৭ ডিসেম্বর রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলনকক্ষে একনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ‘মেঘনা’ নদীর নামে কুমিল্লা ও ‘পদ্মা’ নদীর নামে ফরিদপুর বিভাগ করার কথা প্রধানমন্ত্রী পুনর্ব্যক্ত করেন। আমরা মেঘনাবাসী, ‘মেঘনা’ নামে বিভাগ ঘোষণা করায় প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক অভিনন্দনসহ দীর্ঘায়ু কামনা করছি। কারণ, মেঘনার জল, মেঘনার ফল, মেঘনার প্রকৃতি ও আবহাওয়ার সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্ক। আজ থেকে কমবেশি ৭০০ বছর আগে মেঘনার এক ক‚ল ছিল দাউদকান্দি আরেক ক‚ল ছিল সোনারগাঁও মাঝখানে ছিল অথই পানি। মেঘনার পাড়ে ছিল মগ জলদস্যুদের উৎপাত। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ইরান থেকে আসেন হজরত দানেশমন্দ রহ:। জলদস্যু দমন করার পর জনগণের অনুরোধে হজরত দানেশমন্দ রহ: রয়ে যান সোনারগাঁওয়ে। একবার নদীপথে মেঘনা পার হওয়ার সময় ডুবোচরে আটকে যায় তার বজরা। অথই পানি থেকে ভেসে উঠতে শুরু করে চর। মেঘনা ও এর শাখা-প্রশাখা বেষ্টিত ভেসে ওঠা চরের নাম ‘ব্রাহ্মণচরের প্যাঁচ’। ৬০ বর্গমাইল পরিমিত চর/দ্বীপটি দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল- বিচ্ছিন্ন ছিল সরকারের যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকেও। দ্বীপটির প্রতি সরকারের নজর না থাকলেও নজর ছিল প্রকৃতির। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর দ্বীপটির নদী-নালা ও খাল-বিল ছিল মৎস্যপূর্ণ আর মাটি ছিল উর্বর।
২৬ আগস্ট ১৯৯৮ বিচ্ছিন্ন দ্বীপটি ‘মেঘনা’ নামে নতুন উপজেলায় রূপান্তর হয়। নতুন উপজেলাকে উপলক্ষ করে প্রথম প্রকাশিত স্মরণিকার নামও ‘মেঘনা একটি দ্বীপের নাম’। মেঘনার স্মরণে আমাদের কন্যাসন্তানের নাম ‘মেঘনা’ রাখাসহ একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নামও ‘মেঘনা পাবলিকেশন্স’। মেঘনা পাবলিকেশন্স থেকে মেঘনাবাসীর সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, চাওয়া-পাওয়া নিয়ে মেঘনার কবি-সাহিত্যিকদের গল্প, উপন্যাস, কাব্য ও প্রবন্ধ আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে। আমার সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণার মূলেও ‘মেঘনা’র মানুষ ও নিসর্গ। মেঘনা পাবলিকেশন্স থেকে এপ্রিল/২০২১ প্রকাশিত গ্রন্থের নাম ‘মেঘনা’ পাড়ের গাঁ। যখন আমাদের সবকিছু মেঘনাময় তখনই (গত ২১ অক্টোবর) কুমিল্লা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বলেন, ফরিদপুর বিভাগের নাম দেবো ‘পদ্মা’ আর কুমিল্লা বিভাগের নাম হবে ‘মেঘনা’। ‘পদ্মা, মেঘনা, যমুনা- তোমার আমার ঠিকানা’ এ স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ করেছে এবং বিজয় অর্জন করেছে। কাজেই কোনো জেলার নামে বিভাগ হবে না। তাই আমি কুমিল্লা নয়, ‘মেঘনা’ নামে এবং ফরিদপুর নয়, ‘পদ্মা’ নামে বিভাগের প্রস্তাব করছি।’
প্রস্তাব শোনার পর কী যে আনন্দ লাগছিল প্রকাশ করার নয়। ‘মেঘনা নামে বিভাগ’ শ্রবণের সাথে সাথেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী মহোদয়কে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। মেঘনার যে গ্রামে আমার জন্ম সে গ্রামসহ মেঘনাকে নিয়ে আমি গর্ব করি। গ্রাম ও মেঘনাকে নিয়ে গর্ব করার কারণ, সুখের সন্ধানে যেখানেই যাই/শিকড়ের কাছেই সুখ ফিরে পাই।
উপজেলা হওয়ার পর মেঘনায় একদিকে শুরু হয় শিক্ষা ও উন্নয়নের প্লাবন আর অপর দিকে শুরু হয় নদীভাঙন। নদীভাঙনের একমাত্র কারণ, অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন। প্রচণ্ড বাধা ও আন্দোলনে বন্ধ হয় বালু উত্তোলন, থামে নদী ভাঙনও। মেঘনায় বইতে শুরু হয় সুখের বাতাস। মেঘনা উপজেলায় ইউপি নির্বাচন ছিল ১১ নভেম্বর। ১১ নির্বাচনের ইউপি নির্বাচন মেঘনার সব সুখ উলট-পালট করে দিয়ে যায়। মেঘনার নির্বাচনে দুইজন নিহত হওয়াসহ মেঘনা থানায় অর্ধডজন মামলা হয়। যেমন, মেঘনা থানা মামলা নং ৩(১১) ২১, ধারা ১৪৭/১৪৮/১৪৯/৩৩২/ ৩৫৩/৫০৬ দণ্ডবিধি, বাদি এসআই মো: নাজির হোসেন, বিবাদি অজ্ঞাতনামা ২০০/৩০০ জন, স্থান : মেঘনা থানাধীন রামপ্রসাদের চর প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঘটনার সময় ১১ নভেম্বর ২০২১ সকাল ৮.২৫ ঘটিকা। ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ : ‘কেন্দ্রের উত্তর এবং দক্ষিণ দিক থেকে অজ্ঞাতনামা ২০০/৩০০ জন বিভিন্ন বয়সী নারী ও পুরুষ হাতে টেঁটা, বল্লম, দা, সুরকি, লাঠি এবং ইট-পাটকেল ইত্যাদি নিয়ে দাঙ্গা সাজে সজ্জিত হয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণ করে। ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তার স্বার্থে কেন্দ্র এবং মোবাইল টিমের অফিসার ফোর্সরা হুইসেল বাজিয়ে বিবদমান পক্ষগুলোকে দূরে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। দাঙ্গাকারীরা পুলিশের নির্দেশ উপেক্ষা করে পরস্পরকে আক্রমণ করে বসে। জীবন ও সরকারি সম্পত্তি রক্ষার সার্থে দাঙ্গাকারীদের বারবার সতর্ক করার পরেও নিবৃত্ত না হওয়ায় তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য মোবাইল অফিসারের নির্দেশে কং/২০৬৮ শাওনদাশ মোবাইল ০১..৯৬- ৬৭..৬-এর গ্যাসগান থেকে ৭ সাত রাউন্ড টিয়ার শেল নিক্ষেপ করেন। দাঙ্গাকারীরা এতেও নিবৃত্ত না হয়ে পুলিশের প্রতি ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। দাঙ্গাকারীদের নিক্ষিপ্ত একটি ইটের টুকরা কেন্দ্রের ইনচার্জ এসআই (নিঃ/চন্দনকান্তি দাস -এর ডান হাতের কব্জিতে পড়লে তিনি সামান্য জখমপ্রাপ্ত হন। তখন মোবাইল অফিসারের নির্দেশে দাঙ্গাকারীদের ছত্রভঙ্গ করেতে নারী কং-২০৬৬ নমিতারানীর শটগান থেকে পাঁচ রাউন্ড রাবার বুলেট শূন্যে ফায়ার করে। সংবাদ পেয়ে মেঘনা থানার ওসি আবদুল মজিদের নেতৃত্বে আমিসহ অতিরিক্ত পুলিশ এসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করি এবং সকাল অনুমান ৯টা ৪৫ ঘটিকার সময় ভোটগ্রহণ পুনরায় শুরু হয় ও যথানিয়মে বিকেল ৪ ঘটিকায় ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়। আলামত দাঙ্গাকারীদের ফেলে যাওয়া তিনটি লোহা সংযুক্ত মুলিবাঁশের টেঁটা যা লম্বা অনুমান ৬ ফুট সকাল ৯.৩০ ঘটিকায় প্রাপ্ত হয়ে জব্দ করি। পরে, রামপ্রসাদের চর ও রড়ইয়াকান্দি নদীর রামপ্রসাদের চর গ্রামের অংশে পাকা ঘাটে ১০.২০ ঘটিকায় ৭টা মুলিবাঁশের টেঁটা লম্বা ৬ ফুট উদ্ধার করি।’
৩ নং মামলার মতো প্রতিটি মামলায় রয়েছে এরকম ‘অজ্ঞাতনামা’ কয়েক’শ করে আসামি। অজ্ঞাতনামা আসামি ধরতে শুরু হয় পুলিশি অভিযান। পুলিশের ভয়ে পুরুষশূন্য হয়ে যায় মেঘনার গ্রামের পর গ্রাম। ৩ নম্বর মামলার ঘটনাস্থল রামপ্রসাদের চর প্রাাথমিক বিদ্যালয়। দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে বিরোধ। দু’জন একই রাজনৈতিক দলের। একজন অনেক শ্রম ও অর্থ খরচ করে নৌকা প্রতীক পেয়েছেন। অন্যজন শত চেষ্টা করেও নৌকা প্রতীক না পেয়ে তার আপন ভাইকে সমর্থন করেছেন নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে। দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর একজনও রামপ্রসাদের চরের নয়। রামপ্রসাদের চর গ্রামে চেয়ারম্যান প্রার্থী না থাকলেও ভোটারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে সতেরো ’শ। কস্তুরী যে কারণে কস্তুরীবাহী হরিণের প্রাণসংহারের কারণ হয় সে কারণে বিপুল পরিমাণ ভোটই নিরীহ গ্রামটির ক্ষতির কারণ হয়েছে। ৩ নম্বর মামলায় ৬টি ধারার মধ্যে শুধু ৩৩২ ধারাটি জমিন অযোগ্য।
মেঘনা থানার ওসি মো. ছমিউদ্দিন মেঘনাবাসীর উদ্দেশে সালামসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন যে, ‘গত ১৪/১১/২০২১ খ্রি. তারিখ আমি অফিসার ইনচার্জের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আপনাদের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা ও আপনাদের প্রাপ্য সেবা প্রদানের জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। আপনাদের সদয় অবগতির জন্য জানাতে চাই, পুলিশ সুপার কুমিল্লার নির্দেশ অনুসারে নির্বাচনী সহিংসতায় জড়িত অপরাধীদের ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর শনাক্ত মতে বিগত কয়েক দিন যাবৎ অভিযান পরিচালনা করে অত্র থানাধীন মানিকার চর এলাকা ও রামপ্রসাদের চর এলাকা থেকে বেশ কয়েকজন অপরাধীকে গ্রেফতারপূর্বক বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। আপনাদের অবগতির জন্য আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই মেঘনা থানার কোনো অপরাধীকে যেমন ছাড় দেয়া হবে না, তেমনি ভাবে কোনো নিরপরাধ মানুষ হয়রানির শিকার হবে না। কেউ যদি আমার নাম বা মেঘনা থানা পুলিশের নাম ব্যবহার করে কোনো নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি করে আমাকে তথ্য দিন। আমি কথা দিচ্ছি- ওই অপরাধী ব্যক্তি বা জড়িত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পরিশেষে, মেঘনা থানা এলাকার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সব জনসাধারণের নিরাপদ ও শান্তিময় জীবন কামনা করছি। ইতি আপনাদেরই ওসি মো: ছমিউদ্দিন।
রামপ্রসাদের চর গ্রামের আবদুল বারেক মাস্টারের বয়স ৬৮ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। প্রতিদিন সন্ধ্যার আগেই চলে যান পাশর্^বর্তী জেলায়। সেসহ আরো কয়েকজনকে মামলার সহজ ধারাসহ ওসি সাহেবের অভয়বাণী শুনানোর পরেও বাড়িতে থাকতে রাজি নয়। তাদের কথা, Ñ ভিডিও ছিল নির্বাচনকেন্দ্রে। ভোট দেয়ার জন্য ভালোমন্দ অনেকেই ছিল নির্বাচনকেন্দ্র ও এর আশপাশে। মামলার ধারা সহজ কী করে হয়, ডিসেম্বরের ১ তারিখে দু’জন আসামি ধরে নিয়ে গেছে, এখনো (১০ ডিসেম্বর) জামিন পায়নি। লোকে বলে, পুলিশে ছুঁলে আঠার ঘা। হাটে-বাজারেও খোঁজ করছে রামপ্রসাদের চরের লোক।
মেঘনা কৃষিপ্রধান এলাকা। বহুল প্রচলিত খনার বচন ‘যদি বর্ষে আগনে (অগ্রহায়ণে) থাল লয়ে যায় মাগনে’ এবার বড় অসময়ে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের কারণে শীতের শুরুতে প্রচুর বৃষ্টিপাতে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার জন্য রাতদিন মাঠে কাজ করতে হবে কৃষককে। কৃষির এই ভয়ঙ্কর সঙ্কটকালে মাঠে থাকতে না পারলে মেঘনার কৃষককে ঠিকই থাল নিয়ে মাগনে নামতে হবে। আমি কৃষক পরিবারের ছেলে। কৃষির ক্ষতিসহ কৃষকের দুঃখ সহ্য করতে পারি না। আমার প্রিয় মেঘনার প্রিয় মানুষগুলো ভালো নেই।
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক