রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২৬ পূর্বাহ্ন

মাঠ চুরি পুকুর চুরি হাসপাতাল ভুরিভুরি

ড. নূর জাহান সরকার
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০২২
  • ১৩৮ বার

অত্যন্ত বেদনার সাথে এ ধরনের লেখা লিখতে হচ্ছে। কেন যেন মনে হলো- দেখিনা, মনের কথা ব্যক্ত করে যে কথা শুধু বেদনাই দিচ্ছে না; বরং আতঙ্কিত করছে আমাদের।

আমি বরিশালের মেয়ে। যে এলাকার মানুষ হাঁটার আগে সাঁতার শেখে। অবশ্য এখনো তেমন কি না জানি না। আমরা প্রতিদিন একটা সাঁতার দিয়ে গোসল করে কৈ, মাগুর, শিংয়ের যেকোনো মাছের সাথে আলু, পেঁপে, কাঁচকলা কিংবা অন্য কোনো তরকারির ঝোল দিয়ে গরম ভাত খেয়ে স্কুলে যেতাম। সে সময় প্রায় প্রতি ঘরে মাটির চাড়িতে কৈ, শিং, মাগুর জিয়ানো থাকত। ওখান থেকে দু-তিনটি মাছ ধরে মায়েরা স্কুলের সন্তানদের জন্য রাঁধতেন সকালে। প্রতিদিন প্রায় এক মাইল হেঁটে স্কুলে যেতাম। স্কুল শেষে আবার এক মাইল হেঁটে বাড়ি ফিরে আসতাম। আবার একটা সাঁতার দিয়ে গোসল করে ভাত খেয়ে ছুটতাম পাড়ার মাঠে দাঁড়িয়াবান্দা কিংবা দৌড়াদৌড়ি অথবা এক্কা-দোক্কা খেলতে। সাঁঝ পড়ে আসত, মায়ের পাখার ডাণ্ডির পিটুনির ভয়ে মাগরেবের আজানের এক মিনিট আগে হলেও বাসায় ফিরতাম।

সে সময় প্রতিটি বাসার পেছনে একটি করে পুকুর ছিল যার সংযোগ ছিল একটি খালের সাথে, খালের সংযোগ নদীর সাথে। ছিল স্কুলের পুকুর, কলেজের পুকুর, মসজিদের পুকুর, থানার পুকুর, পৌর করপোরেশনের পুকুর, গ্রামে তো প্রতি গেরস্তের একটি পুকুর- অর্থাৎ প্রতি বাড়িতে যত গেরস্ত তত পুকুর। এসব পুকুরের সাথে খালের যোগাযোগ ছিল কোথাও কোথাও। ১৯৭১ সালে আমাদের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। সে সময়ের হিসাবে প্রতি পাঁচজনে একটি পরিবার ধরা হয়। তাহলে দাঁড়ায় প্রায় দেড় কোটি পুকুর। দেড় কোটি পুকুর কি আছে এখন? উন্নয়নের জোয়ার ও দখল-দূষণে পরিবেশ আক্রান্ত, পুকুর উধাও।

সে সময় মোটাসোটা অর্থাৎ অতিরিক্ত স্বাস্থ্যবান ছিল না কেউ। এখন? সেই মাঠও নেই পুকুরও নেই। এলাকার খেলার মাঠই বলি, পুকুরই বলি- সবই বেদখল। ভ‚মিদস্যুরা সব দখল করে সুউচ্চ দালান, দোকান, বাজার সৃষ্টি করেছে। এদের নাকি অনেক শক্তি। যথাযথ শক্তির প্রভাবে তারা তারাই এলাকার হর্তাকর্তা বিধাতা। অতএব সাধারণ জনগণ সাধারণত নীরবে তা মেনে নিয়েছেন। তাদের সন্তানরা ঘরে ঘরে মোবাইল প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়েছে। যাচ্ছে দিন দিন মুটিয়ে, জুটিয়ে নিয়েছে নানা রোগ যেমন- হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট প্রভৃতি দুরারোগ্য ব্যাধি। শুধু তাই নয়, ফেসবুকের মাধ্যমে জুটিয়ে নিয়েছে বন্ধুবান্ধব, চলে যাচ্ছে জীবনের ট্র্যাকের বাইরে। এরা অনেকেই হয়ে পড়েছে মানসিক রোগী। অতএব নিরুপায় পিতামাতা তাদের সুস্থতার জন্য হন্যে হয়ে দৌড়াচ্ছেন ডাক্তারবাড়ি। এ সব বাবা-মা তথা দেশের প্রায় সব বাবা-মার প্রয়োজনের তাগিদে গড়ে উঠছে শত শত, হাজার হাজার হাসপাতাল। এ সব হাসপাতালের এই টেস্ট ওই টেস্ট। এসব এবং ডাক্তারের খরচ মিলিয়ে বাবা-মা পাগলপ্রায়। নিয়ে যেতে হচ্ছে জিমেও। সেই জিমেও কি কম খরচ! এ এক ব্যবসায় বটে! ভুরিভুরি হাসপাতাল আর জিম যখন কোনো পরিবর্তন আনতে পারছে না তখন শিশুদের স্বাস্থ্যের সুস্থতার জন্য ডাক্তারের পরামর্শে ওদের নিয়ে যেতে হচ্ছে সুইমিংপুলে। আকাশচুম্বী খরচ সেখানে। অগত্যা বেশি দিন তা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য বাবা-মা হাল ছেড়ে দিয়ে হতাশায় ভুগছেন।

এই সুইমিংপুলেই দেখা হয় আমার এসব শিশু-কিশোরীর সাথে। কারণ আমি সুযোগ পেলেই সাঁতরাই। সাঁতার আমার এত ভালো লাগে যে, পানিতেই কেন আমার দিন কাটে না এমন মনে হয়। এ ছাড়া বয়সের সাথে সাথে এ ব্যথা, সে ব্যথা। ডাক্তারের পরামর্শ যত দিন পারেন সাঁতারেই থাকেন, ভালো থাকবেন, শরীরের জন্য সাঁতারের বিকল্প কিছু নেই।

করোনাকালে কখনো সাঁতারে যাইনি। করোনার পরে ইদানীং আবার সাঁতার শুরু আমার। সুইমিংপুলে নামার সময় আমার চোখে ধরা পড়ল শিশুদের অস্বাভাবিক মুটিয়ে যাওয়ার দৃশ্য, যেন ওরা ফুলে ফেঁপে এক একটি বেলুন হয়ে গেছে। আমার খুবই কষ্ট হলো। করোনাকালে ঘরবন্দী থাকার ফলে আর কী!

তাহলে এখন আসল কথায় আসতে হয়। করোনা না হয় এ দুই-তিন বছর ধরে চলছে। আগে-পরে? এহেন পরিস্থিতি কারা তৈরি করল? মাঠ রক্ষা, পুকুর রক্ষা কি একটি দেশের যথাযথ প্রশাসনের জন্য এতই অসম্ভব ছিল? তাহলে দেশের আইনকানুন কোথায় গেল?

শুধু কি মাঠ-পুকুর? নদীখেকো, পাহাড়খেকো, বালুখেকো- সব রকম খেকোদের দৌরাত্ম্যে দেশ এখন নাকাল। দেশের মানুষ অসহায়, যেন মরে গিয়ে বেঁচে আছে। জীবনের ভয়ে আড়ষ্ট। কার জায়গা কে কখন দখল করে নিচ্ছে, কার বাড়িঘর কার হয়ে যাচ্ছে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। এই যে দখলদারবাহিনী- এরা কি একদিনে তৈরি হয়েছে? দিনে দিনে বছরে বছরে যুগে যুগে অদৃশ্য শক্তির ছায়ায় এ সিস্টেম পাকাপোক্ত হয়ে গেছে। তবে কখনো কখনো দখলদারদের উৎখাত করতে দেখা যায়। তার ফলাফল কী? যাহা বায়ান্ন তাহা তেপ্পান্ন।

আবারো প্রশাসনের প্রভাবশালী চক্রের সাথে আঁতাতের মাধ্যমে খেকোদের সব ঠিক হয়ে যায়। অসহায় জনগণ নীরবে এসব শুধু অবলোকন করে যাচ্ছে যেন নিজ দেশে পরবাসী। অন্য দিকে রক্ষকের বারবার ভক্ষণে প্রভাবশালীর মুখে হাসি। মুখ খুললে তোমার ফাঁসি। আমার এক ভুক্তভোগী বান্ধবীকে তার স্বরচিত কবিতা আওড়াতে শুনে ছিলাম-
‘দেখে শুনে মনে হয়
দেশটা বুঝি আমার নয়,
দেশটা যদি আমার হবে
আমার সম্পদ আমারই রবে।

লেখক : পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ
প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান
প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com