আইএমএফ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশকে তাদের তিনটি কর্মসূচির অধীনে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ দানের সুপারিশ করবে বলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে। আইএমএফের বোর্ড সভা অনুমোদন করলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে এর প্রথম কিস্তি আর ২০২৬ সালে শেষ কিস্তি বাংলাদেশ পাবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে তীব্র সঙ্কটের মুখে তাতে সাড়ে তিন বছরে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার সহায়তা উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। তবে আইএমএফের এই সমঝোতা পশ্চিমা দেশ এবং তাদের মিত্র ও প্রভাবে চলা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ ও সহায়তার বিষয়ে একটি সঙ্কেত হিসেবে কাজ করবে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী রেয়াতি সুদের ঋণ সহায়তা চেয়েছেন।
কেমন অর্থনৈতিক সঙ্কটে দেশ
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটের মূল নিহিত বৈদেশিক খাতে। ইউক্রেন অভিযানের পর রাশিয়ার ওপর সর্বাত্মক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী করে। এর প্রভাব পড়ে সব আমদানি পণ্যের ওপর। এর পাশাপাশি আগের দুই বছরে করোনার প্রাদুর্ভাবে ভোজ্যতেল চিনিসহ বিভিন্ন ভোগ্য পণ্যের দাম বেড়ে যায় বিশ্ববাজারে। এর ফলে বাংলাদেশের আমদানি খরচ প্রায় দেড়গুণ বাড়ে। এই সঙ্কটের সময়েই আমদানি পণ্যের অতিরিক্ত দাম দেখিয়ে ডলার পাচারের ঘটনাও উদঘাটিত হয়। ডলারের ব্যয়ে এই উল্লম্ফন যখন ঘটে তখন ব্যাংক মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসা কমে যায়। রফতানির প্রবৃদ্ধি দিয়ে আমদানি ব্যয় মেটানো আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে বাণিজ্য ও চলতি হিসাবে ঘাটতি বাড়তে থাকে। মূলধনী হিসাবে ডলারের আন্তঃপ্রবাহ কম থাকায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সার্বিক লেনদেনের ভারসাম্যে। এই চাপ মোকাবেলা করার জন্য করোনার অজুহাতে ব্যাংকগুলো এলসি নিষ্পত্তির দায় একদিকে পিছিয়ে দেয় অন্য দিকে বেসরকারি খাত স্বল্পমেয়াদি যে ঋণ গ্রহণ করেছিল তা পরিশোধের মেয়াদ পিছিয়ে দিতে থাকে। করোনা সময়ের ঘটনার এই চাপ করোনা স্বাভাবিক হওয়ার পর এক সাথে পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ডেফার্ড এলসির অঙ্ক দাঁড়ায় ৩৪ বিলিয়ন ডলারে। যার অর্ধেক পরবর্তী দুই মাসে পরিশোধের চাপ আসে। এই দায় শোধ করতে না পারায় বিভিন্ন বিদেশী ব্যাংক বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকগুলোর এলসি গ্রহণে অনীহা দেখাতে শুরু করে। এই অবস্থায় আশু বিপদ ঠেকানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণের কঠোর নীতি অনুসরণ শুরু করে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পণ্য ছাড়া অন্য পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ডলার দেয়া বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে বৈদেশিক খাতের চিত্রটি হলো এ রকম-২০২৩ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরের মধ্যে পণ্যদ্রব্যের রফতানি সাত শতাংশ বেড়ে ১৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। কাস্টমসভিত্তিক আমদানি ব্যয় পৌনে ১১ শতাংশ বেড়ে ২২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেয়ায় ২০২৩ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে নতুন আমদানি এলসি খোলার প্রবৃদ্ধি ছিল দাঁড়ায় নেতিবাচক সাড়ে ৮ শতাংশে আর এতে নতুন এলসির অঙ্ক সোয়া ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
প্রবাসি কর্মীদের রেমিট্যান্স থেকে মোট প্রাপ্তি ২০২৩ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরের মধ্যে ২ শতাংশ বেড়ে সোয়া সাত বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। আর এই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৫ বিলিয়ন ডলারের কোটায় নেমে আসে, যা নিট হিসাবে দাঁড়ায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের মতো। অন্য দিকে ২০২২ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরের তুলনায় ২০২৩ অর্থবছরের জুলাই সেপ্টেম্বরে মোট বৈদেশিক সাহায্যের প্রাপ্তি ৩৮ শতাংশ কমে দুই বিলিয়ন ডলার থেকে দেড় বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। বিবেচ্য এই তিন মাসে চলতি হিসাবের ঘাটতি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩.৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। এর ফলে সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্য এই সময়ে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সোয়া ৩০০ ভাগ বেড়ে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। সার্বিক লেনদেনের ভারসাম্যের এ ধরনের চিত্র আগের এক যুগে আর দেখা যায়নি।
কেন অর্থনৈতিক কাঠামোর ভঙ্গুরতা
বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিগঠন এমন যে এখানে অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও রফতানি দুটোই আমদানির ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল। খাদ্যশস্যের মধ্যে গম ভুট্টা ও শিশু খাদ্য আর ভোজ্যতেল চিনির বড় অংশ আমদানি করতে হয়। অন্য দিকে জ্বালানি তেলের পুরোটা এবং প্রয়োজনীয় গ্যাসের বড় অংশ আমদানি করতে হয়। এর ওপর আবার বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন ব্যাপকভাবে এলএনজি নির্ভর করে তোলা হয়েছে।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশে এখন যে অবস্থা তৈরি হয়েছে তার পুরোটা অভ্যন্তরীণ কারণে নয়। তবে একই সাথে গত এক যুগের অর্থনৈতিক নীতি ও পদক্ষেপ নানা ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শক্তির ক্ষয় ঘটিয়েছে ভয়ঙ্করভাবে। পূর্ববর্তী দুই দশকে বাংলাদেশ নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে অগ্রগতির শক্ত ভিত্তি তৈরি করতে পেরেছিল। তার ফল গত দশকে অর্থনীতি পেয়েছে। কিন্তু গত দশকে এমন কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে যা উন্নয়নের এই ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছে।
কী ছিল সেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি
যেকোনো দেশের উন্নয়নে মূলধনের জোগান আসে পুঁজিবাজার ও ব্যাংকব্যবস্থা থেকে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর একবার আর তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর দ্বিতীয়বার শেয়ারবাজারে কারসাজির মাধ্যমে ধস সৃষ্টির মাধ্যমে বাজারের মূল ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে। গত তিন দশকে শেয়ার বাজারের অনেক কাঠামোগত উন্নয়ন রয়েছে। এনালগ বাজার ডিজিটালাইজড হয়েছে। কিন্তু বাজার কারসাজির অবকাশ সুপ্তভাবে দুই ব্যবস্থাতে থেকেই গেছে। প্রথমবার প্রাথমিক শেয়ারে অস্বাভাবিক মূল্য তৈরি করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়। দ্বিতীয় দফায় অযৌক্তিক প্রিমিয়াম যোগ করে শেয়ার ছাড়ার মাধ্যমে মাধ্যমিক বাজারে কারসাজি করে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। দু’টি ঘটনা গভীরভাবে অনুসন্ধান করলে এর পেছনে ক্ষমতাধরদের আনুক‚ল্যপ্রাপ্ত একটি শ্রেণীকেই খুঁজে পাওয়া যাবে। এখন যে শেয়ারবাজার রয়েছে সেটিকে মুক্ত প্রতিযোগিতার ওপর ছেড়ে দিলে আরেক দফা ধস অনিবার্য হয়ে উঠতে পারত। ফ্লোর প্রাইসের মাধ্যমে লেনদেন ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে সম্ভাব্য ধস ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে।
শিল্প ও বাণিজ্য মূলধন জোগানের আরেকটি ক্ষেত্র হলো ব্যাংক খাত। ব্যাংক খাত আধুনিক অর্থনীতির মেরুদণ্ড। ব্যাংকব্যবস্থা স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এক ধরনের অভিন্ন বাজার তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে উদ্বৃত্ত শ্রমিকের প্রবাসে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। মুক্তবাজার ও বিশ্বায়নের মাধ্যমে এক দেশের কাঁচামাল অন্য দেশে রফতানি হয়ে শিল্প পণ্য হয়ে সে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ভোগ হয়। শ্রম ও পুঁজির সহজলভ্যতার ভিত্তিতে এক দেশের উৎপাদিত পণ্য অন্য দেশে রফতানি হয়। এভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, রেমিট্যান্স ও অর্থপ্রবাহ অবাধ করার মাধ্যমে যে সমন্বিত বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তাতে প্রধান ভ‚মিকা পালন করে ব্যাংকব্যবস্থা। আবার এই ব্যাংকব্যবস্থাই বাংলাদেশের মতো দেশে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে পুঁজির জোগান দেয়। ’৮০-এর দশকে বাংলাদেশের রফতানিতে পোশাক খাতের অবিস্মরণীয় উদ্যোগে ব্যাংকিং খাতের গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। এ সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংক খাতে দু’ধরনের সমস্যা ছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে রাজনৈতিক আনুক‚ল্যপ্রাপ্তদের মধ্যে ক্ষমতা খাটিয়ে ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেয়ার সংস্কৃতি তৈরি হয়। অন্য দিকে সদ্য বিকশিত বেসরকারি ব্যাংক খাতে এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা মালিকদের জনগণের আমানতের অর্থ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের প্রবণতা তৈরি হয়।
’৯০-এর দশকের শুরু থেকে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সহায়তায় ব্যাংকব্যবস্থা থেকে এই দুই রোগ সারানোর জন্য পর্যায়ক্রমে অনেক সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে সরকারের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য আইনি সংস্কার আনা হয়। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে একই পরিবারের সদস্যদের শেয়ার ও পরিচালক হওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে মালিকানায় বৈচিত্র্য ও নিয়ন্ত্রণ বহুমুখী করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়। এসব পদক্ষেপে দু’টি ফল পাওয়া যায়। প্রথমত, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দিয়ে পার পাওয়া যাবে এমন ধারণা দুর্বল হতে থাকে। দ্বিতীয়ত, সামান্য কিছু অর্থ বিনিয়োগ করে ব্যাংকের মালিক-উদ্যোক্তারা যে আমানতকারীদের বিপুল অর্থ নিয়ন্ত্রণের একতরফা সুযোগ নেন তার বিলুপ্তি ঘটে। এর ফলে ব্যাংকগুলো এক দিকে মূলধন জোগানের আরেক ক্ষেত্র পুঁজিবাজারের বিকাশে পরোক্ষ ভ‚মিকা পালন করে অন্য দিকে ব্যবসায়ী শিল্প উদ্যোক্তাদের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশে বিপুল শিল্পভিত্তি তৈরিতে সহায়তা করে। এ সময় পোশাক খাতের অগ্রপশ্চাৎ সংযোগ শিল্প গড়ে ওঠে। দেশে টেক্সটাইল স্পিনিং ও সমন্বিত কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল গড়ে ওঠে বিপুলভাবে। রফতানি পণ্যের স্থানীয় মূল্য সংযোজন এতে অনেক বৃদ্ধি পায়। এটিই গত ২০ বছরে বাংলাদেশের শিল্প ভিত্তি তৈরিতে অনন্য ভ‚মিকা পালন করেছে। আর এটিই গত দুই দশকে দেশে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে তাতে মুখ্য ভ‚মিকা রেখেছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বিষয়টি অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে বিশ্লেষণ করে তুলে ধরা হয়েছে।
এখন এমন কী হলো
প্রশ্ন করা যেতে পারে, এখন এমন কী হলো যে উন্নয়ন ও ক্রমবিকাশের ধারা মুখ থুবড়ে পড়ছে? এর গভীর বিশ্লেষণ করা হলে গত এক যুগের রাষ্ট্রীয় নীতির কিছু বিচ্যুতির প্রভাব দেখতে পাওয়া যাবে। প্রথমত, পুঁজি বাজারে দু’দফা কারসাজির ঘটনা ঘটিয়ে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে নিঃস্ব করার পর বাজারে অনেক ধরনের সংস্কার ও আধুনিকায়ণ করেও সেই আস্থা ফেরানো যায়নি। ফলে শেয়ারবাজার এখন মূলধন জোগানে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়ত, আরেকটি ঘটনা অর্থনীতিতে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরিণাম সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি করেছে। সেটি হলো ব্যাংকব্যবস্থাকে অকার্যকর অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়া। ৯০-এর দশকে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ সূচিত সংস্কারের দুই গুরুত্বপূর্ণ ফল এখন নেই হয়ে গেছে। প্রথমটি হলো খেলাপি সংস্কৃতি সরকারি-বেসরকারি উভয় ব্যাংক খাতে বিপুলভাবে ঢুকে পড়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাঝারি বৃহৎ বিনিয়োগ সরকারি আনুক‚ল্যের বাইরে কদাচিৎ হতে দেখা যাচ্ছে। এ সব ব্যাংকের ঋণ ও বিনিয়োগ প্রদানে আনুক‚ল্যপ্রাপ্তদের মধ্যস্থতা অনেক ক্ষেত্রে মূল উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রদত্ত ঋণের বিপরীতে মানসম্মত সহায়ক জামানত ও দলিলপত্র থাকছে না। এ অবস্থার সাথে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে বাড়তি যুক্ত হয়েছে তহবিলের ওপর মালিকদের একতরফা নিয়ন্ত্রণ। এসব মালিক ক্ষমতার বড় পর্যায়ে আর্থিক সুবিধা দিয়ে শুধু নিজেদের নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকের তহবিল নামে বেনামে নিয়ে নিচ্ছে তাই নয়, তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিকেও প্রভাবিত করছে বহু ক্ষেত্রে। ফলে ব্যাংকের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
ব্যাংকের ভেতরের এই চিত্র আইএমএফের পরিদর্শক দলের কাছেও স্পষ্ট। এ জন্যই সংস্থার পক্ষ থেকে যেসব শর্ত দেয়া হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দু’টি হলো, ব্যাংকের খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করতে হবে এবং ঋণ শ্রেণীকরণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করতে হবে।
অন্য দিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক আনুক‚ল্যপ্রাপ্তদের প্রভাব মাত্রা ছাড়ানো পর্যায়ে পৌঁছার ফলে এসব ব্যাংকের ঋণ বা বিনিয়োগ কার্যক্রম যে ব্যাহত হচ্ছে সে বিষয়েও আইএমএফ প্রতিনিধিদল দৃষ্টি দিয়েছে। এ কারণে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংক যাতে পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে তফসিলি ব্যাংকের কার্যক্রম তদারকি করতে পারে সে বিষয়ে জোর দিয়েছে।
বাংলাদেশ এখন যে অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়েছে তাতে বাইরে থেকে ডলারের সঙ্কট আর এ কারণে পণ্য আমদানি ব্যাহত হওয়া, আর নিত্যভোগ্যপণ্য আমদানি সঙ্কটে ভোক্তাদের কাছে নিত্যপণ্য আমদানি ঘাটতিতে ভোক্তাদের কাছে নিত্যপণ্য সরবরাহে সমস্যা দেখা যাচ্ছে। একই সাথে স্থানীয় বাজারে ওষুধের মতো অতি প্রয়োজনীয় ও বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে সঙ্কটের প্রভাব এসব পণ্যের অভ্যন্তরীণ বাজারে দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে রফতানিমুখী শিল্পে ক্ষেত্রবিশেষে অচলাবস্থা তৈরি হতেও দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন পোশাক কারখানা লে-অফ করার খবর আসছে। এর প্রভাব সামগ্রিক কর্মসংস্থানে অনিবার্যভাবে পড়বে। আর কর্মসংস্থানের সঙ্কট তথা বেকারত্ব ও আধাবেকারত্ব বৃদ্ধি পেলে জনগণের আয় বা ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। এর প্রভাব পড়বে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ওপর। আর এর সামগ্রিক প্রভাব উৎপাদন বা স্থূল দেশজ উৎপাদনের ওপরও পড়বে।
এভাবে আয় কমে যাওয়া ও ব্যয় বৃদ্ধির যে স্টেগফ্ল্যাশন (অচলাবস্থা ও মূল্যস্ফীতির যোগফল) প্রতিক্রিয়া ঘটবে সেটি দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক মন্দা নিয়ে আসতে পারে। আর এই মন্দা কাটিয়ে উঠতে হলে প্রয়োজন হয় অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ কাঠামোর শক্তিকে চাঙ্গা করে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা অর্জন।
আইএমএফকে কেন প্রয়োজন
আইএমএফ যে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে সেটি বিপুল অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটাতে বড় ভ‚মিকা রাখবে না। কিন্তু অর্থনীতির ভেতরে রাজস্ব কাঠামো, পুঁজিবাজার ও ব্যাংক ব্যবস্থার ভেতরে যে ঘুণ ধরেছে সেটি সারিয়ে অর্থনীতির রোগ মুক্তির জন্য আইএমএফের পরামর্শ বাস্তবায়ন কার্যকর ওষুধ হতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর যেসব রোগ বা দুর্বলতার কথা আইএমএফ বলেছে সেগুলো দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা এর আগেই বলেছেন। কিন্তু আইএমএফ বিশ্ব-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্যতম নিয়ামক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের পরামর্শ মানার সাথে বিশ্বব্যাংক এডিবি জাইকাসহ পশ্চিম প্রভাবিত আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং দেশের বিনিয়োগ ও সহযোগিতা প্রাপ্তির বিষয় জড়িত রয়েছে।
আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক কোনো দেশের অর্থনীতির সাথে যুক্ত হলে সেটি অন্যদেরও সংশ্লিষ্ট হওয়ার ইতিবাচক সংকেত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আইএমএফ টিম যাওয়ার পর বিশ্বব্যাংক ভাইস প্রেসিডেন্ট এসেছেন। পশ্চিমা প্রভাব বলয়ের অন্যান্য দেশও আসছে। এই বিনিয়োগ বা সহায়তার ইতিবাচক প্রবাহ সৃষ্টি হলো আইএমএফের সাথে সমঝোতার ইতিবাচক দিক।
অন্য দিকে আইএমএফ ঋণ সহায়তা দানের জন্য যেসব শর্ত দিয়েছে সেগুলো বাস্তবায়িত হলে অর্থনীতির কাঠামো দুর্বলতামুক্ত হতে পারে। আইএমএফ ব্যথানিরোধক প্যারাসিটামল ট্যাবলেটের মতো ওষুধ নয়। আইএমএফ যুক্ত হবার পরও অনেক দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে পরামর্শের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে, তবে সেই সাথে এ ব্যর্থতার একটি বড় কারণ দেখা যায় সংশ্লিষ্ট দেশের দুর্নীতি, কায়েমি স্বার্থের প্রাবল্য, রাজনৈতিক কারণে সংস্কারে অনীহা।
বাংলাদেশ আইএমএফের সাথে যুুক্ত হওয়ার পর সংস্কার পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করলে জনভোগান্তি আপাতত বাড়বে বিশেষত সরকার নির্ধারিত পরিষেবা- বিদ্যুৎ গ্যাস তেল সার ইত্যাদির মূল্য সমন্বয়ের স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া কার্যকর হলে এসব পরিষেবার দাম বাড়তে থাকবে। এরপর এতে মধ্যমেয়াদে অর্থনীতির জন্য আবার সঠিক পথে ফিরে আসার অবকাশ তৈরি হবে।
রাজনৈতিক তাৎপর্য কী
বাংলাদেশ সরকারের সাথে আইএমএফের যুক্ত হওয়ার রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা রয়েছে। সাধারণভাবে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংককে পাশ্চাত্য নিয়ন্ত্রিত বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বলা হয়, আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সাথে সমঝোতা মানে হলো সরকারের সাথে পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক সমঝোতা হওয়া। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাস্তবে কি বিষয়টি সে রকমই ঘটেছে? এমন প্রশ্নের জবাব সম্ভবত নেতিবাচক হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন ও তার মিত্ররা বৈশ্বিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র মানবাধিকারকামীদের মিত্র হিসাবে গ্রহণ করে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের সাথে তাদের কৌশলগত সম্পর্ককে এর ব্যতিক্রম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সাধারণভাবে পশ্চিমারা কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর মধ্যে পশ্চিমের কৌশলগত প্রতিপক্ষ চীন-রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রবণতা দেখতে পায়। এসব দেশের সরকার মনে করে উদার গণতন্ত্রের মধ্যে কারা ক্ষমতায় আসবে তা নিয়ন্ত্রণে ভ‚মিকা রাখতে পারে পাশ্চাত্য। জনসমর্থন ছাড়া এসব দেশে ক্ষমতায় থাকা যায় না। ফলে সরকারগুলো জনসমর্থন হারানোর সাথে সাথেই চীন-রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করে।
অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও মানবাধিকার রক্ষার এজেন্ডা সামনে নিয়ে আসায় সরকারের মধ্যে বেইজিং-মস্কোর ঘনিষ্ঠ হবার প্রবণতা দেখা যায়। স্বাধীনতা উত্তরকাল থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নে পাশ্চাত্যের একতরফা প্রাধান্য থাকলেও সা¤প্রতিক বছরগুলোতে সরকার চীন রাশিয়ার বিনিয়োগে সংবেদনশীল অনেক বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করে আসার কয়েক মাস পর রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বাংলাদেশে আসছেন।
এ অবস্থায় পশ্চিমা দেশগুলো তাদের উদার গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের রাজনৈতিক এজেন্ডার সাথে অর্থনীতির বিষয়াবলির মধ্যে পার্থক্য টানতে চাইছে। তারা দু’টি কারণে সেটি করতে চাইছে বলে মনে হয়। প্রথমত, বাংলাদেশে পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। দেশের মোট গ্রাহকের চাহিদার ৫৫ শতাংশ গ্যাস আমেরিকান কোম্পানি শেভরন সরবরাহ করে। ব্রিটিশ ফ্রান্স ও অন্য ইউরোপীয় এবং তাদের মিত্রদেশ জাপানের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে বাংলাদেশে। এই বিনিয়োগ ও তার মুনাফা নিশ্চিত করতে হলে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়তে দেয়া যাবে না। আইএমএফ বিশ্বব্যাংকের সরকারের সাথে সমঝোতার ক্ষেত্রে এটি একটি প্রধান যুক্তি।
দ্বিতীয়ত, পাশ্চাত্য একটি দেশের সরকার ও জনগণকে আলাদাভাবে দেখতে চায়। সরকারকে শায়েস্তা করতে গেলে এর মূল শিকার হয় জনগণ। এ কারণে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে মোটা দাগের নিষেধাজ্ঞা অবরোধ আরোপের বিষয়টিকে তারা অনাগ্রহের সাথে দেখে। এ ধরনের পদক্ষেপে শ্রীলঙ্কার মতো দেশে অর্থনৈতিক দুর্গতি এমন পর্যায়ে পৌঁছতে দেখা গেছে সেখান থেকে পুনরুদ্ধার পরবর্তী সরকারের জন্য দুরূহ হয়ে পড়েছে। তবে চূড়ান্ত পর্যায় এলে মিয়ানমারের মতো এসব স্বার্থগত বিষয়কে অস্বীকার করে সর্বাত্মক বৈরী নীতি নিতেও দেখা যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সে পর্যায়ে পশ্চিমা দেশগুলো এসেছে বলে মনে হয় না। এর অর্থ এই নয় যে, পশ্চিমারা তাদের মূল শর্ত গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের এজেন্ডা পরিত্যাগ করবে। এ ছাড়া আইএমএফের সাথে সমঝোতা হলেই যেকোনো দেশ এর সুবিধা পেতেই থাকে সেটি অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। তাদের শর্তে না মিললে সহায়তা প্রত্যাহারের ঘটনা অনেক দেশের ক্ষেত্রে ঘটেছে। দেখার বিষয় হলো শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের পরিস্থিতি কোন দিকে গতিমুখ নেয়।