুমোদন করেন না।
প্রতিটি দেশের শাসন ব্যবস্থার ভিত্তিতে থাকে গভীর ক্ষমতা বলয়। বিপ্লবোত্তর ইরানে তৈরি গভীর বলয়ের মধ্যে রয়েছে বিচার বিভাগ, ধর্মীয় আমলাতন্ত্রের কিছু সদস্য, দাতব্য ফাউন্ডেশন, বিভিন্ন আধা-বেসরকারি সংস্থা যা অর্থায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সর্বোচ্চ নেতার শক্তিশালী কার্যালয় যেটি সব কিছুর ওপর তদারকি করে।
সর্বোচ্চ নেতা খামেনির অফিস পররাষ্ট্র, গোয়েন্দা, স্বরাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের নিয়োগ যাচাই বাছাই করে। সেই সাথে ইরাক, রাশিয়া, সিরিয়া এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মিত্র দেশে ইরানের রাষ্ট্রদূতদের নাম সংসদে পাঠানোর আগে অনুমোদনের জন্য সর্বোচ্চ নেতার অফিসে পাঠানো হয়। রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর আইআরজিসির গোয়েন্দা সংস্থাও সর্বোচ্চ নেতার অফিসে অবস্থিত। এই ব্যবস্থাটি আইআরজিসিকে জাতীয় নিরাপত্তা লঙ্ঘনের জন্য নাগরিক এবং দ্বৈত নাগরিককে আটক করার ক্ষমতা দিয়েছে।
ইরানের গভীর ক্ষমতা বলয়ে কারা কিভাবে আছে সেটি ১৯৯৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মোহাম্মদ খাতামির সংস্কারবাদী রাষ্ট্রপতির সময় বিশেষভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। তখন এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভের গ্লাসনোস্ট এবং পেরেস্ট্রোইকার ধারণার মতো অভ্যন্তরীণ সংস্কারকে হুমকি হিসেবে দেখে। খাতামির রাষ্ট্রপতির সময় গভীর ক্ষমতা বলয় তার নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক ভিত্তির বাইরে নিজেকে প্রকাশ করতে শুরু করে। অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ রোধ করার জন্য রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে, যেমনটি ১৯৯৯ সালে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের সময় দেখা গিয়েছিল।
খাতামি-পরবর্তী ইরানের সরকার ২০০৯ সালের সবুজ আন্দোলনের বিক্ষোভ এবং ২০১৭-১৯ সালের অর্থনৈতিক বিক্ষোভ দমন করার পাশাপাশি পরবর্তী রাষ্ট্রপতিদের অ্যাজেন্ডাগুলো সীমাবদ্ধ করতে একই প্লেবুক ব্যবহার করে। এই গভীর ক্ষমতা বলয়ই বর্তমানে যে বিক্ষোভ চলছে তা দমন করার কর্মকাণ্ডে আবার নেতৃত্ব দিচ্ছে।
নেতৃত্বের পরিবর্তনের ইস্যু
নতুন সর্বোচ্চ নেতার উত্তরাধিকারের প্রস্তুতির জন্য, গভীর ক্ষমতা বলয় রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে চায়। সম্ভাব্য প্রার্থীরা বিপ্লবে গভীরভাবে বিশ্বাসের বৃত্তের মধ্যে থেকে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। আর তারা রক্ষণশীল মতাদর্শিক ঝোঁক পোষণ করবে বলে মনে হয়, যাদের আয়াতুল্লাহ খামেনির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ইরানের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম রাইসিকে খামেনির প্রতিস্থাপনে প্রতিযোগীদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকতে দেখা যায়। রাইসির ধর্মীয় ও অতীতের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্টভাবে শক্তিশালী ধর্মনেতাদের অভ্যন্তরীণ বৃত্তের সাথে তার নৈকট্যের ইঙ্গিত দেয়। ২০১৬ সালে, খামেনি তাকে শক্তিশালী মাশহাদ-ভিত্তিক অর্থনৈতিক সংগঠন আস্তান কুদস রাজাভির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন এবং ২০১৯ সালে তাকে ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান করা হয়। এরপর ২০২১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সাথে তিনি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে আসীন হন। এটি তাকে রাষ্ট্রপতি থেকে সর্বোচ্চ নেতা হওয়ার পথে খামেনির পদাঙ্ক অনুসরণ করতে প্রস্তুত করেছে বলে অনেকের ধারণা।
তবে একই সময়ে, রাইসির পাবলিক প্রোফাইল তাকে বৃহত্তর জনসাধারণের যাচাই-বাছাইয়ের জন্য উন্মুক্ত করে, যা গভীর ক্ষমতা বলয়ে তার মর্যাদাকে কিছুটা দুর্বল করতে পারে। করোনাভাইরাস বা অন্য যেকোনো কারণে ইরানের ইতিহাসে সর্বনিম্ন জনগণের অংশগ্রহণ ছিল এমন একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাইসি জিতেছেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার অবসানের প্রত্যাশা তৈরি করেন। কিন্তু রাইসি এখনো নীতিগত কোনো বড় জয়লাভ করতে পারেননি। কয়েক মাস আলোচনা সত্ত্বেও, ইরান পারমাণবিক আলোচনা এখনো একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি যা নিষেধাজ্ঞা উপশম করতে পারে। রাইসির এই বিব্রতকর অবস্থায়, ইসরাইল ইরানে অনুপ্রবেশ করে দেশটির সবচেয়ে বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করে।
এখন প্রতিবাদের ধারাবাহিক যে তরঙ্গ চলছে তা সাধারণ ইরানিদের জীবনে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত অব্যবস্থাপনার প্রভাব এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে কঠোর পদক্ষেপের ব্যাপারে ক্রোধের গভীরতা প্রকাশ করছে। এই অবস্থায় রাইসি সর্বোচ্চ নেতা হবার ক্ষেত্রে নিজের অবস্থান কতটা ধরে রাখতে পারবেন তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। খামেনির দ্বিতীয় পুত্র, মোজতবাকে পরবর্তী নেতা হবার সম্ভাব্য ব্যক্তি মনে করেন কেউ কেউ। তবে তার সম্ভাবনা এই কারণে কম হবে যে, এটি করা হলে বংশপরম্পরার নেতৃত্বের বিষয় চলে আসবে যা ইরানিরা চাইবে না।
কেন বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে?
প্রশ্ন হলো, এখন কেন ইরানি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। এর অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, ইসরাইল ও পশ্চিমা লবির একটি অংশ চাইছে না ছয় বিশ্ব শক্তির সাথে ইরানের পরমাণু চুক্তি নবায়ন হোক। এটি হলে ইরানের উপর থেকে অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞার একটি বড় অংশ উঠে যেতে পারে। ইরানকে আটকে রাখার প্রচেষ্টা এতে ব্যাহত হতে পারে যার প্রভাব ইসরাইল সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ ক’টি দেশে পড়তে পারে।
দ্বিতীয়ত, ইরান পাশ্চাত্যের বিকল্প শক্তি হিসাবে চীন-রাশিয়ার সাথে অনেক বেশি মাত্রায় একাত্ম হয়ে পড়েছে। একই সাথে প্রক্সি শক্তির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যেও দেশটির প্রভাব বাড়ছে। এ অবস্থায় ইরানকে আটকানোর জন্য এ ধরনের একটি ধাক্কার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করতে পারে, পাশ্চাত্য। বিক্ষোভের ঘটনায় পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পৃক্ততায় তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
তৃতীয়ত, ইরানের নেতৃত্বের একটি ট্রানজিশন আসন্ন বলে মনে করা হয়। বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির পর দীর্ঘসময় সর্বোচ্চ নেতার ভ‚মিকায় রয়েছেন আলী খামেনি। তিনি বার্ধ্যকের এমন এক অবস্থায় পৌঁছে গেছেন যাতে মনে করা হয় খামেনি যেকোনো সময় দায়িত্ব পালনে অক্ষম বা মৃত্যুবরণ করতে পারেন। এ অবস্থায় নতুন নেতৃত্বের একটি প্রতিযোগিতা রয়েছে। ইরানের রাজনীতিতে যেহেতু রক্ষণশীল ও মডারেট দু’টি বিভাজন রয়েছে। সঙ্গত কারণে সর্বোচ্চ নেতার পদটি নিজস্ব বলয়ে রাখার প্রচেষ্টা থাকতে পারে। খামেনি রক্ষণশীল বলয়ের সদস্য হিসেবে এতদিন কাজ করে গেছেন। তার উত্তরাধিকারকে কেন্দ্র করে ইরানি সমাজ ও গভীর ক্ষমতা বলয়ে প্রভাব বিস্তারের একটি প্রচেষ্টা থাকতে পারে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইরানের প্রক্সি শক্তিগুলোর ভ‚মিকা অনেক রাষ্ট্রে অস্থিরতা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ইরাক সিরিয়া লেবানন ইয়েমেন ককেসাস অঞ্চলসহ আরো কয়েকটি দেশ। এমনকি মধ্যপন্থী ভূমিকার জন্য খ্যাত তুরস্কের সাথে নানা ইস্যুতে ইরানের দূরত্ব বাড়ছে। এসব কারণে রাষ্ট্র হিসেবে ডিস্টার্বিং ইরানের পরিচয় ছড়িয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানেও ইরানি ড্রোন ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব কারণের কম বেশি ভূমিকা রয়েছে বর্তমান অস্থিরতার পেছনে।
প্রশ্ন হলো, এ অবস্থায় ইরান কোনো পথে এগুচ্ছে? ইরানি শাসন পরিবর্তনের বড় কোনো লক্ষ্য আন্দোলনকারীরা অর্জন করতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে এটি একটি ঝাঁকুনি দিয়ে যাবে ইরানের রাষ্ট্রিক ও সামাজিক ব্যবস্থায়।
নিকট ভবিষ্যতে ইরানি বিপ্লবের বিপন্ন হবার সম্ভাবনা কম মনে হয়। তবে ইরানের পরমাণু কেন্দ্রে ইসরাইল বা তার পৃষ্ঠপোষক আমেরিকার সামরিক হামলার মতো ঘটনা ঘটলে অথবা এখন পাশ্চাত্যের সাথে চীন-রাশিয়া বলয়ের যে লড়াই শুরু হয়েছে তাতে শেষোক্তদের সর্বাত্মক পরাজয় ঘটলে তার প্রভাব ইরানের ওপরও পড়বে। তবে এই প্রভাব শাসন পরিবর্তন পর্যন্ত ঠেকবে কি না সেটি নির্ভর করবে ইরানি সাধারণ মানুষের ওপর দেশটির থিওক্রেসি নিয়ন্ত্রিত ডেমোক্রেসির বিদ্যমান ব্যবস্থা কতটা প্রভাব বজায় রাখতে পারে তার ওপর।
mrkmmb@gmail.com