যখন কোনো বাধ্যতামূলক অবস্থায় কোনো ব্যক্তি নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে অন্য কোনো দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেন, তাহলে তাকে বলা হবে রিফিউজি। বিশেষত যে ক্ষেত্রে এরূপ ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির সাথে সংঘাতপূর্ণ অবস্থার সম্মুখীন হন সে ক্ষেত্রে তাকে অন্য কোনো দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দিতে হবে। সংক্ষেপে বলা যায় যে, রিফিউজি বা শরণার্থী হলো এমন কোনো ব্যক্তি যিনি ভিন্ন দেশে আশ্রয় গ্রহণ করে থাকেন।
নাগরিকদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কোনো রাষ্ট্রের সরকার যখন তার নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে অনিচ্ছুক বা অপারগ হয় তখন জনগণ তার অধিকার রক্ষিত না হওয়ায় নিরাপত্তার খোঁজে দেশ, এমনকি পরিবার ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। তাই সংজ্ঞানুযায়ী নিজের দেশের সরকার যখন এসব শরণার্থীর মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে পারে না ঠিক তখনই এসব অধিকার যেন রক্ষিত হয় তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্যোগ নিয়ে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ জাতিসঙ্ঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) অফিস তৈরি করে। ইউএনএইচসিআর শরণার্থীদের নিরাপত্তা প্রদান ও স্থায়ী সমাধান করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। এই সংস্থার কার্যক্রম আন্তর্জাতিক আইন ও মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত যার মধ্যে আছে ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের ওপর চারটি জেনেভা কনভেনশন (১৯৪৯)। এ ছাড়াও বহু বাধ্যতামূলক বা ঐচ্ছিক আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চুক্তি এবং ঘোষণা এর অন্তর্ভুক্ত যা শরণার্থীদের চাহিদা নির্দেশ করে।
আন্তর্জাতিক আইনের মানদণ্ড
শরণার্থীর মর্যাদাসংক্রান্ত ১৯৫১ সালের কনভেনশন ‘শরণার্থী’ শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করে এবং যারা শরণার্থীর মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত তাদের সাথে কী ধরনের আচরণ করা হবে তার একটি ন্যূনতম মানদণ্ড নির্ধারণ করে।
যেহেতু কনভেনশনটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে তৈরি এবং এর শরণার্থী সংজ্ঞাটি সেসব ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল যারা ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারির আগে ইউরোপ অথবা অন্য কোথাও ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার কারণে নিজের দেশের বাইরে অবস্থান করছিল। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে ও ষাটের দশকের শুরুতে যখন নতুনভাবে শরণার্থী সমস্যা দেখা দিতে থাকে, তখন শরণার্থী কনভেনশনের এই সময় ও ভৌগোলিক সীমারেখাসংক্রান্ত সীমাবদ্ধতাকে আরো শিথিল করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এভাবে এই কনভেনশনের খসড়া চুক্তি তৈরি ও গৃহীত হয়।
১৯৫১ সালের শরণার্থীর মর্যাদাসংক্রান্ত কনভেনশন অনুযায়ী শরণার্থী বিবেচিত হবেন : ১. জাতিগোষ্ঠী ২. জাতীয়তা ৩. নির্দিষ্ট সামাজিক সংগঠনের সদস্যপদ ৪. রাজনৈতিক মতাদর্শ ৫. যিনি নিজ দেশের বাইরে অবস্থান করছেন এবং ৬. নিজ দেশের নিরাপত্তা পেতে যিনি অপারগ অথবা অনিচ্ছুক বা নিগ্রহের ভীতির কারণে সেখানে ফেরত যেতে চান না।
শরণার্থীর মর্যাদাসংক্রান্ত ১৯৬৭ সালের গৃহীত প্রটোকল
১৯৬৭ সালের শরণার্থীর মর্যাদাসংক্রান্ত খসড়া একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ চুক্তি, যদিও ১৯৫১ সালের কনভেনশনের সাথে তা অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। এই খসড়া চুক্তিটি কনভেনশনের শরণার্থী সংজ্ঞায় নির্দেশিত সময় ও স্থান সম্পর্কিত সীমাবদ্ধতাগুলো পরিহার করে। সম্মিলিতভাবে শরণার্থী কনভেনশন ও খসড়া চুক্তি প্রধান তিনটি বিষয়কে ধারণ করে : ১. মূল শরণার্থী সংজ্ঞা এবং শরণার্থীর মর্যাদা থেকে রহিতকরণ ও বর্জন সংক্রান্ত নীতিমালা। ২. আশ্রয়দাতা দেশের শরণার্থীদের আইনি মর্যাদা, তাদের অধিকার ও নৈতিক দায়িত্ব এবং বাধ্যতামূলক প্রত্যাবর্তনের অধিকার রক্ষণাবেক্ষণসহ যেখানে জীবন ও স্বাধীনতা হুমকির সম্মুখীন হতে পারে সেখানে তাদের জোর করে ফেরত না পাঠানো। ৩. কার্যক্ষেত্রে ইউএনএইচসিআর এর সাথে সহযোগিতার অনুশীলনসহ রাষ্ট্রের দায়িত্বসমূহ এবং কনভেনশন প্রয়োগের বিষয়টি তদারকির দায়িত্ব পালন।
খসড়া চুক্তি অনুমোদনের মাধ্যমে রাষ্ট্রসমূহ এই চুক্তির শরণার্থী সংজ্ঞা অনুযায়ী এর আওতায় যারা পড়বে তাদের প্রতি শরণার্থী কনভেনশন এর অধিকাংশ ধারা প্রয়োগ করতে সম্মত হয়। যদিও বেশির ভাগ রাষ্ট্রই কনভেনশন ও খসড়া চুক্তি উভয়ই অনুমোদন করে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলো নিশ্চিত করে যে উভয় চুক্তি হচ্ছে আন্তর্জাতিক শরণার্থী রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার মৌলিক বিষয়। ১৯৫১ সালের শরণার্থী মর্যাদাসংক্রান্ত কনভেনশনের সংজ্ঞা অনুযায়ী শরণার্থী এবং রাজনৈতিক নিগ্রহের শিকার জনগোষ্ঠীকে গ্রহণের ক্ষেত্রে এই সম্মেলন সব সংসদ ও সরকারকে তাদের দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন হতে আহ্বান জানায়। আন্তঃসংসদীয় ইউনিয়নের ৭৮তম সম্মেলন, অক্টোবর ১৯৮৭ নির্বাহী কমিটি দৃঢ়তার সাথে পুনর্ব্যক্ত করে যে ১৯৫১ সালের শরণার্থীর মর্যাদাসংক্রান্ত কনভেনশন ও ১৯৬৭ সালের খসড়া চুক্তি আন্তর্জাতিক শরণার্থী ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হিসেবে বহাল আছে।
ইউএনএইচসিআর হচ্ছে শরণার্থীদের রক্ষণাবেক্ষণ ও তাদের দুর্দশা লাঘবের স্থায়ী সমাধান খোঁজার উদ্দেশ্যে সহযোগিতা প্রদানের জন্য জাতিসঙ্ঘের দ্বারা দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি মানবিক ও অরাজনৈতিক সংস্থা। যেহেতু গত অর্ধ শতাব্দী ধরে বাস্তুচ্যুতির সমস্যা জটিল আকার ধারণ করেছে সেহেতু ইউএনএইচসিআর-ও এই চ্যালেঞ্চ মোকাবেলা করার জন্য তার কলেবর বৃদ্ধি করেছে। ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা তিন বছরের লক্ষ্যে শুরু হয় এবং ছোট একটি বিশেষ কার্যালয় থেকে বর্তমানে তা ১২০টি রাষ্ট্রে কর্মরত। বর্তমানে প্রায় ৪,০০০ এর অধিক কর্মী সম্বলিত এই প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বাজেট প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। আইনগত সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি এই সংস্থা সরাসরি বা সহযোগী সংস্থার সহযোগিতায় গুরুতর সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতিতে ত্রাণ সাহায্য দিয়ে থাকে। এর প্রথম পঞ্চাশ বছরে ইউএনএইচসিআর পাঁচ কোটির বেশি মানুষের রক্ষণাবেক্ষণ ও সহযোগিতা করেছে এবং এর কার্যক্রম এই প্রতিষ্ঠানকে দু’বার নোবেল শান্তি পুরস্কার এনে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে ইউএনএইচসিআর আন্তর্জাতিক শরণার্থী চুক্তিগুলোর অগ্রগতি সাধন ও আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইনের সাথে সরকারের আনুগত্য যাচাই করে। ইউএনএইচসিআর শরণার্থী রক্ষণাবেক্ষণের সাথে জড়িত সব ব্যক্তি যেমন- সীমান্ত রক্ষী, সাংবাদিক, বেসরকারি সংস্থা, আইনজীবী, বিচারক ও ঊর্ধ্বতন সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে শরণার্থী আইন চালু করে।
মাঠ পর্যায়ে ইউএনএইচসিআর’র কর্মীরা ব্যাপক কর্মসূচির মাধ্যমে শরণার্থীদের রক্ষণাবেক্ষণ করে। এসব কর্মসূচির মধ্যে আছে জরুরি অবস্থায় পদক্ষেপ নিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সীমান্ত থেকে দূরে শরণার্থী ক্যাম্প সরিয়ে নিয়ে যাওয়া, খাদ্য বিতরণ ও সামাজিক ক্ষেত্রে মহিলাদের মতামত নিশ্চিত করা, বিচ্ছিন্ন পরিবার পুনঃএকত্রীকরণ, শরণার্থীদের নিজ দেশের প্রকৃত পরিস্থিতির ব্যাপারে তথ্য দেয়া যেন তারা ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে পরিস্থিতি যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, দ্বিতীয় একটি দেশে পুনর্বাসনের জন্য শরণার্থীদের চাহিদাগুলো নিবন্ধন, ডিটেনশন কেন্দ্র পরিদর্শন এবং বিভিন্ন সরকারকে শরণার্থী আইন, নীতি ও কর্মপদ্ধতি প্রণয়নে পরামর্শ দেয়া।
ইউএনএইচসিআর শরণার্থীদের দুর্দশার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান অনুসন্ধান করে। যদি নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার পরিস্থিতি অনুকূল থাকে তবে সেখানে তাদের প্রত্যাবাসন করা, আশ্রয়দাতা দেশে একত্রিত করা বা অন্য একটি দেশে পুনর্বাসন করার মাধ্যমে ইউএনএইচসিআর শরণার্থীদের সহায়তা দেয়।
ইউএনএইচসিআর’র ক্ষমতা
শরণার্থী কনভেনশন ও খসড়া চুক্তি সদস্য রাষ্ট্রদের শরণার্থী রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি আইনি কাঠামো তৈরি করে। এভাবে শরণার্থীদের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও তাদের সমস্যার স্থায়ী সমাধান খোঁজার জন্য ইউএনএইচসিআরকেও ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আর এটা দেয়া হয়েছে ১৯৫০ সালের ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত ইউএনএইচসিআর’র বিধিবদ্ধ আইনের মাধ্যমে।
লেখকের মন্তব্য
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জনগণের মানবাধিকার, মৌলিক অধিকার, নাগরিক অধিকার প্রভৃতি রক্ষার জন্য জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে অধিকার সম্পর্কিত নিম্নবর্ণিত সনদ তথা আইন (Instrument) অনুমোদিত হয় :
১। Unversal Declaration on Humen Right 1948.
২। International Covenant on Economic, Social and Cultureal Right 1976.
৩। International Covenant on Civil & Political Right.
৪। Convention Against Tourture & other cruel, in human or Degrading Treatment or Punishment 1987.
৫। Convention on the Elimination of All forms of Discrimination against Women.
৬। Convention on the Rights of the Child 1989.
এ ছাড়াও মানুষকে রাষ্ট্রীয় অত্যাচার নির্যাতন থেকে রক্ষার জন্য জাতিসঙ্ঘ আরো আন্তর্জাতিক সনদ ও প্রটোকল ঘোষণা করেছে যা সদস্য রাষ্ট্রগুলো মানতে বাধ্য। ওই সনদকে শ্রদ্ধা জানালে কোনো রাষ্ট্র বিভিন্ন মতার্দশের মতবিরোধের কারণে কোনো নাগরিক, পরিবার বা গোষ্ঠীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজ দেশ থেকে বের করে দিতে পারে না। তার পরও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গকারী রাষ্ট্র মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না কেন?
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরৎ পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীনের রাষ্ট্রদূতের কাছে ধর্না দিচ্ছেন। এখন দেখা যাচ্ছে যে, জাতিসঙ্ঘ বা জাতিসঙ্ঘের আইনের চেয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের মূল্য এখন বেশি। বিভিন্ন কারণে জাতিসঙ্ঘ বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণে নিজের কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে পৃথিবীর বৃহৎ শক্তি থেকে জাতিসঙ্ঘকে মুক্ত করে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
(অ্যাপিলেট ডিভিশন)